হামলার পর কাশ্মীরে ভারত সরকার যেভাবে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে
Published: 6th, May 2025 GMT
কাশ্মীরের পেহেলগামের সবুজ উপত্যকায় যখন পর্যটকদের ওপর রক্তাক্ত হামলার খবর ছড়ায়, তখন আহমদের মনে হয়েছিল, বমি আসছে। ২৫ জন পর্যটক ও ১ জন গাইডকে গুলি করে হত্যার খবর তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না।
এই অঞ্চলে এমন রক্তপাত ও নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু সেই হত্যাকাণ্ড নিয়ে হৃদয়বিদারক সব কাহিনি সামনে আসতে থাকে। নবদম্পতির মৃত্যু, ধর্ম দেখে আলাদা করে হত্যা.
পরদিনই পুলিশ আহমেদকে ডেকে পাঠায়। আহমেদ জানতেন যে না গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তাই থানায় হাজির হলেন তিনি। হামলাকারীদের কারোর সঙ্গে তাঁর কোনো রকম পরিচয় ছিল না। ঘটনাস্থল থেকে তিনি থাকেন প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে। তবু তাঁকে চার দিন আটকে রাখা হয়। ‘আটকে রাখার কোনো কারণও বলা হয়নি’, জানান আহমেদ।
‘পুলিশ আমার ফোন নিয়ে নেয়, সব খুঁটিয়ে দেখে। আমাকে জঙ্গিদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ওদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই, আমি কিছুই জানি না বললে ওরা আমাকে চড় মারে, লাঠি দিয়ে পেটায়।’
গত সপ্তাহজুড়ে হামলাকারীদের খোঁজে বিশাল অভিযান চালাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। এই অভিযানে প্রায় দুই হাজার মানুষকে আটক করা হয়েছে। অনেককেই রাতে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। তবু কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রয়োগ করে তাঁদের আটকে রাখা হয়েছে।
পেহেলগামের হামলাটি ছিল গত এক দশকে ভারতে বেসামরিক মানুষের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা। হামলাকারীরা এখনো ধরা না পড়ায় কর্তৃপক্ষ আরও কঠোর হয়ে উঠেছে।
গত এক সপ্তাহে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে দুজন নিহত হয়েছেন। আবারও কাশ্মীরের মানুষ নব্বইয়ের দশকের সহিংস বিদ্রোহ ও তৎকালীন সরকারের নির্মম দমননীতির ভীতিকর স্মৃতির মুখোমুখি হয়েছেন। যদিও ভারত সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আহমেদ বলেন, এখন তাঁদের জীবন ‘নরক’ হয়ে উঠেছে। ‘আমরা এমন অপরাধের শাস্তি পাচ্ছি, যা আমরা করিনি। প্রকৃত দোষীদের ধরুক, আমিও তা–ই চাই। কিন্তু নিরপরাধ ব্যক্তিদের শাস্তি দিয়ে ওরা কাশ্মীরিদেরই বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। আমি কাশ্মীর ছাড়তে চাই। কিন্তু ভারতের অন্যত্রও তো আমরা নিরাপদ নই। ওখানেও আমাদের টার্গেট করা হয়।’
কাশ্মীরের আরেক বাসিন্দা সুমাইয়া জান। নিজের আসল নাম তিনি প্রকাশ করতে চাননি নিরাপত্তার জন্য। তিনি বলেন, হামলার কয়েক দিন পর পুলিশ ও সেনারা তাঁদের বাড়িতে হানা দেয়, কোনো পরোয়ানা ছাড়াই।
সুমাইয়ার বাবা একজন কৃষক। কারও সাতপাঁচে থাকেন না তিনি। জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগের তো প্রশ্নই ওঠে না। তাঁকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ‘ওরা আমাদের ঘরের সবকিছু ওলট–পালট করে ফেলল। ঘরের ভেতর তছনছ করেও কিছু পেল না। তবু বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। আমাদের দেখা করতে দিচ্ছে না। কোনো স্পষ্ট অভিযোগও জানাচ্ছে না’, বললেন সুমাইয়া।
ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বসবাসকারী কাশ্মীরিদের ওপর হামলা হয়েছে। তাঁদের হত্যা করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অনেক কাশ্মীরিকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। চাকরি হারিয়েছেন অনেক কাশ্মীরি।দুজন পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে প্রায় দুই হাজার মানুষকে আটক করা হয়েছে। তাঁদের ভাষায়, তাঁদের অনেকেই আগে জঙ্গিবাদে কিংবা ‘দেশবিরোধী’ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অধিকাংশকেই পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’
সবচেয়ে বিতর্কিত পদক্ষেপগুলোর একটি হলো, অভিযুক্ত জঙ্গিদের পরিবারের বাড়ি বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া। এমনও দেখা গেছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি বহু বছর ধরেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। তবু কোনো এককালে তিনি বাড়িতে বাস করতেন, সেই বাড়ি বোমা মেরে ধ্বংস করে দিচ্ছে সরকারি বাহিনী।
চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য বের হয়েছিলেন ছেলে। সাত বছর আগে। সেই সময় ছেলেকে বিদায় জানিয়েছিলেন শাহজাদা বানু। এখন তাঁর ছবি দেখা যাচ্ছে পেহেলগাম হামলার সন্দেহভাজন হিসেবে। দুই দিন পর মাঝরাতে পুলিশ ও সেনারা এসে পুরো পরিবারকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। বলেন, ‘১০০ মিটারের মধ্যে কেউ থাকবে না।’ এরপর তাঁদের বাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
কোনো সতর্কবার্তা বা আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই এই ঘরবাড়ি ধ্বংসের ঘটনায় বানু ভেঙে পড়েছেন। পরদিনই তাঁর স্বামী, অন্য দুই ছেলে এবং দুই আত্মীয়কে আটক করা হয়। ওঁদের কেউ এখনো ফেরেননি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি হামলাকারীদের পক্ষ নিচ্ছি না। এমনকি আমার ছেলের পক্ষও না। সে দোষী হলে শাস্তি পাক। কিন্তু আমরা কেন ভুগছি? আমাদের বাড়ি ছিল একমাত্র সম্বল। এখন কোথায় যাব, কে খাওয়াবে আমাদের?’
