আগে জাতীয় নির্বাচন, নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন—এই প্রশ্নে রাজনীতিতে তুমুল বিতর্ক দেখা গিয়েছিল চলতি বছরের শুরুতে। কিন্তু তখন বিএনপির বিরোধিতার মুখে বিষয়টি হালে পানি না পেয়ে একরকম আলোচনার বাইরে চলে গিয়েছিল।

তবে সম্প্রতি কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নতুন করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার দাবি সামনে আনা হয়েছে। নতুন করে দাবিটি সামনে আনার কারণ কী, এর পেছনে কোনো কৌশল আছে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহল তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও গণ অধিকার পরিষদ—এই তিনটি দল গত সপ্তাহে স্পষ্ট করে বলেছে, তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়।

অবশ্য বিএনপি বরাবরই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচন দাবি করে আসছে। যদিও সম্প্রতি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার বিষয়ে নতুন করে দাবি ওঠার পর বিএনপি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি।

বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে জোরালো অবস্থান নিয়েছে। এ দাবিতে সব দলকে এক জায়গায় এনে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ তৈরির জন্য সম্প্রতি নিজেদের যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বিএনপি।

২৩ এপ্রিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও গণ অধিকার পরিষদের মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম ও গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক পৃথক বক্তব্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে দুই দলের মধ্যে মতৈক্য হয়েছে বলে জানান।

আরও পড়ুনডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য সবাই উদ্‌গ্রীব: আমীর খসরু২৪ এপ্রিল ২০২৫

এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে নুরুল হক সেদিন বলেছিলেন, ‘গত আট মাসে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি না থাকায় সেবা পেতে মানুষ ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কিছু মানুষ জোর করে আধিপত্য বিস্তার করছে। সে জন্য স্থানীয় নির্বাচন মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে। জাতীয় নির্বাচনের আগে সংস্কারে কিছু সময়ের প্রয়োজন। আবার জাতীয় ঐকমত্যেরও প্রয়োজন। অন্তত তার আগে স্থানীয় নির্বাচন হতে পারে।’

মূলত এই বৈঠক-বক্তব্যের মধ্য দিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে আয়োজনের দাবি নতুন করে সামনে আসে।

গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের বৈঠকের দুই দিনের মাথায় ২৫ এপ্রিল জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান ময়মনসিংহ নগরের সার্কিট হাউস ময়দানে দলের এক অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি আহ্বান জানান। সেদিন শফিকুর রহমান বলেন, ‘একটা নির্বাচন কমিশন হয়েছে। তারা বলেছে, তারা নাকি ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো নির্বাচন উপহার দেবে। আমরা তাদের একটি অ্যাসিড টেস্ট (অগ্নিপরীক্ষা) দেখতে চাই। জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যেটা দিয়ে পাঁচ বছর দেশ শাসন হবে, সেই নির্বাচনের আগে জনগণ এখন সাফার করছে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিধি না থাকার কারণে। আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা দিন। আমরা দেখি, আপনাদের সদিচ্ছা ও সক্ষমতা কতটুকু। এটার প্রমাণ আপনারা পেশ করুন।’

আরও পড়ুনডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায় বিএনপি১৬ এপ্রিল ২০২৫

আনুষ্ঠানিকভাবে দলের পক্ষ থেকে না বললেও নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন চাইছে। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে এ চাওয়ার কথা বলেছেন।

গত ৬ জানুয়ারি ঢাকায় জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউটের (এনআইএলজি) সম্মেলনকক্ষে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। মতবিনিময়ে কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতীয় পর্যায়ে সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হলেও ঢাকার বাইরে মানুষের মতামতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রাধান্য পাচ্ছে। ঢাকার বাইরে মতবিনিময় করতে গিয়ে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন এ চিত্র পাচ্ছে।

গত ৮ জানুয়ারি ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের (ইআইবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এমন পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে মত দেয় জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি নেতাদের পূর্বতন প্ল্যাটফর্ম) ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার পক্ষে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত সরকারের পক্ষ থেকে হয়নি।

