এই ভোটারেরা আগে কখনো ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করেননি। প্রার্থীরও যেতে হয়নি ভোটারের দুয়ারে। আর যাঁরা নির্বাচনটি আয়োজন করবেন, তাঁদেরও কোনো ‘অভিজ্ঞতা’ নেই। অর্থাৎ ভোটার, প্রার্থী ও নির্বাচন কমিশনে যুক্ত সবারই এবার প্রথম অভিজ্ঞতা হবে। কেননা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন হয়নি ৩৫ বছর ধরে।

আগামী ১২ অক্টোবর সপ্তমবারের মতো চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখন ক্যাম্পাসে চলছে নির্বাচনী আলোচনা। ইতিমধ্যে প্রায় ১ হাজার শিক্ষার্থী নির্বাচনে প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র কিনেছেন। প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে তিনটি। এখন ক্যাম্পাসের রেলস্টেশন থেকে বুদ্ধিজীবী চত্বর, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেন—সব খানেই শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি। তাঁদের প্রশ্ন, ভিপি হবেন কে?

ভিপি কে হবেন, তা জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে চাকসুর কাছে প্রত্যাশা কী, এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল ২০ শিক্ষার্থীকে। তাঁরা বলছেন, চাকসু হবে ছাত্ররাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। আগের মতো হানাহানি, সংঘর্ষ তাঁরা চান না​। কোনো নির্দিষ্ট সংগঠনের একক আধিপত্যও তাঁরা মেনে নেবেন না। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে যাঁরা কাজ করতে চাইবেন, তাঁরা নির্বাচিত হবেন চাকসুতে। চাকসুর মাধ্যমে শিল্প, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, বিতর্কসহ নানা ধরনের কার্যক্রম চলবে।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, আবাসন ও পরিবহন-সংকট, হলে হলে নিম্নমানের খাবার সরবরাহসহ এমন গুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যু উঠে নির্বাচনী আলোচনায় আসবে। যেসব প্রার্থী ও প্যানেল শিক্ষার্থীবান্ধব ইস্যু ইশতেহারে আনবে, তাঁরাই ভোটের মাঠে এগিয়ে যাবে।

যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী এখলাস বিন সুলতান কিছুটা ক্ষুব্ধ, আবার আনন্দিতও। হিসাব অনুযায়ী, তাঁর অন্তত চারবার চাকসু নির্বাচনে ভোট দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একবারও দিতে পারেননি। এখলাস বলেন, ‘প্রতিবছর চাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। স্নাতকোত্তর পর্যন্ত অন্তত চারটি নির্বাচনের সাক্ষী হতাম। তবু শেষ সময়ে এসে একটা নির্বাচন অন্তত পাচ্ছি, এতেই আনন্দিত। আশা করব, প্রতিবছর নির্বাচন হবে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৬ সালে। এরপর প্রথম চাকসু নির্বাচন হয় পাকিস্তানের সামরিক সরকারের আমলে, ১৯৭০ সালে। চাকসুতে এখন পর্যন্ত ৬টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচনটি হয় ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এরপরে আর নির্বাচন আয়োজন করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মূলত ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে কোন্দল, মুখোমুখি অবস্থান ও সরকারের সদিচ্ছার অভাবে নির্বাচন আয়োজন হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রতিবছর চাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। স্নাতকোত্তর পর্যন্ত অন্তত চারটি নির্বাচনের সাক্ষী হতাম। তবু শেষ সময়ে এসে একটা নির্বাচন অন্তত পাচ্ছি, এতেই আনন্দিত। আশা করব, প্রতিবছর নির্বাচন হবে।এখলাস বিন সুলতান, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা-কর্মীরা নির্বাচনে অংশ নিতে প্যানেল গঠন করেছেন। তাঁদের প্যানেলের নাম ‘দ্রোহ পর্ষদ’। এখান থেকে ভিপি প্রার্থী হয়েছেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ। নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এত বছর নির্বাচনের আয়োজন না করে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। আশা করব, প্রশাসন প্রতিবছরই নির্বাচনের আয়োজন করবে।’

মাস তিনেক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়েছেন জিহাদ আরাফাত। ভর্তি হয়েই চাকসু নির্বাচনের আমেজে উচ্ছ্বসিত তিনি। এমনকি কেন্দ্রীয় সংসদের ভিপি পদে লড়তে মনোনয়নপত্রও কিনেছেন। জিহাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভর্তি হয়েই চাকসু নির্বাচন পেলাম। আমার আগে হাজারো শিক্ষার্থী পাট চুকিয়ে বের হয়েছেন। কারও প্রার্থী বা ভোটার হওয়ারও সুযোগ হয়নি। আমি আসলে ভাগ্যবান।’

যে কারণে ভিন্ন পরিবেশ

এক দশক ধরে ক্যাম্পাসে আধিপত্য ধরে রাখা ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) নেতা-কর্মীরা এখন ক্যাম্পাসে নেই। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। তাঁদের দাপটও শেষ হয়ে যায়। ক্যাম্পাসে একের পর এক সংঘর্ষ, মারামারি, হল দখল, চাঁদাবাজি, নির্মাণকাজ আটকে দেওয়ার মতো ঘটনায় বারবার খবরের শিরোনাম হয়েছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।

