তুলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় ও চাঁদার জন্য প্রকাশ্যে কোপানোর মতো ঘটনা মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। এর সঙ্গে আগে থেকেই রয়েছে ছিনতাই–আতঙ্ক। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসায়ীদের হুমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। পুলিশ বলছে, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ঘটনায় পেশাদার অপরাধীদের পাশাপাশি শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় বিপণিবিতান মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে ব্যবসায়ী এহতেশামুল হককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করে ৮ থেকে ১০ দুর্বৃত্ত। এ ঘটনায় সন্ত্রাসী ‘ইমন গ্রুপ’ জড়িত বলে জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে পেশাদার অপরাধীরা তৎপর হয়েছে। অপরাধ মোকাবিলায় পুলিশের সক্রিয়তা এখন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। তৌহিদুল হক, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক সূত্র বলছে, গত ৫ আগস্টের পর অপহরণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো যেসব অপরাধ এখন বেশি ঘটছে, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই পেশাদার অপরাধী। শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকাতেও পেশাদার অপরাধীরা সক্রিয়। পেশাদার অপরাধী ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বিভিন্ন বৈঠকেও আলোচনা হচ্ছে। ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে। তাঁদের অনেকে এখন সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।

ডিএমপি সূত্র বলছে, ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, মতিঝিল, বাড্ডা ও মহাখালী এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়েছে। চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে আলোচিত সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ক্যাপ্টেন ইমন, ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস ও সুব্রত বাইনদের নাম আসছে। এর মধ্যে ইমন ছাড়া অন্যদের নাম ২০০১ সালে করা শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় রয়েছে। তালিকায় ইমনের নাম না থাকলেও দুই দশক ধরে ঢাকার অপরাধজগতের অন্যতম আলোচিত নাম ইমন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলাল ও ইমন জামিনে বের হন। এই দুজন ছাড়া অন্তত চার শীর্ষ সন্ত্রাসী কাছাকাছি সময়ে কারাগার থেকে জামিনে বের হয়েছেন। গত চার মাসে খুন, দখল, চাঁদাবাজিসহ অপরাধের বেশ কয়েকটি ঘটনায় পিচ্চি হেলাল ও ইমনের নাম এসেছে। গত অক্টোবরে রাজধানীর নীলক্ষেতে পাঁচ ব্যবসায়ীর দোকান দখলের চেষ্টা হয়। এর মধ্যে দুজন বলেন, ‘ক্যাপ্টেন ইমনের’ লোক পরিচয় দেওয়া কয়েক ব্যক্তি ব্যবসা গুটিয়ে নিতে তাঁদের হুমকি দেন। একপর্যায়ে চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না পেয়ে একটি দোকান কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখতে বাধ্য করেন। পরে তাঁরা ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওই শিক্ষার্থীরা পরে পুলিশকে বিষয়টি দেখতে বলেন। এরপর পুলিশ উদ্যোগী হলে ওই চাঁদাবাজেরা আর আসেননি।

সন্ত্রাসী ইমনের লোক পরিচয়ে হাজারীবাগের একাধিক ব্যবসায়ীকে নির্যাতন করে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁদের একজন নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ১০ লাখ টাকার বেশি চাঁদা দিয়েছেন তিনি। ভয়ে মামলা করতে যাননি।

হাজারীবাগকেন্দ্রিক একটি ব্যবসায়ী সমিতির একজন প্রতিনিধি প্রথম আলোকে জানান, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের লোকেরা তুলে নিয়ে ৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নিয়েছেন—এমন পাঁচটি ঘটনা শুনেছেন তাঁরা। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে ওই ব্যবসায়ীদের নাম প্রকাশ করতে চাননি তিনি।

ডিএমপি সূত্র বলছে, ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, মতিঝিল, বাড্ডা ও মহাখালী এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে বেরিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছেন, তাঁদের কীভাবে আইনের আওতায় আনা যায়, সে বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে কাজ চলছে। পাশাপাশি যেসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করার সাহস পাচ্ছেন না বলে খবর বেরিয়েছে, সেগুলো সম্পর্কেও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

২ জানুয়ারি মিরপুরের রূপনগরের মিল্ক ভিটা মোড় এলাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানার সামনে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় সন্ত্রাসীরা। এতে কারখানার এক কর্মীর পা ঝলসে যায়। মূলত চাঁদা আদায়কে ঘিরে আতঙ্ক তৈরি করতে ওই ঘটনা ঘটে।

