ভেসে আসা কান ফাটানো হিন্দি গানের শব্দ, জনাকীর্ণ ওয়াচ টাওয়ার—এসব টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশে খুবই অস্বাভাবিক। এখন আপনি টাঙ্গুয়ার হাওরে কোনো জলজ পাখি দেখবেন না। পানকৌড়ি, কানি বক নেই। নেই মৌনি মাছরাঙা। শকুন, বেগুনি কালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, সারস, কাক, শঙ্খচিল, পাতি কুট ইত্যাদি নামের পাখিগুলো একসময় টাঙ্গুয়ার হাওরে যে দেখা যেত, তা মানুষ ভুলে গেছে। সারা বছরের অধিবাসী সাধারণ পাখিগুলোও দেখা যায় না আর। করচের বনের পোকারাও মনে হয় শঙ্কিত হয়ে পালিয়েছে।

সামান্য কিছু জীববৈচিত্র্য হয়তো অনেক সংগ্রামে এই অঞ্চলে টিকে আছে পর্যটন নামের পরিবেশবিধ্বংসী বোমার সঙ্গে লড়াই করে। এই জীববৈচিত্র্যও একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে, যদি না কোনো ত্রাতা এসে আশা বা স্বপ্ন দেখান। অথচ এই অবারিত জলরাশি, মেঘালয়ের কোলে প্রকৃতির জলের সংসার, যেখানে চাইলেই জলের সঙ্গে মিশে যেতে পারবেন, নৌকার খোলে জলের মোলায়েম আছড়ে পড়ার শব্দ শুনতে পারবেন, দেখতে পারতেন পাহাড়ের আড়ালে অস্তায়মান সূর্যের মৃদু আলোয় পাখিদের দীর্ঘ বাড়িফেরা, অর্জুন চোখের শঙ্খচিল। প্রকৃতি আর আমাদের মধ্যে রয়েছে অদৃশ্য এক নাড়ির বন্ধন, যার মাধ্যমে আমি–আপনি সবাই মানসিক পুষ্টি পেতে পারি।

তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, সঠিক নীতি ও মানুষকেন্দ্রিক উদ্যোগে এমন বিপন্ন অঞ্চলও রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। আমেরিকান ন্যাশনাল পার্ক ভাবনার জনক জন মুর। তিনি প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে একাধিক ন্যাশনাল পার্ক প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতির মাঝে ভ্রমণে আপনি যতটা অন্বেষণ করবেন, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি পাবেন।

টাঙ্গুয়ার হাওরের মতো অনন্য পরিবেশও শুধু সম্পদের উৎস নয়। এই জলজ পরিবেশের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য রয়েছে, মরমী গুরুত্ব রয়েছে। মরমী এই সম্পর্ক উপলব্ধি করা যায় ভাটি অঞ্চলের অসংখ্য বাউলগানে, জীবনচর্চায়।

এই অঞ্চলে পর্যটনে যাঁরা আসেন, তাঁরা এই পর্যটন ব্যয় নির্বাহ করতে পারেন। অনেকাংশে তাঁরা শিক্ষিত; কিন্তু তাঁদের পর্যটনে এই অঞ্চলের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য আর আধ্যাত্মিকতার প্রতি ভালোবাসা অনুপস্থিত। তাঁদের লাস ভেগাসীয় পর্যটন এ অঞ্চলের পরিবেশের প্রতি মারাত্মক হুমকি।

জেলা প্রশাসন সুনামগঞ্জ টাঙ্গুয়ার হাওরের জন্য এই বিরূপ পর্যটনকে নিয়ন্ত্রিত ও নিরুৎসাহিত করতে অনেক দিন ধরেই কাজ করছে। যাঁরা এই পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাঁদের মোটামুটি সবাই জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগের সঙ্গে পরিচিত। একটি বড় অংশ এই উদ্যোগকে সমর্থন জানায়। কিন্তু লাস ভেগাসীয় পর্যটন নিরুৎসাহিত করতে যে শক্তি দরকার, তা জেলা প্রশাসন বিভিন্ন কারণে প্রয়োগ করতে পারে না।

টাঙ্গুয়ার হাওর নিয়ে কথা বলতে গেলে কৃষকের সেই সোনার ডিমপাড়া হাঁসের গল্পের কথা মনে পড়ে। আমরা সেই চালাক কৃষকের মতো সব সোনার ডিম একসঙ্গে পাওয়ার চেষ্টা করছি। অন্য একটি চ্যালেঞ্জ কিন্তু টাঙ্গুয়ার হাওরে আছে। সবাই ভাবছেন পরিবেশ রক্ষায় ব্যবস্থা অন্য কেউ নেবেন, তিনি কেন গাঁটের পয়সা খরচ করবেন?