ছাত্রলীগের ‘চাপে’ ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও বাম সংগঠনগুলো এত দিন কোণঠাসা ছিল। হামলা ও মামলায় ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারেননি। তবে গত বছরের পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে গেছে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তাঁদের বিদায়ের পর ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। ব্যস্ততা বেড়েছে ছাত্রদলেরও। বাম সংগঠনগুলোও বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে ক্যাম্পাসে সরব আছে।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, আবাসন ও পরিবহন-সংকট, হলে হলে নিম্নমানের খাবার সরবরাহসহ এমন গুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যু উঠে নির্বাচনী আলোচনায় আসবে। যেসব প্রার্থী ও প্যানেল শিক্ষার্থীবান্ধব ইস্যু ইশতেহারে আনবে, তাঁরাই ভোটের মাঠে এগিয়ে যাবে।

ভিন্ন পরিবেশে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে সব ধরনের প্রস্তুতি আছে বলে জানান প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘ সময় পর গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে নির্বাচনী আচরণবিধিও প্রকাশ করা হয়েছে। ভোটার তালিকাও প্রকাশিত হয়েছে। তফসিল অনুযায়ী সব প্রক্রিয়া নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজনের জন্য যা যা করণীয়, সবই পালন করা হবে।

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, এবার মোট ভোটার ২৭ হাজার ৬৩৭ জন। গত রোববার থেকে শুরু হয়েছে মনোনয়নপত্র বিতরণ। গতকাল ছিল সংগ্রহের শেষ দিন। এদিন প্রায় ১ হাজার শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় ও হল সংসদের জন্য মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। মনোনয়নপত্র আজ বুধবার পর্যন্ত জমা দেওয়া যাবে। যাচাই-বাছাই হবে ১৮ সেপ্টেম্বর। প্রার্থীর প্রাথমিক তালিকা প্রকাশিত হবে ২১ সেপ্টেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৩ সেপ্টেম্বর। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশিত হবে ২৫ সেপ্টেম্বর।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স প ট ম বর সরক র র হয় ছ ন কর ম র প রক শ প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

আরপিওর বিধানের বৈধতার রায় রিভিউর জন্য হলফনামার অনুমতি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনসংবলিত স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা মনোনয়নের সঙ্গে যুক্ত করাসংক্রান্ত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধানের বৈধতা দিয়ে ১৪ বছর আগে রায় দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। এই রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদনের জন্য হলফনামার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছেন দুজন আইনজীবীসহ সাত ব্যক্তি। শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব আজ সোমবার হলফনামা করার অনুমতি দিয়েছেন।

আবেদনকারী সাত ব্যক্তি হলেন ব্যারিস্টার এম সারোয়ার হোসেন, মেজর (অব.) এস এম হারুনুর রশীদ, কাজী জাহেদুল ইসলাম, আইনজীবী এস এম আজমল হোসেন, মেজর (অব.) নিয়াজ আহমেদ জাবের, মেজর (অব.) মো. জিয়াউল আহসান ও সালাহ উদ্দিন।

আদালতে আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ওমর ফারুক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ মামলায় আবেদনকারীরা পক্ষ ছিলেন না। যে কারণে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন দায়েরের জন্য হলফনামা করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন তাঁরা। চেম্বার আদালত হলফনামা দায়ের করার অনুমতি দিয়েছেন। আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে শিগগিরই রিভিউ আবেদন করা হবে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১২(৩ক)(ক) বিধান অনুযায়ী নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনসংবলিত স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে হবে। তবে শর্ত থাকে যে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী ইতিপূর্বে জাতীয় সংসদের কোনো নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকলে ওই তালিকা প্রদানের প্রয়োজন হবে না।

আইনজীবীর তথ্য অনুসারে, ঢাকার একটি আসন থেকে ২০০৭ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাহবুব আহমেদ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি মনোনয়নপত্র নেন। পরে নির্বাচনের ওই তারিখ পিছিয়ে যায়। অন্যদিকে ২০০৮ সালে আরপিও দফা ১২(৩ক)–তে সংশোধনী আনা হয়। এই বিধান সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদ ও আরপিওর ১২(১) ধারার পরিপন্থী উল্লেখ করে মাহবুব আহমেদ চৌধুরী ২০১০ সালে হাইকোর্ট রিট করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট রুল ডিসচার্জ (খারিজ) করে রায় দেন। দফা (৩ক) সংবিধান পরিপন্থী নয় বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেন রিট আবেদনকারী। শুনানি শেষে আপিল বিভাগ ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারি লিভ টু আপিল খারিজ করে রায় দেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনসংবলিত স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা মনোনয়নের সঙ্গে যুক্ত করাসংক্রান্ত আরপিওর ১২(৩ক)–তে বেআইনি কিছু পাননি বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।

ওই রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে দুই আইনজীবীসহ সাত ব্যক্তি আবেদন করতে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তাঁদের আইনজীবী ওমর ফারুক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে ভোটারের গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। ভোটার কোন প্রার্থীকে ভোট দেবেন বা দেবেন না, এটি একান্তই তাঁর চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার। সিক্রেট ব্যালটে হামলা হলে ভোট বাতিলও হয়। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে প্রার্থীর যোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে। রাজনৈতিক দল হলে ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থন লাগবে না, অথচ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে গেলে লাগবে অর্থাৎ একই মনোনয়নপত্র ঘিরে দ্বৈত বিধান। ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থন থাকার ওই বিধানের মাধ্যমে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখার সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা সংবিধান সমর্থন করে না এবং ভোটারের গোপনীয়তারও লঙ্ঘন—এসব যুক্তি তুলে ধরে আবেদনটি করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আরপিওর বিধানের বৈধতার রায় রিভিউর জন্য হলফনামার অনুমতি
  • জকসু নির্বাচন নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ ছাত্র সংগঠনগুলোর