ভিন্ন পরিবেশে নির্বাচন, সবারই প্রথম অভিজ্ঞতা
Published: 17th, September 2025 GMT
এই ভোটারেরা আগে কখনো ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করেননি। প্রার্থীরও যেতে হয়নি ভোটারের দুয়ারে। আর যাঁরা নির্বাচনটি আয়োজন করবেন, তাঁদেরও কোনো ‘অভিজ্ঞতা’ নেই। অর্থাৎ ভোটার, প্রার্থী ও নির্বাচন কমিশনে যুক্ত সবারই এবার প্রথম অভিজ্ঞতা হবে। কেননা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন হয়নি ৩৫ বছর ধরে।
আগামী ১২ অক্টোবর সপ্তমবারের মতো চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখন ক্যাম্পাসে চলছে নির্বাচনী আলোচনা। ইতিমধ্যে প্রায় ১ হাজার শিক্ষার্থী নির্বাচনে প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র কিনেছেন। প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে তিনটি। এখন ক্যাম্পাসের রেলস্টেশন থেকে বুদ্ধিজীবী চত্বর, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেন—সব খানেই শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি। তাঁদের প্রশ্ন, ভিপি হবেন কে?
ভিপি কে হবেন, তা জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে চাকসুর কাছে প্রত্যাশা কী, এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল ২০ শিক্ষার্থীকে। তাঁরা বলছেন, চাকসু হবে ছাত্ররাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। আগের মতো হানাহানি, সংঘর্ষ তাঁরা চান না। কোনো নির্দিষ্ট সংগঠনের একক আধিপত্যও তাঁরা মেনে নেবেন না। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে যাঁরা কাজ করতে চাইবেন, তাঁরা নির্বাচিত হবেন চাকসুতে। চাকসুর মাধ্যমে শিল্প, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, বিতর্কসহ নানা ধরনের কার্যক্রম চলবে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, আবাসন ও পরিবহন-সংকট, হলে হলে নিম্নমানের খাবার সরবরাহসহ এমন গুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যু উঠে নির্বাচনী আলোচনায় আসবে। যেসব প্রার্থী ও প্যানেল শিক্ষার্থীবান্ধব ইস্যু ইশতেহারে আনবে, তাঁরাই ভোটের মাঠে এগিয়ে যাবে।যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী এখলাস বিন সুলতান কিছুটা ক্ষুব্ধ, আবার আনন্দিতও। হিসাব অনুযায়ী, তাঁর অন্তত চারবার চাকসু নির্বাচনে ভোট দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একবারও দিতে পারেননি। এখলাস বলেন, ‘প্রতিবছর চাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। স্নাতকোত্তর পর্যন্ত অন্তত চারটি নির্বাচনের সাক্ষী হতাম। তবু শেষ সময়ে এসে একটা নির্বাচন অন্তত পাচ্ছি, এতেই আনন্দিত। আশা করব, প্রতিবছর নির্বাচন হবে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৬ সালে। এরপর প্রথম চাকসু নির্বাচন হয় পাকিস্তানের সামরিক সরকারের আমলে, ১৯৭০ সালে। চাকসুতে এখন পর্যন্ত ৬টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনটি হয় ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এরপরে আর নির্বাচন আয়োজন করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মূলত ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে কোন্দল, মুখোমুখি অবস্থান ও সরকারের সদিচ্ছার অভাবে নির্বাচন আয়োজন হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবছর চাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। স্নাতকোত্তর পর্যন্ত অন্তত চারটি নির্বাচনের সাক্ষী হতাম। তবু শেষ সময়ে এসে একটা নির্বাচন অন্তত পাচ্ছি, এতেই আনন্দিত। আশা করব, প্রতিবছর নির্বাচন হবে।এখলাস বিন সুলতান, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা-কর্মীরা নির্বাচনে অংশ নিতে প্যানেল গঠন করেছেন। তাঁদের প্যানেলের নাম ‘দ্রোহ পর্ষদ’। এখান থেকে ভিপি প্রার্থী হয়েছেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ। নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এত বছর নির্বাচনের আয়োজন না করে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। আশা করব, প্রশাসন প্রতিবছরই নির্বাচনের আয়োজন করবে।’