ঐতিহ্যগতভাবে এই অঞ্চল ধান, মাছ ও জাদুকাটা, মহালিয়া, মাহারামের বালুমহাল এবং এসব প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা জীবিকার জন্য পরিচিত। এর বাইরে কোনো নতুন জীবিকা গড়ে ওঠেনি। শিক্ষার বিভিন্ন সূচকেও এই জেলা দেশের তলানির দিকের একটি জেলা। নিয়মিত গুণগত স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তি এই জেলার অনেক মানুষের জন্য স্বপ্ন। এ কারণে সেবা খাতেও উল্লেখযোগ্য কোনো জীবিকা গড়ে ওঠেনি।

তবে টাঙ্গুয়ার হাওরকেন্দ্রিক পর্যটন এ অঞ্চলের জীবন ও জীবিকা বদলে দিতে পারে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। তারুণ্যের উৎসবে জেলা প্রশাসন, সুনামগঞ্জ ‘সেরা বাউল ২০২৫’ অন্বেষণ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। যার মধ্য দিয়ে স্বল্প সময়ে অপরিচিত একঝাঁক সম্ভাবনাময় বাউলশিল্পী পরিচিতি পেয়েছেন। জেলা প্রশাসন থেকে নেওয়া এই উদ্যোগ উচ্চ শব্দের গানের জায়গায় হাউসবোটগুলোয় বাউলদের মৌসুমভিত্তিক চুক্তিতে গান গাওয়ার সুযোগ করে দেয়।

ফলে বাউলদের জীবিকার নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব হবে। উপজেলা প্রশাসন তাহিরপুরকে সম্পূর্ণ পরিবেশসম্মত ও সব ধরনের অবৈধ পদার্থমুক্ত একটি ভাসমান বাজার সৃষ্টির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যেখানে স্থানীয়ভাবে পালিত হাঁস, মুরগি, ডিম ও মাছ বাজারজাত করা হবে। এর মাধ্যমে স্থানীয় পণ্যের ভালো একটি চাহিদা তৈরি হবে, যা স্থানীয় আর্থসামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাবে।

মনুষ্যসৃষ্ট জৈব বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসন ভাবনাগত পরিবর্তন আনতে ইতিমধ্যে একাধিক সেমিনার আয়োজন করেছে, যাতে হাউসবোট মালিকদের একটি বড় অংশ উপস্থিত ছিল। হাউসবোটগুলো মনুষ্যসৃষ্ট জৈব বর্জ্য সরাসরি পানিতে ফেলে। ফলে তা মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি অস্বাভাবিক বাস্তুসংস্থান সৃষ্টি করে, যা কারও জন্যই স্বাস্থ্যকর নয়।

জেলা প্রশাসন থেকে এ বিষয়ে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় যেন হাউসবোটের ডিজাইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ডিপোজিটর তৈরি করা যায়। পরবর্তী সময় সেখান থেকে পাম্প করে বাইরে কোনো একটি সেপটিক ট্যাংকে এই বর্জ্য স্থায়ীভাবে মজুত করা যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনেকেই হাউসবোটের খোলের আকৃতির ভিন্নতাকে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন, যা এ ধরনের ট্যাংকের বাণিজ্যিক উৎপাদনে বড় বাধা। প্রাকৃতিক গ্যাস, জৈব সার তৈরি ও অন্যান্য ব্যবহারে এই বর্জ্য ব্যবহার সম্ভব।

কোমল পানীয়, চিপস ও অন্যান্য প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্য এ অঞ্চলে প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রাচুর্যের প্রধান উৎস। হাউসবোটগুলোকে এ ধরনের খাদ্য ও পানীয় নিরুৎসাহিত করতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। তারা জানিয়েছ, এটা করা সম্ভব। কিন্তু যেসব নৌকার বিনিয়োগ কম, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা বেশ বড় একটি চ্যালেঞ্জ।

টাঙ্গুয়ার হাওর নিয়ে কথা বলতে গেলে কৃষকের সেই সোনার ডিমপাড়া হাঁসের গল্পের কথা মনে পড়ে। আমরা সেই চালাক কৃষকের মতো সব সোনার ডিম একসঙ্গে পাওয়ার চেষ্টা করছি। অন্য একটি চ্যালেঞ্জ কিন্তু টাঙ্গুয়ার হাওরে আছে। সবাই ভাবছেন পরিবেশ রক্ষায় ব্যবস্থা অন্য কেউ নেবেন, তিনি কেন গাঁটের পয়সা খরচ করবেন? এ ধরনের চিন্তা মারাত্মক ফল বয়ে আনতে পারে। সবার সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া হলেই শুধু একটি মারাত্মক পরিণতি এড়ানো সম্ভব।

মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া জেলা প্রশাসক, সুনামগঞ্জ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ট ঙ গ য় র হ ওর পর ব শ র হ উসব ট পর চ ত বর জ য র জন য প রক ত ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

৪৪তম বিসিএসের ৪০০ রিপিট ক্যাডার বাদ দিচ্ছে সরকার, নতুন সিদ্ধান্ত আসছে

৪৪তম বিসিএসে পুনরাবৃত্তি হওয়া ৪০০ ক্যাডারকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। তারা ৪৩তম বিসিএসে বা আগের বিসিএসে যে ক্যাডারে আছেন ৪৪তম বিসিএসেও একই ক্যাডার পেয়েছিলেন। এই ৪০০ ক্যাডারকে নিয়ে সিদ্ধান্ত দ্রুতই হবে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা।