আরও পড়ুনস্থানীয় নির্বাচন আগে চায় ইসলামী আন্দোলন ও গণ অধিকার পরিষদ২৩ এপ্রিল ২০২৫

অন্যদিকে বিএনপির নেতারা শুরু থেকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাঁরা আগে চান, জাতীয় নির্বাচন।

গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন দলের নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেখা গেছে।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এনসিপির আত্মপ্রকাশের পর মার্চে রোজার মধ্যে দলটির নেতাদের কেউ কেউ বিভিন্ন সভা-সমাবেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার পক্ষে বক্তব্য দেন। যেমন গত ১৯ মার্চ এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ কুমিল্লা শহরতলির শাসনগাছা বাস টার্মিনালে এক গণ-ইফতার অনুষ্ঠানে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন।

তবে দল গঠনের পর স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার চেয়ে এনসিপির জ্যেষ্ঠ নেতারা গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে বেশি সরব হন।

শুরু থেকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চাওয়ার দাবির কড়া সমালোচনা দেখা গেছে বিএনপির নেতাদের মুখে। মিত্রদলগুলোর কেউ কেউ বিএনপির নেতাদের বক্তব্যে কণ্ঠ মেলান। মূলত বিএনপির বিরোধিতার মুখে অন্যান্য দলও কার্যত স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে আয়োজনের দাবি আর সেভাবে সামনে আনেনি।

আরও পড়ুনজাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিন: জামায়াতের আমির২৫ এপ্রিল ২০২৫

সরকারের পক্ষ থেকেও আর এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য আসেনি। সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারির পর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা কমে যায়।

সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও গণ অধিকার পরিষদ বিষয়টিকে নতুন করে সামনে আনার আগে ২০ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।

প্রতিবেদন দাখিল–পরবর্তী সংবাদ ব্রিফিংয়ে কমিশনের কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চান, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে তারা কী সুপারিশ করেছে? জবাবে কমিশনপ্রধান স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ইচ্ছা করেই এ বিষয়ে স্পষ্ট করে তাঁরা কিছু বলেননি। তাঁরা বলেছেন, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিক। স্থানীয় সরকার নির্বাচনও গুরুত্বপূর্ণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনও গুরুত্বপূর্ণ। একটি করলে আরেকটি করা যাবে না, এ-জাতীয় শর্তই অমূলক কথা। দুটিই করতে হবে। তবে তাঁরা চান, স্থানীয় সরকার নির্বাচন অবিলম্বে করা হোক।

আরও পড়ুনঢাকার বাইরে মানুষের মতামতে স্থানীয় নির্বাচন প্রাধান্য পাচ্ছে: তোফায়েল০৬ জানুয়ারি ২০২৫নতুন করে আলোচনার কারণ কী

গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার দাবি রাজনৈতিক অঙ্গনে অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল। কিন্তু মার্চে রোজার সময় ও ঈদুল ফিতরের পর গত কয়েক সপ্তাহে বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা দেখা যায়নি। অনেকটা আলোচনার বাইরে চলে যাওয়া এ দাবি নতুন করে কেন সামনে এল, তা রাজনীতিতে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।

বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে সারা দেশে একধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। সেই পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কারণে দলের তৃণমূলে কোন্দল-বিভাজন তীব্র হতে পারে। এই বিশৃঙ্খলার প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলের ওপর পড়তে পারে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন যেহেতু কথা বলার পরিবেশ আছে, তাই বিভিন্ন দল তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে। সে জন্য হয়তো সবাই নিজ নিজ বক্তব্য দিচ্ছে। তবে বিএনপি মনে করে, জাতীয় নির্বাচনই আগে হওয়া উচিত। উল্লেখ্য, যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল, তখনো ওই সরকারের অধীন স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়নি।’

