কুমিল্লা আদর্শ সদরের প্রত্যন্ত গ্রাম পিয়ারাতলীর নারী কাজল আক্তার। পড়াশোনা খুব বেশি দূর না, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। তবে এর মধ্যেই তিনি দক্ষ শ্রমিক হয়ে গেছেন। নানা যন্ত্রাংশ জুড়ে বানাচ্ছেন মুঠোফোন। এই কাজ করে যে বেতন পান, তা দিয়ে সংসার চলে তাঁর। এতে সংসারের অভাব দূর হয়েছে, এসেছে সচ্ছলতা।

কাজলের মতো গ্রামের এমন অনেক নারীর জীবন বদলে দিয়েছে কুমিল্লার প্রতিষ্ঠান হালিমা গ্রুপ। মুঠোফোনসহ নানা ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরির কারখানা তাদের। কারখানার অবস্থান পিয়ারাতলী গ্রামে। দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠের পাশে ছয়তলা ভবনে এই কারখানা। ভেতরে ঢুকে তলায় তলায় চোখে পড়ে মুঠোফোনসহ নানা ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরির কর্মযজ্ঞ।

হালিমা গ্রুপের মোট সাতটি প্রতিষ্ঠান। এর একটি হালিমা মোবাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে হালিমা ও এইচজি নামের দুটি ব্র্যান্ডের মুঠোফোন তৈরি ও বাজারজাত করা হয়। মুঠোফোন তৈরির কারখানায় ১১২ জন কাজ করেন, এর মধ্যে নারী ৯৭ জন। এই নারী শ্রমিকেরা পিয়ারাতলীসহ আশপাশের গ্রামের। বেশির ভাগই বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হননি। তবে প্রশিক্ষণ পেয়ে দক্ষ শ্রমিক হয়ে উঠেছেন তাঁরা। একটার পর একটা যন্ত্রাংশ জুড়ে দিয়ে প্রতিদিন তাঁরা তৈরি করছেন শত শত পিস মুঠোফোন। বাজারে ৮০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এসব ফিচার (বাটন) মুঠোফোন।

শুরুর কথা

হালিমা গ্রুপের যাত্রা শুরু ২০১০ সালে। প্রত্যন্ত গ্রাম, অদক্ষ শ্রমিক, নানা চ্যালেঞ্জ—এগুলোকে সঙ্গী করে ২০২১ সালে প্রত্যন্ত গ্রামে কারখানা গড়ে তোলেন হালিমা গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল কালাম হাসান (টগর)। শুরুর গল্পটা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি কুমিল্লার সন্তান। সব সময় ইচ্ছা ছিল, আমার প্রতিষ্ঠানগুলো কুমিল্লাতে হবে। এলাকার সাধারণ মানুষ আমার প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন। তবে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, জনশক্তিকে দক্ষ করে তোলা। শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছি। আমাদের গ্রুপে প্রায় ১ হাজার ৫০০ শ্রমিক কাজ করেছেন, যাঁদের প্রায় সবাই স্থানীয় বাসিন্দা। এখানে কর্মসংস্থান না হলে হয়তো তাঁরা বাসাবাড়িতে কাজ করতেন বা বেকার থাকতেন।’

এই শিল্প উদ্যোক্তা বলেন, দেশের বড় জনগোষ্ঠী গ্রামে থাকেন। তাঁদের অনেকের আর্থিক সক্ষমতা খুব ভালো না। স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য তাঁদের নেই। অথচ যোগাযোগের জন্য মুঠোফোন খুবই দরকারি জিনিস। তাঁদের হাতে কম দামে মুঠোফোন তুলে দেওয়ার চিন্তায় তাঁরা কারখানা চালু করেন। দেশের প্রত্যেক মানুষের মুঠোয় থাকবে মুঠোফোন, সেই স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা করেছিলেন বলে জানালেন তিনি। এখন তাঁর স্বপ্ন, গ্রামে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান গড়া। জনশক্তি হিসেবে সেখানে থাকবেন গ্রামেরই সাধারণ নারী-পুরুষ।

সরেজমিনে একদিন

সম্প্রতি পিয়ারাতলীতে মুঠোফোন তৈরির কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, নিজ নিজ আসনে বসে কাজ করছেন শ্রমিকেরা। দক্ষতার সঙ্গে এলসিডি, লেন্স, লেবেল লাগাচ্ছেন। একজন শ্রমিকের নির্দিষ্ট অংশের কাজ শেষ হলে মুঠোফোনের যন্ত্রাংশ পরের ধাপের জন্য কনভেয়ার বেল্টে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এতে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে নিজ আসনে বসেই কনভেয়ার বেল্ট থেকে নামিয়ে নিজের নির্দিষ্ট অংশের কাজ করছেন আরেক শ্রমিক। শুরু থেকে প্রায় সব কাজ সম্পন্ন হচ্ছে নারীদের হাতের ছোঁয়ায়। হোক সেটা মেমোরি কার্ড ও সিম লাগিয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষার কাজ কিংবা কম্পিউটারের সাহায্য বাটন ফোনের প্রোগ্রাম ইনস্টল ও নেটওয়ার্ক পরীক্ষা। এমন অন্তত ২০টি ধাপ শেষে তৈরি হওয়া মুঠোফোন চার্জারসহ বাক্সে ভরা হয়। আর এভাবেই বাজারে বিক্রির জন্য প্রস্তুত হয় হালিমা গ্রুপের বাটন ফোন।