মাস তিনেক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়েছেন জিহাদ আরাফাত। ভর্তি হয়েই চাকসু নির্বাচনের আমেজে উচ্ছ্বসিত তিনি। এমনকি কেন্দ্রীয় সংসদের ভিপি পদে লড়তে মনোনয়নপত্রও কিনেছেন। জিহাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভর্তি হয়েই চাকসু নির্বাচন পেলাম। আমার আগে হাজারো শিক্ষার্থী পাট চুকিয়ে বের হয়েছেন। কারও প্রার্থী বা ভোটার হওয়ারও সুযোগ হয়নি। আমি আসলে ভাগ্যবান।’
যে কারণে ভিন্ন পরিবেশ
এক দশক ধরে ক্যাম্পাসে আধিপত্য ধরে রাখা ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) নেতা-কর্মীরা এখন ক্যাম্পাসে নেই। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। তাঁদের দাপটও শেষ হয়ে যায়। ক্যাম্পাসে একের পর এক সংঘর্ষ, মারামারি, হল দখল, চাঁদাবাজি, নির্মাণকাজ আটকে দেওয়ার মতো ঘটনায় বারবার খবরের শিরোনাম হয়েছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
ছাত্রলীগের ‘চাপে’ ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও বাম সংগঠনগুলো এত দিন কোণঠাসা ছিল। হামলা ও মামলায় ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারেননি। তবে গত বছরের পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে গেছে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তাঁদের বিদায়ের পর ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। ব্যস্ততা বেড়েছে ছাত্রদলেরও। বাম সংগঠনগুলোও বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে ক্যাম্পাসে সরব আছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, আবাসন ও পরিবহন-সংকট, হলে হলে নিম্নমানের খাবার সরবরাহসহ এমন গুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যু উঠে নির্বাচনী আলোচনায় আসবে। যেসব প্রার্থী ও প্যানেল শিক্ষার্থীবান্ধব ইস্যু ইশতেহারে আনবে, তাঁরাই ভোটের মাঠে এগিয়ে যাবে।
ভিন্ন পরিবেশে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে সব ধরনের প্রস্তুতি আছে বলে জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘ সময় পর গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে নির্বাচনী আচরণবিধিও প্রকাশ করা হয়েছে। ভোটার তালিকাও প্রকাশিত হয়েছে। তফসিল অনুযায়ী সব প্রক্রিয়া নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজনের জন্য যা যা করণীয়, সবই পালন করা হবে।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, এবার মোট ভোটার ২৭ হাজার ৬৩৭ জন। গত রোববার থেকে শুরু হয়েছে মনোনয়নপত্র বিতরণ। গতকাল ছিল সংগ্রহের শেষ দিন। এদিন প্রায় ১ হাজার শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় ও হল সংসদের জন্য মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। মনোনয়নপত্র আজ বুধবার পর্যন্ত জমা দেওয়া যাবে। যাচাই-বাছাই হবে ১৮ সেপ্টেম্বর। প্রার্থীর প্রাথমিক তালিকা প্রকাশিত হবে ২১ সেপ্টেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৩ সেপ্টেম্বর। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশিত হবে ২৫ সেপ্টেম্বর।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স প ট ম বর সরক র র হয় ছ ন কর ম র প রক শ প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
মনোনয়ন নেওয়ার শেষ দিনে একটি হলে ছাত্রী সংস্থার প্যানেল
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদের মনোনয়নপত্র নেওয়ার মেয়াদ আজ মঙ্গলবার শেষ হচ্ছে। বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত প্রার্থীরা নির্দিষ্ট ফি দিয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে পারবেন। আজ সকাল থেকে স্বতন্ত্র অনেক প্রার্থী মনোনয়নপত্র নিলেও দুপুর ১২টা পর্যন্ত ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদসহ বড় দলগুলোর বেশির ভাগ প্রার্থী মনোনয়নপত্র নেননি। এসব দলের নেতা-কর্মীরা প্যানেল গুছানো নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এদিকে দিকে আজ দুপুরে ছাত্রীদের আবাসিক প্রীতিলতা হল সংসদ নির্বাচনের জন্য ১২ সদস্যদের প্যানেল ঘোষণা করে মনোনয়নপত্র নিয়েছে ইসলামী ছাত্রী সংস্থা। প্যানেলের নাম দেওয়া হয়েছে—সংঘবদ্ধ ছাত্রী জোট।