আরও পড়ুনসংসদের পাশাপাশি স্থানীয় নির্বাচনেরও প্রস্তুতি চলছে০৮ জানুয়ারি ২০২৫

অন্যদিকে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাওয়া দলগুলোর নেতারা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হলে বিএনপির বাইরে অন্য দলগুলোর প্রার্থীরাও ভালো ফলাফল করতে পারেন। তৃণমূলে তাঁদের পরিচিতি ও অবস্থান আরও সংহত হতে পারে। ফলে দলগুলো সুবিধাজনক অবস্থায় চলে যেতে পারে। বিএনপি সেই ভয়েই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাইছে না।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার দাবি নতুন করে সামনে আনার বিষয়টি বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল কিংবা আগামী জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত কি না, সেই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার দাবি সামনে আনা দলগুলোর মধ্যে এ বিষয়ে কোনো অভ্যন্তরীণ সমঝোতা আছে কি না, সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নতুন করে দাবিটিকে সামনে এনেছেন, বিষয়টি এমন নয়। শুরু থেকেই তাঁর দল বিষয়টি নিয়ে সরব। তাঁরা সব সময়ের জন্য জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন স্থানীয় সরকার নির্বাচন চান। কারণ, দলীয় সরকারের সময় সংসদ সদস্যরা স্থানীয় সরকারে নিজস্ব লোক বা স্বজনদের বসান। ফলে স্থানীয় সরকার কার্যকর হতে পারে না।

আরও পড়ুনপ্রশাসনের স্বচ্ছতা যাচাইয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা যেতে পারে: হাসনাত আবদুল্লাহ১৯ মার্চ ২০২৫

এ ছাড়া অন্য যেসব দল স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চাইছে, তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো সমঝোতা হয়েছে, বিষয়টি এমন নয় বলে দাবি করেন ইসলামী আন্দোলনের এই নেতা। তিনি বলেন, সরকার সক্রিয় হচ্ছে। ঐকমত্য কমিশন কাজ করছে। সব মিলিয়ে তাঁদের মনে হয়েছে, বিষয়টি জোরালোভাবে বলা দরকার। নিজেরা বলার পাশাপাশি সমমনা দলগুলোকেও এ বিষয়ে বলা হচ্ছে।

আরও পড়ুনস্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করার পক্ষে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫আরও পড়ুনজাতীয় নির্বাচন আগে নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে, কী বলছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন২০ এপ্রিল ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য় সরক র র র জন ত ক কর র দ ব দলগ ল র ব এনপ র উপদ ষ ট র জন য এনস প ইসল ম ব ষয়ট অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর সমন্বয় ছাড়া আর্থিক খাতের সংস্কার টেকসই হবে না

নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ছাড়া আর্থিক খাতের সংস্কার টেকসই হবে না। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নিয়মিত সভা করে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির জোগান ও ব্যাংকের মূলধন কীভাবে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে রূপরেখা তৈরি করে বাস্তবায়ন করতে হবে। মূলধন জোগান দেওয়া ছাড়া শুধু সংকটে পড়া ব্যাংক নয়, ভালো ব্যাংকগুলোকেও ভুগতে হতে পারে।

‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আস্থা পুনরুদ্ধার: মূলধন এখন কেন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় এমন অভিমত উঠে আসে। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ আজ সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, ব্যাংকার, পুঁজিবাজারের অংশীজনেরা উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা সঞ্চালনা করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ।

বক্তারা বলেন, ব্যাংকে পর্যাপ্ত মূলধন হলো আর্থিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি, যা আমানতকারীদের সুরক্ষা দেয়, তারল্য বজায় রাখে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা টিকিয়ে রাখে।

এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘আমাদের জাতীয় বিনিয়োগ কৌশল নেই। ফলে বিনিয়োগ বাড়াতে যেসব বাধা রয়েছে, সেগুলোর সমাধান হচ্ছে না। বিনিয়োগ বাড়াতে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোও বিভিন্ন বাধা তৈরি করে রেখেছে। এসব দূর করা জরুরি। ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বন্ধ করে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ তুলতে হবে। ব্যাংকের মূলধন বাড়াতে আন্তর্জাতিক চর্চা অনুযায়ী নতুন পথের সন্ধান করতে হবে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আর্থিক স্থিতিশীলতা ও আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য মূলধন বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্বল পরিচালন ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ব্যাংক খাতে ঝুঁকি বেড়ে গেছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসছে। আগে যে ভুল হয়েছে, তা শোধরাতে হবে। এ জন্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় খুবই জরুরি। তবে সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাসান ও. রশিদ বলেন, ব্যাংকের শেয়ারধারণে ২ শতাংশ কোনো ইস্যু নয়। সমস্যা হলো সুশাসন ছিল না। একটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবার থেকে একজনের বেশি পরিচালক না দিলেই হয়। খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনি কাঠামো শক্তিশালী করা দরকার। ব্যাংকের মূলধন বাড়াতে আর বন্ড নয়, শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলতে হবে। এ জন্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোকে এক টেবিলে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।