কাজল আক্তার নামের নারী শ্রমিক বলেন, ‘টেকনিক্যাল বিষয়ে পড়াশোনা করিনি। কিন্তু আমি এখন দক্ষ শ্রমিক। আমার হাত দিয়েই প্রতিদিন শত শত মুঠোফোন তৈরি হয়। আমার বাড়ি পাশের গ্রামে। দুপুরে হেঁটে বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসি। এখানে কাজ করে আমরা মজা পাচ্ছি। নিজের পরিবারে আর অভাব নাই।’

কারখানাটির উৎপাদন ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বিদেশ থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি করেন। এরপর সেগুলো এখানে যুক্ত করা হয়। তাঁদের কারখানায় প্রতিদিন পাঁচ হাজার হিসাবে মাসে দেড় লাখ মুঠোফোন তৈরির সক্ষমতা আছে। এখন তাঁরা মাসে গড়ে ২৫ হাজার মুঠোফোন উৎপাদন করেন। সামনে চাহিদার সঙ্গে উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে তাঁদের।

এই প্রতিষ্ঠানে এসে ‘নতুন অভিজ্ঞতা’ হয়েছে জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, এখানে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত নারীরা কাজ করছেন। প্রথমে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দক্ষ করে গড়ে তুলে কাজে যুক্ত করা হয়। মানের কারণে বাজারে তাঁদের পণ্যের সুনাম আছে।

জীবনে বদল

হালিমা গ্রুপের অধীনে থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো হালিমা টেলিকম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এইচটিই, টিপ অ্যাকসেসরিস, এইচজি, হালিমা ইলেকট্রনিকস ও হালিমা হোম অ্যাপ্লায়েন্স। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মুঠোফোনের চার্জার, ব্যাটারি, হেডফোন, পাওয়ার ব্যাংক, ডেটা কেব্‌ল, এয়ার বাডস, এয়ার ফোন, নেক ব্যান্ড, স্মার্ট ওয়াচ, স্পিকার এলইডি লাইট, সুইচ, ব্যাক লাইট, এলইডি টিউব, রিচার্জেবল ফ্যান, এগজস্ট ফ্যান, কুকার, সিঙ্গেল ও ডাবল বার্নার গ্যাস স্টোভ, ইলেকট্রিক ব্যাট, ইলেকট্রিক আয়রন ও ইলেকট্রিক কেটলি উৎপাদন ও বাজারজাত করা হয়।

হালিমা গ্রুপের মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক রূপম কান্তি দাশ বলেন, পিয়ারাতলীর ছয়তলা ভবনে মুঠোফোনের পাশাপাশি তাঁদের হালিমা গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরি হয়। মোট শ্রমিকের ৮০ শতাংশের বেশি নারী।

এখানে কাজের সুবাদে বদলে গেছে নারীদের জীবন। সুরাইয়া আক্তার নামের এক শ্রমিকের কথায়ও সেটা উঠে এল। তিনি বলেন, তাঁর বাড়ি পাশের আমড়াতলী গ্রামে। তিন বছর ধরে তিনি এই কারখানায় কাজ করেন। যা বেতন পান, তা পরিবারের জন্য ব্যয় করেন। এতে তিনি আনন্দিত।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য ক জ কর করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

আবার কুমার নদে বালু উত্তোলন

ফরিদপুরের সালথায় কুমার নদে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে আবারও বালু তোলা হচ্ছে। এতে কোটি টাকার সেতু ঝুঁকিতে পড়েছে। নদের পাড় ভেঙে পড়ার শঙ্কাও করছেন স্থানীয়রা।
উপজেলার যদুনন্দী ইউনিয়নের খারদিয়া মিয়াপাড়া এলাকায় কুমার নদের ওপর নতুন সেতুর নিচ থেকে এই বালু তোলা হচ্ছে। নিজ নির্বাচনী এলাকা সালথায় কুমার নদ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের প্রতিবাদে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ইসলাম রিংকু। গত ২৬ এপ্রিল উপজেলার গট্টি ইউনিয়নের বড়দিয়া বাজারে আয়োজিত সমাবেশে তাঁর দেওয়া এ হুঁশিয়ারিকে উপেক্ষা করে ফের কুমার নদ থেকে বালু তুলছে একটি প্রভাবশালী মহল। 
গতকাল শনিবার দুপুরে যদুনন্দী ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, খারদিয়া নতুন সেতুসংলগ্ন কুমার নদের দক্ষিণ তীরে নাছির হোসেন নামে ড্রেজার ব্যবসায়ী অবাধে বালু তুলছেন। তিনি জানান, কথিত এক সাংবাদিকের মাধ্যমে পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বালু তোলা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, প্রভাবশালী চক্র এ নদের বিভিন্ন অংশে ড্রেজার বসিয়ে গভীর গর্ত করে বালু তুলছে। এতে নদের তলদেশ নিচু হয়ে যাচ্ছে এবং পানির স্রোতের ধাক্কায় দুই পাড়ের মাটি ধসে পড়ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, বালু উত্তোলনের ফলে নদের ওপর নির্মিত নতুন সেতুর ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, কুমার নদ সালথার প্রাণ। এই নদ যদি ভেঙে পড়ে, তাহলে কেবল একটি সেতু নয়, পুরো অঞ্চল পরিবেশগত ও অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পড়বে। এ বিষয়ে প্রশাসনের কাছে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান তারা।
সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বালী বলেন, বিষয়টি সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পারলেন। কুমার নদ থেকে বালু তোলা বন্ধে যত দ্রুত সম্ভব অভিযান পরিচালনা করা হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