ডিসেম্বরে অপহরণের ৭৪ মামলা

পুলিশ সূত্র বলছে, রাজধানীর বাইরেও পেশাদার অপরাধীরা এখন সক্রিয়। ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনা এলাকা থেকে চিকিৎসক আমিনুর রহমানকে অপহরণ করা হয়। পরদিন ভোরে গাজীপুরের হোতাপাড়া ও রাজেন্দ্রপুরের মাঝামাঝি স্থানে তাঁকে ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। তাঁর কাছ অপহরণকারীরা ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা নিয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণের বেশ কয়েকটি আলোচিত ঘটনা ঘটেছে। এর হবিগঞ্জ ও ময়মনসিংহে অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও ঘটেছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত শুধু র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছে ১৩৫ জন অপহরণকারী। একই সময়ে ১৯৬ জন অপহৃত ব্যক্তিকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব।

অন্যদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু অপহরণের ঘটনায় দেশে মামলা হয়েছে ৩২৯টি। এর মধ্যে গত ডিসেম্বরে অপহরণের মামলা হয়েছে ৭৪টি।

২ জানুয়ারি মিরপুরের রূপনগরের মিল্ক ভিটা মোড় এলাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানার সামনে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় সন্ত্রাসীরা। এতে কারখানার এক কর্মীর পা ঝলসে যায়। মূলত চাঁদা আদায়কে ঘিরে আতঙ্ক তৈরি করতে ওই ঘটনা ঘটে।

চাঁদাবাজির পাশাপাশি রাজধানীতে একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনায় মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। রাজধানী ও এর আশেপাশের এলাকায় ছিনতাইয়ের ২৭৯টি ‘স্পট’ (স্থান) সম্প্রতি চিহ্নিত করেছে র‌্যাব। ছিনতাইয়ের প্রবণতা বিশ্লেষণ করে বাহিনীটি এই স্পটগুলো নির্ধারণ করেছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে.

কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস বলেন, র‌্যাবের সব পর্যায়ে এখন নির্দেশনা হলো ছিনতাই, অপহরণ, চাঁদাবাজি, চুরি ও ডাকাতির মতো ঘটনাগুলো রোধ করা।

অপরাধ মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জে পুলিশ

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত জুলাই–আগস্টের আন্দোলনের সময় সারা দেশে পুলিশের ৫ হাজার ৭৪৯টি অস্ত্র লুট হয়েছে বা হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে চার হাজারে বেশি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় পুলিশের অস্ত্র লুট হয়েছে বা হারিয়েছে ১ হাজার ৮৯৮টি। উদ্ধার হয়েছে দেড় হাজারে মতো।

এ অবস্থায় স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় পুলিশকে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থানা ভবনগুলোর কার্যক্রম কাছের পুলিশ স্থাপনা, সরকারি স্থাপনা এবং ভাড়া করা বাড়িতে চলছে। পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও যানবাহনের অভাবে টহল ও তল্লাশি কার্যক্রমেও ভাটা পড়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী, পেশাদার সন্ত্রাসীসহ সব ধরনের সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে।

পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের আট কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নানা কারণে প্রত্যাশিত কর্মপরিবেশ না পাওয়ায় নিয়মিত কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ মোকাবিলায় বিশেষ মনোযোগ দিতে হচ্ছে। জুলাইয়ের আন্দোলনের মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে নিয়মিত অভিযান চালাতে হচ্ছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধ, অবস্থান ও ঘেরাও কর্মসূচিতে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে পুলিশকে। একসঙ্গে এত কিছু সামলে নিতে বহুমুখী চ্যালেঞ্জে পড়েছে পুলিশ। পুলিশ সদস্যদের মনোবলও পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা যায়নি। সব মিলিয়ে পুলিশ অপরাধ দমনে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে পেশাদার অপরাধীরা তৎপর হয়েছে। অপরাধ মোকাবিলায় পুলিশের সক্রিয়তা এখন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ছয় বছর ধরে নিখোঁজের পর ফেনীতে মৃত অবস্থায় উদ্ধার, সেই আহাদ আসলে কে

পরিবারের কাছে তিনি কাস্টমস কর্মকর্তা। ফেনীর স্থানীয় লোকজনের কাছে কখনো দিনমজুর, কখনো ফল ব্যবসায়ী। আবার কেউ কেউ তাঁকে চাকরিপ্রত্যাশী হিসেবেও চেনেন। কিন্তু তিনি আসলে কে—এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি এখনো।

মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার ভূইগাঁও ইউনিয়নের দাউদপুর গ্রামের মো. ইমানি মিয়ার ছেলে আবদুল আহাদের (৪৬) পরিচয় নিয়ে এমনই ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। গত বুধবার ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণ থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় লোকজন বলছেন, এলাকায় দিনমজুরের কাজ করতেন। কেউ বলছেন, ফল ব্যবসায়ী। তবে পরিবারের সদস্যদের দাবি, তিনি কাস্টমস কর্মকর্তা। ছয় বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে তাঁকে অপহরণ করা হয়।