আল–আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ বলেন, নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মধ্যে যে শীতল যুদ্ধ চলে, তার অবসান হওয়া দরকার। এনআই অ্যাক্টে মামলা হলে শুনানির তারিখ পেতে এক বছর পর্যন্ত সময় লেগে যাচ্ছে। এতে খেলাপি ঋণ আদায়ে সমস্যা হচ্ছে। ব্যাংকের মূলধনে বাড়াতে দেশের পাশাপাশি বিদেশি তহবিলের দিকেও নজর দিতে হবে। বিদেশ থেকে এখনো কম খরচে তহবিল পাওয়া সম্ভব। এ জন্য সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে।

সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আগে অনেক ভালো নিয়মকানুন ছিল। আমরা ধীরে ধীরে তা থেকে সরে এসেছি। সুদের হারে ৬/৯–এর মতো তত্ত্ব চালু করে আমরা সারা বিশ্বকে শিখিয়েছি। এর প্রতিদান এখন আমরা পাচ্ছি। এ জন্য আন্তর্জাতিক চর্চা মেনে চলতে হবে। যেসব ব্যাংকে মূলধন জোগান দিয়েও ঠিক করা যাবে না, সেগুলোতে টাকা ঢালা ঠিক হবে না। যেসব ব্যাংক ঠিক হওয়া সম্ভব সেগুলোর এবং ভালো ব্যাংকগুলোর মূলধন বাড়াতে হবে।’ নিয়ন্ত্রক সংস্থার বাধার কারণ দেশে নতুন আর্থিক পণ্য চালু করা যায় না বলে জানান তিনি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, মূলধন বাড়াতে সরকারের গ্যারান্টি–নির্ভর বন্ড চালু করতে হবে। তবে দেশের মানুষের বন্ডে বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা ভালো না। ১৯৯৫ সালে চালু হওয়া বন্ডের টাকা এখনো ফেরত পাওয়া যায়নি। ব্যাংকগুলোর বন্ড এখন ক্লাব নির্ভর হয়ে গেছে। এক ব্যাংকের বন্ড অন্য ব্যাংক কিনছে। বন্ডে বিনিয়োগে ৩০ শতাংশ উদ্যোক্তাদের কিনতে বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

হোদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানির সিনিয়র পার্টনার এ এফ নেছারউদ্দিন বলেন, ব্যাংক খাতে এই দুরবস্থার জন্য প্রধানত দায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক একীভূতকরণই যথেষ্ট নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হওয়াটা নিশ্চিত করতে সময়োপযোগী সংস্কার, স্বচ্ছ প্রতিবেদন প্রকাশ, স্বতন্ত্র মূল্যায়ন এবং একটি বিশ্বাসযোগ্য মূলধন পুনর্গঠন কাঠামো দরকার।

সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের ব্যবস্থাপনা অংশীদার সৈয়দ আফজাল হাসান উদ্দিন বলেন, ধীর আইনি প্রক্রিয়া বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন করছে। খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার এবং বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থায় বিনিয়োগকারীদের শক্তিশালী আস্থা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকরী বাণিজ্যিক আদালত দরকার। যারা অর্থ তছরুপ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলা দেওয়া হচ্ছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও খেলাপির মামলা দিয়ে শেয়ার বাজেয়াপ্ত করলে কিছুটা ফলাফল পাওয়া যেত।

সম্পর্কিত নিবন্ধ