নেপালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি নারীদের হিমালয় অভিযান
Published: 18th, January 2025 GMT
হিমালয় অভিযান বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ। শীতকালে তুষারপাত ও বৈরী আবহাওয়ায় তা আরও বেড়ে যায়। সাধারণত এ সময়ে হিমালয়ে অভিযান থেকে বিরত থাকেন পর্বতারোহীরা। এ চ্যালেঞ্জটাই গ্রহণ করেন বাংলাদেশের পাঁচ নারী। এবারই প্রথম বাংলাদেশের কোনো নারী অভিযাত্রী দল নেপালে অভিযান চালায়। ল্যাংটাং হিমালয়ের তিনটি চূড়া– ৫ হাজার ৫০০ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন ইয়ালা শৃঙ্গ, ৫ হাজার ১৪৫ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন সুরিয়া শৃঙ্গ এবং ৪ হাজার ৭৪৭ মিটার উঁচু গাঁসাইকুণ্ড শৃঙ্গ জয় করেন নারী অভিযাত্রীরা। প্রতিটি চূড়ায় দাঁড়িয়ে গর্বের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছেন তারা।
তীব্র ঠান্ডার মধ্যে দুর্গম হিমালয় অভিযান সম্পন্ন করা নারীদের মধ্যে রয়েছেন– এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার। তাঁর নেতৃত্বে অভিযানে আরও অংশ নেন ইয়াসমিন লিসা, তহুরা সুলতানা রেখা, প্রশিক্ষণার্থী ট্র্যাকার এপি তালুকদার এবং অর্পিতা দেবনাথ।
তবে এই পাঁচ নারী পর্বতারোহীর গল্প এটুকুই নয় শুধু। তাদের পেছনে শক্তির আধার হয়ে রয়েছেন নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃত বেগম রোকেয়া। গত বছরের মে মাসে ইউনেস্কোর ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রিজিওনাল রেজিস্টার ফর এশিয়া প্যাসিফিক’ তালিকায় স্থান করে নেয় এই নারীবাদী কথাসাহিত্যিকের উপন্যাস ‘‘সুলতানা’জ ড্রিম’’। এই নারীবাদী সাহিত্যকর্ম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘‘সুলতানা’জ ড্রিম আনবাউন্ড’’ বা ‘সুলতানার স্বপ্ন অবারিত’ স্লোগানে এ অভিযানের আয়োজন করে পর্বতারোহীদের সংগঠন ‘অভিযাত্রী’। মাস্টারকার্ডের সহযোগিতায় শীতকালীন এ পর্বতাভিযানে সহযোগী হিসেবে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
গত ২৮ ডিসেম্বর অভিযাত্রী দলটি ৪ হাজার মিটার উচ্চতাসম্পন্ন লিরুং লেকে পৌঁছায়। শীতের কারণে লেকের পানি জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল। বিকেলের দিকে আবার তীব্র তুষারপাত শুরু হয়। এ অবস্থায় পরের দিন ২৯ ডিসেম্বর ইয়ালা পর্বতের বেসক্যাম্পে (৪৮৪০ মিটার) পৌঁছায় অভিযাত্রী দল।
তিন পর্বতারোহী শৃঙ্গের উদ্দেশে অভিযানে যাবেন বলে বেসক্যাম্পে রয়ে যান। বাকি দুজন নবীন ট্র্যাকার বেসক্যাম্প থেকে ফিরে যান কেয়াঞ্জিং গ্রামে। ৩০ ডিসেম্বর দুপুর ২টায় নিশাত মজুমদার, ইয়াছমিন লিসা ও তাহুরা সুলতানা রেখা ইয়ালা পর্বতের চূড়ায় পৌঁছান। এটি ছিল ‘‘টিম সুলতানা’জ ড্রিম’’-এর প্রথম সফল পর্বতারোহণ।
জানা যায়, নয়া কাংগা আর ব্যাডেন পাওয়েল একই উচ্চতার। ব্যাডেন পাওয়েলের তুষার এবং বরফের যে অবস্থা নয়া কাংগার একই অবস্থা ছিল। এ দুটি পিক আরোহণ করার জন্য আরও সময় এবং সরঞ্জামের প্রয়োজন ছিল। এই অভিযাত্রী দলের তা ছিল না। এ কারণে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়। দুই হাজার মিটার নিচে নেমে দলটি আবার দলবদ্ধ হয়।