কিন্তু অপহরণের পর এই ছয় বছর আহাদ কোথায় ছিলেন, ফেনীতে কীভাবে গেলেন, কেন দিনমজুরির কাজ করতেন, তার কোনো উত্তর মেলেনি। রাজধানী ঢাকার এক কাস্টমস কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, এই নামে কাস্টমসে কেউ কর্মরত ছিলেন, এমন তথ্য মেলেনি। তবে চট্টগ্রামের ঠিক কোন কার্যালয়ে বা বিভাগে তিনি কর্মরত ছিলেন, তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারলে তথ্য পাওয়া যেতে পারে।

অন্যদিকে নির্দিষ্ট পদ-পদবির কথা না জানালেও আহাদের পরিবারের সদস্যদের দাবি, তিনি কাস্টমস কর্মকর্তা ছিলেন। ছয় বছর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে অপহরণ করা হয়েছিল। এ ঘটনায় পরিবারের একাধিক সদস্য জামালপুর, সিলেটসহ একাধিক থানায় অভিযোগ দিয়েছেন। তবে ছয় বছরেও খোঁজ পাওয়া যায়নি। শুক্রবার দুপুরে জানাজা শেষে আহাদের মরদেহ মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের দাউদপুর গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে বাবার পাশে দাফন করা হয়েছে।

মৃত ব্যক্তিই নিখোঁজ আহাদ

বুধবার আহাদের লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে ফেনী পিবিআই কার্যালয়ের পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) পুলক বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ উদ্ধারের খবর পেয়ে পিবিআইয়ের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত ব্যক্তির আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে। ফলাফল হাতে পাওয়ার আগেই মরদেহের সঙ্গে থাকা এটিএম কার্ড থেকে পরিচয় শনাক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে আঙুলের ছাপের ফলাফলের সঙ্গে এটিএম কার্ডের প্রাপ্ত তথ্যের মিল পাওয়া যায়। এতে পুলিশ নিশ্চিত হয়, মৃত ব্যক্তিই আবদুল আহাদ।

কাস্টমস কর্মকর্তা, ফল ব্যবসায়ী, নাকি দিনমজুর

পরিচয় নিয়ে জল্পনা তৈরি হলে আবদুল আহাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেন প্রথম আলোর প্রতিবেদক। শুক্রবার ফেনী শহর ও ছাগলনাইয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে আবদুল আহাদের পরিচিত কাউকে পাওয়া যায়নি। তাঁর মৃত্যুর খবর ছবিসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বৃহস্পতিবার দুপুরেই এক ব্যক্তি পুলিশের কাছে দাবি করেছিলেন, আহাদ তাঁর সঙ্গে দিনমজুরের কাজ করেছেন। আবার আরেক ব্যক্তি দাবি করেন, গত কোরবানির ঈদে তাঁর বাড়িতে কসাইয়ের কাজ করতে এসেছিলেন। তবে এই দুজনের পরিচয় জানাতে পারেনি পুলিশ।

ফেনী শহরের কলেজ রোড এলাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকে ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল হিসাব নম্বর খুলেছিলেন আহাদ। সেখানে তিনি নিজেকে ফল বিক্রেতা উল্লেখ করেন। শিক্ষাগত যোগ্যতায় উল্লেখ করেন, দ্বিতীয় শ্রেণি পাস। ওই ব্যাংক হিসাবের নমিনি করেছিলেন তাঁর বড় মেয়েকে। ঠিকানা উল্লেখ করেছিলেন শহরের সহদেবপুর এলাকা। ফেনীর ওই এলাকায় সাধারণত শ্রমিকশ্রেণির লোকজন বেশি বাস করেন। তবে ওই এলাকার বিভিন্ন বাসিন্দা কাছে জিজ্ঞেস করে এবং কলোনি ঘুরেও আহাদ সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যায়নি।

সহদেবপুর এলাকার একটি কলোনির বাসিন্দা আবুল হোসেন বলেন, ওই এলাকায় সিলেট বা মৌলভীবাজারের কোনো শ্রমিক থাকেন না। খুলনা, বাগেরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা অঞ্চলের শ্রমিকেরা এই এলাকায় থাকেন। তাঁরা রাজমিস্ত্রিসহ বিভিন্ন দিনমজুরির কাজ করেন।