প্রথম আলোকে ওই কর্মকর্তা আজ বৃহস্পতিবার বলেন, ৪০০ ক্যাডারকে নিয়ে পিএসসির কিছু সুপারিশ আমরা পেয়েছি। এগুলো বাদ দিতে সরকার কাজ করছে। বাদ দিলে কি করা হবে তা নিয়েও কাজ করছে সরকার। এখন পিএসসিকে এ বিষয় নিয়ে একটি মতামত দিতে বলা হয়েছে। পেলেই তা পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে প্রজ্জাপন দেওয়া হবে। এটি যাতে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয় সেজন্য আমরা কাজ করছি।

আরও পড়ুন৪৯তম বিসিএস: অনলাইন আবেদন ও ফি জমাদানে পিএসসির নতুন নির্দেশনা৩০ জুলাই ২০২৫

৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল ৩০ জুন প্রকাশিত হয়। এতে বিভিন্ন ক্যাডারে ১ হাজার ৬৯০ জনকে নিয়োগের জন্য সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) সাময়িকভাবে মনোনীত করেছে।

প্রকাশিত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১ হাজার ৬৯০ জনের মধ্যে প্রায় ৪০০ জন প্রার্থী একাধিকবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একই ক্যাডারে পুনরায় সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন (রিপিট ক্যাডার)। এই ৪০০ জনের তালিকা পেয়েছে পিএসসি। এই রিপিট ক্যাডার বন্ধে বিধি সংশোধন করা হচ্ছে। এ–সংক্রান্ত চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় পিএসসি।

পিএসসি জনপ্রশাসনের চিঠিতে বলছে, এই রিপিট ক্যাডারের ফলে নতুন ও অপেক্ষমাণ মেধাবীরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটি প্রশাসনিক কাঠামো ও জনসম্পদের সদ্ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করছে। এখন এটি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

একাধিকবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একই ক্যাডারে পুনরায় সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়া বন্ধ করার জন্য বিদ্যমান বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বয়স, যোগ্যতা ও সরাসরি নিয়োগের জন্য পরীক্ষা) বিধিমালা ২০১৪–এর বিধি-১৭ এর শেষে নিম্নোক্ত শর্ত যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে পিএসসি।

আরও পড়ুনসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের ৩৪০০০ শূন্য পদ পূরণে উদ্যোগ২৯ জুলাই ২০২৫শর্তে কী আছে—

পিএসসির চিঠিতে শর্ত হিসেবে বলা আছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে এই বিধির আওতাধীন সরকারের নিকট সুপারিশ প্রেরণ করিবার প্রাক্কালে, কিংবা কোনো বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল প্রস্তুতকালে, সংশ্লিষ্ট প্রার্থী কর্তৃক প্রদত্ত লিখিত তথ্যের ভিত্তিতে কিংবা কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত কোনো পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে যদি কমিশনের নিকট প্রতীয়মান হয় যে এই বিধির আওতাধীন মনোনয়নযোগ্য কিংবা মনোনীত কোনো প্রার্থী একই ক্যাডার পদ, সমপদ কিংবা প্রার্থীর আগ্রহ নেই এমন কোনো সার্ভিস বা ক্যাডার পদে পুনরায় মনোনীত হইবার কারণে মনোনীত সার্ভিসে বা ক্যাডার পদে যোগদান করিতে অনিচ্ছুক, এইরূপ ক্ষেত্রে কমিশন অনাগ্রহ প্রকাশকারী প্রার্থীকে এই বিধির আওতাধীন সরকারের নিকট সুপারিশ করা হইতে বিরত থাকিতে পারিবে; আরও শর্ত থাকে যে প্রথম শর্তাংশে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী কোনো প্রার্থীকে সুপারিশ করা হইতে বিরত থাকিবার কারণে উদ্ধৃত শূন্য পদে নিয়োগের লক্ষ্যে সুপারিশ প্রেরণ করিবার জন্য উত্তীর্ণ প্রার্থিগণের মধ্য হইতে মেধাক্রম অনুযায়ী প্রার্থী নির্বাচনপূর্বক কমিশন সম্পূরক ফলাফল প্রকাশ এবং সার্ভিসে বা ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য সরকারের নিকট সুপারিশ প্রেরণ করিতে পারিবে;আরও অধিকতর শর্ত থাকে যে দ্বিতীয় শর্তাংশে উল্লিখিত সম্পূরক ফলাফল দ্বারা বা উহার পরিণতিতে প্রথম ঘোষিত ফলাফলে সার্ভিস বা ক্যাডার পদের জন্য মনোনীত কোনো প্রার্থীর প্রতিকূলে কোনো পরিবর্তন ঘটানো কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাইবে না।’

আরও পড়ুনবস্ত্র অধিদপ্তরে বড় নিয়োগ, চাকরির সুযোগ ১৯০ জনের২৯ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