নিশাত মজুমদার বলেন, ‘আমরা ব্যাডেন পাওয়েল শৃঙ্গের ৪ হাজার ৬০০ মিটারে একটি বেসক্যাম্প স্থাপন করে ৫ হাজার ৪০০ মিটার পর্যন্ত পথ খুলে দিয়েছিলাম। ফাটলগুলো আমাদের অবসর থাকতে দেয়নি। হাল ছাড়ার পরিবর্তে, আমরা পুনর্গঠিত হয়ে মোট তিনটি চূড়ায় আরোহণের নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করি।’
অভিযাত্রী দল ক্যায়াঞ্জিং থেকে চলে যায় গোঁসাইকুণ্ডে। নবীন দুই অভিযাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গোঁসাইকুণ্ড শৃঙ্গে আরোহণ করে অভিযাত্রী দল। তারা সুরিয়া শৃঙ্গেও আরোহণ করেন। সব অভিযান সফলভাবে শেষ করে অভিযাত্রী দল ১২ জানুয়ারি কাঠমান্ডু পৌঁছায়।
প্রথমবারের মতো এমন অভিযানে গিয়েছেন ট্র্যাকার অর্পিতা দেবনাথ। তিনি জানান, ২১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই অভিযানের সময় ইয়ালা বেসক্যাম্পে যাওয়ার পথে তিনি জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলোর মুখোমুখি হন। চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠার পর, অভিযানটি জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে জানিয়ে অর্পিতা আরও বলেন, ‘‘আমাকে স্যার এডমন্ড হিলারির এ কথাগুলো অনুপ্রাণিত করে– ‘আমরা যে পাহাড় জয় করি তা নয়, বরং নিজেদেরই জয় করি’।’’
আরেক পর্বতারোহী তহুরা সুলতানা রেখা জানান, পর্বতারোহণের পথ বেছে নেওয়ার সময় তাঁকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘‘মানুষ সবসময় কটূক্তি করে, ‘এতে দেশের কী লাভ?’ ‘কেন একজন নারী পাহাড়ে উঠবে?’ কিন্তু পাহাড় আমার কাছে মায়ের মতো; আর যা-ই হোক না কেন, আমি আমার স্বপ্ন এবং পাহাড়ের প্রতি আমার ভালোবাসাকে অগ্রাধিকার দেব।’’
বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউনেস্কোর প্রতিনিধি ড.
ছবি: তহুরা সুলতানা রেখার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
বক্সিং রিংয়ে চ্যাম্পিয়ন জিনাতই, বোনকে উৎসাহ দিতে গ্যালারিতে আফঈদা
কদিন ধরে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের আড্ডায় ঘুরেফিরে একটাই নাম জিনাত ফেরদৌস। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এই বক্সার প্রথমবারের মতো পা রেখেছেন জাতীয় বক্সিং রিংয়ে। আর প্রথমবারই নিজের জাত চেনালেন।
আজ বিকেলে পল্টনের মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়ামে ৫২ কেজি ওজন শ্রেণির ফাইনালে নেমে প্রতিপক্ষ আফরা খন্দকারকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নের মুকুট মাথায় তুলেছেন জিনাত। প্রতিযোগিতার আগেই যাঁর আগমন ঘিরে কৌতূহল ছিল তুঙ্গে, সেই জিনাত রিংয়ে নামতেই যেন বুঝিয়ে দিলেন, অন্যদের চেয়ে কেন তিনি এগিয়ে।
তিন রাউন্ডের লড়াইয়ে শুরু থেকেই জিনাত ছিলেন আক্রমণাত্মক। পাঞ্চে ছিল গতি, রক্ষণে ছিল আত্মবিশ্বাস। অন্যদিকে আফরা খন্দকার চেষ্টা করেছেন রক্ষণ সামলে লড়াইয়ে টিকে থাকতে। খান কয়েক মোক্ষম ঘুষিতে কিছুটা নড়বড়ে হলেও শেষ পর্যন্ত দমে যাননি আফরা।
বরং জিনাতের ঘন ঘন আক্রমণের ফাঁক গলে এক-আধটু পাল্টা আঘাত করতেও পেরেছেন। তবে এই পর্যায়ের এক প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত হয়ে পড়ে তাঁর জন্য অনেকটাই চাপের। তবু আফরা লড়ে গেছেন। আর জিনাতের আত্মবিশ্বাসী উপস্থিতি এ লড়াইকে করে তুলেছিল দেখার মতো।
গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছিলেন জাতীয় নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক ও আফরার বড় বোন আফঈদা খন্দকার। উৎসাহ দিচ্ছিলেন ছোট বোনকে। পাশে ছিলেন মা–বাবাও। তবে পরিবারের ষোলো আনা সমর্থনও জিনাতকে হারানোর জন্য যথেষ্ঠ হয়নি।
ম্যাচ শেষে আফরা বললেন, ‘তিনি একজন ভালো খেলোয়াড়। তাঁর বিপক্ষে খেলা আমার জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে তাঁর আক্রমণাত্মক স্কিলটা দুর্দান্ত। ম্যাচ শেষে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, গুড ফাইট।’
বিজয়ী জিনাত পরে কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘আমি সবাইকে বলতে চাই, বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা খেলতে চায়। তারা যদি সুযোগ-সুবিধা পায়, অনেক ভালো করবে। ওদের স্কিল আছে।’
সেমিফাইনালে আছিয়া না ফাইনালে আফরা—কোন লড়াইটা বেশি কঠিন ছিল? জিনাতের জবাব, ‘আমি আমার খেলাটা খেলেছি এবং জিতেছি। দুজনই আলাদা ধাঁচের প্রতিপক্ষ।’
জিনাত বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক পদক জয়ের আকাঙ্ক্ষার কথা আজও বলেছেন। আগামী এশিয়ান গেমসে সুযোগ পেলে পদক জিতবেন কি না, প্রশ্নের ছোট্ট উত্তর, ‘ইনশা আল্লাহ।’
আফরা-জিনাত ফাইনাল ম্যাচটা যেন ছিল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বক্সারের লড়াই নয়, এর বাইরেও চলছিল আরেক নাটক। ফাইনালের কয়েক ঘণ্টা আগেই বক্সিং রিংয়ে এক ব্যতিক্রমী দৃশ্য। আনসারের বক্সার জাহিদুল হক রেফারির রায় নিয়ে ক্ষোভ জানাতে রিংয়ে বসে পড়েন প্রতিবাদ হিসেবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বক্সার জনি ভদ্রর ঘুষিতে কপালে চোট পান জাহিদুল। চিকিৎসাও নেন। একপর্যায়ে রিংয়ের মাঝখানে বসেই অভিনব প্রতিবাদ জানান।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ আনসার দল বাংলাদেশ বক্সিং ফেডারেশনের সভাপতির কাছে অভিযোগ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের হুমকি দেয়। একপর্যায়ে আনসারের প্রতিনিধিরা রিং ছেড়ে চলে যান। মুহূর্তেই ঘনীভূত হয়ে ওঠে অনিশ্চয়তা, আফরা-জিনাত ফাইনালটি আদৌ হবে তো? কারণ, আফরা বাংলাদেশ আনসারের প্রতিযোগী। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আনসার ফিরে আসে এবং প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।
এ বিষয়ে বক্সিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুস কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফাইটে হারলে যা হয়। হারলেই বলে অন্যায় হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত রিংয়ে ফিরে এসেছে, খেলেছে, এটা ভালো।’
ম্যাচ শুরুর ঠিক আগে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের একটি প্রতিনিধিদল গ্যালারিতে এসে জিনাতকে শুভেচ্ছা জানায়, তাঁকে উপহারও দেয় তারা। গ্যালারিতে বাড়তি উত্তেজনা আর গুরুত্ব যোগ করে ফাইনাল ম্যাচকে ঘিরে। আর দেশের সংবাদমাধ্যমের ব্যাপক উপস্থিতি তো ছিলই ম্যাচটা ঘিরে।