আজ সরেজমিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চাকসু ভবনের পাশের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ঝুপড়িতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে প্রার্থী ও প্যানেল নিয়ে আলোচনা করছেন। কোন দলের প্যানেলে কোন প্রার্থী থাকবেন, এসব নিয়েই সবার আগ্রহ। তবে দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্যানেল সম্পর্কে বিস্তারিত জানায়নি ছাত্রশিবির, ছাত্রদল, গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ।
জানতে চাইলে শাখা ছাত্রশিবিরের প্রচার সম্পাদক ইসহাক ভূঞা দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এখন পর্যন্ত একক প্যানেল করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে শিবির–সমর্থিত শিক্ষার্থী জোট হিসেবে প্যানেলটা হতে পারে। আজই কেন্দ্রীয় সংসদ ও হল সংসদের সব কটির পদের জন্য ফরম নেব। প্যানেলের নাম এবং কে কোন পদে লড়বেন, এটা পরে জানানো হবে।’
অন্যদিকে ছাত্রদলও একক প্যানেল দেওয়ার কথা ভাবছে বলে জানিয়েছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। এ দল থেকে ভিপি (সহসভাপতি) পদে জালাল উদ্দিন মেসবাহর নাম আলোচনায় রয়েছে। তিনি শাখা ছাত্রদলের সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ আমরা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করব। আজকের মধ্যে প্যানেলের নাম ঠিক করা হবে। নাম ঠিক করার পরই একক প্যানেল দেওয়া হবে, নাকি জোট করা হবে, তা জানানো হবে।’
অবশ্য গতকাল সোমবার দুপুরে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের একাংশ মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছে। দলটি থেকে কেন্দ্রীয় সংসদে লড়তে ১২ জন ও হল সংসদে ১৫ জন মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। তবে তাঁরা কে কোন পদে লড়বেন, তা উল্লেখ করা হয়নি।
অন্যদিকে বাম ধারার পাঁচটি সংগঠনের গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটও আলাদা প্যানেল দেবে বলে জানান গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলর সংগঠক ধ্রুব বড়ুয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আজ ৫০টি পদের জন্য ফরম নেব। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদে ২৬টি ও হল সংসদে ২৪টি পদের জন্য ফরম নেওয়া হবে। বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।’
বেলা সাড়ে তিনটার মধ্যেই কেন্দ্রীয় পদের জন্য মনোনয়ন দেবে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ। সংগঠনটির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার মুখ্য সংগঠক সাব্বির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরাও প্যানেল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে কে কোন পদে লড়বেন, সেটা মনোনয়ন ফরম নেওয়ার সময় তাঁরা জানাবেন।
ইসলামী আন্দোলন–সমর্থিত ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র আন্দোলনও আলাদা প্যানেল দিচ্ছে। তাঁদের প্যানেলের নাম ‘সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ’। তাঁরা এখন পর্যন্ত ১৮টি পদে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। এ প্যানেল থেকে ভিপি পদে লড়বেন ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী ও সংগঠনটির শাখা সভাপতি আবদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নারী শিক্ষার্থী ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করা হবে।
প্রার্থীদের পরিচয় যাচাই করে মনোনয়নপত্র দিচ্ছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। আজ বেলা ১২টায় কমিশনের কার্যালয়ে