গত সপ্তাহে এমন প্রায় ১০টি বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। যদিও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আগেই এমন পদক্ষেপকে অবৈধ বলেছে। বিস্ফোরণের কারণে আশপাশের অনেক বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৭০ বছরের বৃদ্ধ সারওয়া বেগমকে পুলিশ কাঁধে করে বের করে আনে। কারণ, তাঁর পাশের বাড়িতে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
সারওয়া বেগমের অনুভূতি, ‘ওরা নিশ্চয়ই আমাদের কষ্ট দেখে আনন্দ পায়। না হলে এভাবে ঘরবাড়ি উড়িয়ে দেওয়ার মানে কী?’
আঞ্চলিক নেতাদের প্রতিবাদের মুখে কর্তৃপক্ষ বাড়ি ধ্বংসের কাজ আপাতত বন্ধ করেছে; কিন্তু গ্রেপ্তার ও তল্লাশি অব্যাহত আছে।
১৯৪৭ সালের পর থেকেই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ চলছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই অঞ্চলের মালিকানা দুই দেশই দাবি করে। এর নিয়ন্ত্রণ ঘিরে তিনটি যুদ্ধও হয়েছে। ১৯৯০–এর দশক থেকে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে বিদ্রোহ চলছে। ভারত একে পাকিস্তান দ্বারা মদদপুষ্ট বলে দাবি করে। বর্তমানে কাশ্মীরে প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় সেনা মোতায়েন রয়েছে। কাশ্মীর বিশ্বের অন্যতম সামরিকীকরণ এলাকা।
২০১৯ সালে বিজেপি সরকার কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন ও রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেয়। ভিন্নমত দমন করতে শুরু করে। এর পর থেকেই সরকার কাশ্মীরকে একটি শান্তিপূর্ণ পর্যটনস্থল হিসেবে তুলে ধরছিল। সরকারের প্রচারণা দেখে মনে হচ্ছিল, যেন বিদ্রোহ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে। এই ‘স্বাভাবিকতা’র প্রচারণা পেহেলগাম হামলায় ভেঙে পড়ে।
কাশ্মীরের বিজেপি নেতা ও সাবেক উপমুখ্যমন্ত্রী কভিন্দর গুপ্ত বলেন, ‘পাকিস্তানের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে যারা ভারতের ভেতর কাজ করছে, তাদের রেহাই দেওয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পেহেলগামে কাশ্মীরি গাইড ও ঘোড়াচালকেরা হামলায় আহত ভারতীয় পর্যটকদের উদ্ধার করতে সাহায্য করেছেন। হামলার পর অনেক কাশ্মীরি মোমবাতি মিছিল করে এর নিন্দা জানান। তবু সারা ভারতে কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে।
হামলার পর হিন্দু কট্টরপন্থী মিডিয়া ও গোষ্ঠীগুলো প্রতিশোধের ডাক দেয়। কেউ কেউ দাবি করে, ইসরায়েল যেভাবে হামাসকে দমন করেছে, ভারতেরও কাশ্মীরকে গাজা বানিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।
ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বসবাসকারী কাশ্মীরিদের ওপর হামলা হয়েছে। তাঁদের হত্যা করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অনেক কাশ্মীরিকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। চাকরি হারিয়েছেন অনেক কাশ্মীরি।
এমনই এক সময় নিহতদের একজনের স্ত্রী হিমাংশী নারওয়াল আহ্বান জানালেন, যেন তাঁর স্বামীর মৃত্যুকে ঘৃণা ছড়ানোর কাজে ব্যবহার না করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই না, কেউ মুসলিম বা কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে যাক। আমরা শুধু শান্তি চাই, শুধু শান্তি।’
আকাশ হাসান ভারতীয় সাংবাদিক
হান্না এলিস-পেটারসন গার্ডিয়ানের দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অন ক ক শ ম র ব র কর আম দ র ল র পর র অন ক র ওপর আহম দ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
নওগাঁয় পিকআপ-ভটভটি সংঘর্ষে নিহত ১
নওগাঁর পত্নীতলায় পিকআপ ও ভটভটির মুখোমুখি সংঘর্ষে মো. জসিম (৩৭) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আজ শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে নজিপুর-বদলগাছী আঞ্চলিক সড়কের খিরসিন এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। বৃষ্টির মধ্যে এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত দুইজন।
নিহত জসিম নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলার চিচিড়কান্দা গ্রামের বাসিন্দা এবং পেশায় একজন পিকআপ চালক ছিলেন।
পত্নীতলা থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সকালে বৃষ্টির মধ্যে নজিপুরগামী একটি পিকআপ ভ্যান ও বিপরীত দিক থেকে আসা বদলগাছীগামী একটি ভটভটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান পিকআপ চালক জসিম। আহত হন ভটভটির চালক ও হেলপার। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে পত্নীতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন।
পত্নীতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ মোহাম্মদ এনায়েতুর রহমান বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহতের মরদেহ উদ্ধার করে। নিহতের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আইনগত প্রক্রিয়া শেষে মরদেহ হস্তান্তরের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।