ফেনীর ওই ব্যাংকে হিসাব খোলার সময় একটি মুঠোফোন নম্বরও ব্যবহার করেছিলেন আহাদ। তবে বর্তমানে নম্বরটি সিরাজগঞ্জ জেলার এক ব্যক্তি ব্যবহার করছেন। তিনি দাবি করেন, এটি এখন তাঁর নামে নিবন্ধন করা। হিসাবটিতে তেমন লেনদেন হতো না। চলতি বছরের ২৫ মে শেষবার তিনি ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন করেছেন। তবে এর বেশি কিছু জানাতে চায়নি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে ছাগলনাইয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহ আলম বলেন, পুলিশ স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পেরেছেন, মৃত আহাদ এলাকায় দিনমজুরের কাজ করতেন। কাজ শেষে তিনি অনেক সময় থানা রোড এলাকার একটি মার্কেটের বারান্দায় রাত যাপন করতেন। তবে সেখানেও তিনি নিয়মিত থাকতেন না।

নিখোঁজ, না অপহরণ

২০১৯ সালের ৭ মে আবদুল আহাদকে অপহরণ করা হয়েছিল বলে জানিয়েছিল তাঁর পরিবার। তবে গতকাল শনিবার জানানো হয়, ওই বছরের ১ মে এ ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন গভীর রাতে অপহরণকারীরা আহাদের স্ত্রীর মুঠোফোন নম্বরে কল করে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। তবে ফোনটি ধরেন তাঁর শ্যালক। মুক্তিপণের দাবি তিনি তাঁর বোন মাহাবুবা আক্তারকে জানান। পরদিন দুপুরের মধ্যে দুটি বিকাশ নম্বরে মোট ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা পাঠানো হয়।

জানতে চাইলে মাহাবুবা আক্তার দাবি করেন, ২ মে দুপুর ১২টায় সর্বশেষ আহাদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তখন অপহরণকারীরা আহাদের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়েছিল। অপহরণের পর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গেলে তা নেওয়া হয়নি।

অপহরণের এ ঘটনার ২৫ দিন পর ২০১৯ সালের ২৭ মে সিলেট কোতোয়ালি থানায় একটি জিডি করেন আহাদের বড় ভাই। সেই জিডিতে উল্লেখ করা হয়, ২ মে ‘২৬৯ শেখঘাট, কোতোয়ালি, সিলেট’—এ ঠিকানা থেকে ব্যবসার কাজে কালীঘাট বাজারে গিয়েছিলেন আহাদ। এরপর আর যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। ওই জিডিতে অপহরণ বা মুক্তিপণ শব্দের কোনো উল্লেখ ছিল না। কেন উল্লেখ করা হয়নি, সে বিষয়ে জানতে আহাদের বড় ভাই শেখ আবদুর নুরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কথা বলতে চাননি।

আরও পড়ুনছয় বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে ‘অপহরণ’, ফেনী থেকে মিলল কাস্টমস কর্মকর্তার লাশ৩০ অক্টোবর ২০২৫

জানতে চাইলে আহাদের স্ত্রী মাহাবুবা আক্তার বলেন, ওই জিডিতে কেন অপহরণের বিষয়টি লেখা হয়নি, সেটা তিনি জানেন না। আহাদের বড় ভাই বিষয়টি বলতে পারবেন।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এ অপহরণের পাঁচ মাস পর, ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আহাদের বড় ভাই শেখ আবদুর নুর জামালপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সে মামলায় আহাদকে চাকরিপ্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অপহরণকারীদের যে দুটি বিকাশ নম্বর থেকে মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছিল, সে দুটি নম্বরের ঠিকানা ছিল জামালপুর। এ কারণে জামালপুরে মামলাটি হয়েছে বলে দাবি পরিবারের।

আদালতে করা এ মামলায় শেখ আবদুর নুর চারজনকে আসামি করেন। এর মধ্যে দুজন জামালপুর ও দুজন সিলেট জেলার বাসিন্দা। মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল কমলগঞ্জ উপজেলার কুমড়াকাপন এলাকার শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি আহাদ। অর্থাৎ সিলেট থানায় করা জিডির সঙ্গে এ মামলার তথ্যের কোনো মিল নেই।

এদিকে আহাদের স্ত্রী মাহাবুবা আক্তার, বোন নাঈমা নাসরিন, ভাগনে মোস্তাফিজুর রহমান ও শ্যালক মুজাহার উদ্দিন সায়েম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে পরে কাস্টমসে যোগ দেন আহাদ। তিনি পেশাগত কাজে সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ একাধিক স্থানে অবস্থান করেছেন। তবে কাস্টমসের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও এ বিষয়ে তথ্য মেলেনি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ছয় বছর ধরে নিখোঁজের পর ফেনীতে মৃত অবস্থায় উদ্ধার, সেই আহাদ আসলে কে