ইমানের সঙ্গে তাকওয়া শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি
Published: 16th, January 2025 GMT
ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো ইমান। ইমান ছাড়া কোনো সৎ আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। অর্থাৎ ইমানহীন মানুষ চিরকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে থাকবে। তাই জান্নাতে যাওয়ার পূর্বশর্ত হলো ইমান।
ইমান শব্দটি ‘আমনুন’ থেকে এসেছে। আমনুনের অর্থ হচ্ছে আত্মার প্রশান্তি ও নির্ভীকতা লাভ, যা নিরাপত্তা দেওয়া ও আশঙ্কামুক্ত করা অর্থে ব্যবহার করা হয়। এই আমনুন ধাতুর ক্রিয়ারূপই হলো ইমান। ইমানের আভিধানিক অর্থ– আন্তরিক বিশ্বাস। মহানবী (সা.
ইমান মূলত মূল, শাখাসহ বিষয়ের প্রতি হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের সমন্বিত নাম। তবে শরিয়া দৃষ্টিকোণ থেকে পাঁচটি বিষয়ের প্রতি নজর রাখা জরুরি– অন্তরে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন, মুখে কালেমা পড়ার মাধ্যমে আমল, নিয়তের বিশুদ্ধতা, জিহ্বার মাধ্যমে আমল তথা কোরআন তেলাওয়াত, জিকর-আজকার ইত্যাদি, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আমল তথা রুকু-সিজদা, হজ, সিয়াম ইত্যাদি। ইমানদার তথা মুসলিম হতে হলে সাতটি বিষয়ের ওপর ইমান আনতে হবে; যাকে আরবিতে ইমানে মুফাস্সাল বলে। ইমানে মুফাস্সালের অর্থ হলো বিস্তারিত– ইমান। ইমানে মুফাস্সালের বাংলায় অর্থ হলো– ‘আমি ইমান আনলাম– আল্লাহ তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসুলগণ, শেষ দিবস (পরকাল), তাকদিরের ভালো ও মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয় এবং মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবনের প্রতি।’
ইমানের প্রধান বিষয় তিনটি। যথা– তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত। ইমানে মুফাস্সাল এ তিনটিরই অন্তর্ভুক্ত। তাওহিদের মধ্যে শামিল রয়েছে তিনটি– আল্লাহ, ফেরেশতাগণ ও তাকদির। রিসালাতের মধ্যে আছে দুটি– কিতাবসমূহ ও রাসুলগণ। আখিরাতের মধ্যে দুটি– শেষ দিন ও মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন।
ইমান আনার ব্যাপারে কোরআন মাজিদে অসংখ্য আয়াত পরিলক্ষিত হয়। সুুরা নূর-এর ৬২ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন– মুমিন মূলত তারাই, আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি যাদের দৃঢ় ইমান বাড়ছে। সুরা আল-ইমরান-এর ৭৯ আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন– অতঃপর ইমান আনো আল্লাহর প্রতি ও রাসুলের প্রতি। যদি তোমরা ইমান আনো ও তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে তোমাদের জন্য বিরাট পুরস্কার রয়েছে।’
ইমান আনার গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে রাসুল (সা.)-এর অসংখ্য হাদিস দেখতে পাওয়া যায়। হজরত আবদুল্লাহ (র.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যার অন্তরে অণু পরিমাণ ইমান রয়েছে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না।’ (তিরমিজি-১৯৯৮)। অন্য বর্ণনায় রয়েছে– তার আমল যা-ই হোক না কেন, আল্লাহ্ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (বুখারি-৩১৮০ ও মুসলিম ১৫০)
মুসলমানদের ইমানে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। ইমানের বাড়া-কমা ও তাকওয়ার ভিত্তিতে জান্নাতের স্তর নির্ধারিত হয়। মুমিন বান্দারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই তাদের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে নির্ধারণ করে থাকে। ইমানদারদের জীবনে কিছু বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। তাদের ইমান ও হেদায়াত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিনয় ও নম্রতা বেড়ে যায়। তাকওয়ার ভিত্তিতে এক মুমিন অপর মুমিনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। পূর্ণাঙ্গ দ্বীন অনুসরণের মাধ্যমে জান্নাতে মুমিনের মর্যাদা বেড়ে যায়। আল্লাহর প্রতি ইমান আনার ফলে মুমিন বান্দাদের অন্তরে প্রশান্তির অনুভূতি পরিলক্ষিত হয়। মুমিনের স্তর থেকে পাপের কারণে মানুষের অন্তর থেকে ইমান আস্তে আস্তে চলে যেতে থাকে। এভাবে ইমান আর না থাকলে তার জন্য জাহান্নাম অনিবার্য।
ইমান আনার সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটি বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হবে। আল্লাহর সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই শিরক করা যাবে না। মানুষের হক নষ্ট করা যাবে না। সর্বদা ঋণমুক্ত থাকতে হবে। ফরজ, ওয়াজিবগুলো পালনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। মানুষের সঙ্গে মুয়ামিলাত ও লেনদেন ঠিক রাখতে হবে। এগুলো পালন করার সঙ্গে সঙ্গে ইমানিয়াত ঠিক রাখলে জান্নাত পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।
কেরামত আলী: প্রভাষক, রোভারপল্লী ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর
keramotali 2004@gmail.com
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।