সর্বাগ্রে প্রয়োজন পুলিশ বাহিনীকে ট্রমামুক্ত করা
Published: 19th, January 2025 GMT
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই পুলিশ সম্পর্কে উঁচু বা ইতিবাচক ধারণা পোষণকারী মানুষ খুব বেশি নেই। বাংলাদেশও তার মধ্যে পড়ে। দীর্ঘ দিনের ঔপনিবেশিক শাসনের লিগ্যাসি থেকে বেরিয়ে আসতে দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠীর অনীহা এবং সামগ্রিকভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব প্রধানত এর জন্য দায়ী। কারণ এ পরিস্থিতি প্রশাসনের মতো পুলিশ বাহিনীর মধ্যেও পেশাদারিত্ব গড়ে উঠতে দেয় না। তা কোনো বাহিনীর মধ্যে জনগণের প্রতি দায় ও দরদও গড়ে তোলে না। তবুও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কোনো বিপদ-আপদ বা দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষ সবার আগে পুলিশকেই স্মরণ করে। আশা করে, পুলিশ তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। এর পেছনে কারণ হলো, আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পুলিশই হলো জননিরাপত্তা বিধান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার। এ প্রেক্ষাপটে পুলিশকে বলা যায় এক প্রকার নেসেসারি ইভিল বা প্রয়োজনীয় বালাই; যাকে ছাড়ানোও যায় না, আবার ছেড়েও থাকা যায় না।
এই উপমহাদেশে পুলিশ বাহিনীর গোড়াপত্তন হয় ১৮৬১ সালের ৫ নম্বর আইনের মাধ্যমে, যাকে সাধারণ মানুষ ‘পাঁচ আইন’ নামেই জানে। সেই সময় থেকেই পুলিশ বাহিনী সরকারের আজ্ঞাবহ লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করে আসছে। শুধু পুলিশ কেন; ঔপনিবেশিক ধারায় সৃষ্ট সব সংস্থাই কাজটি করেছে। কিন্তু দিন শেষে পুলিশের দোষই মানুষ বেশি দেখে। পুলিশ মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় সরাসরি সম্পৃক্ত, সরকারের আর কোনো সংস্থা তা নয়। বলা যায়, পুলিশের বিকল্প কেবলই পুলিশ।
পুলিশ সম্পর্কে যত নেতিবাচক কথাই বলা হোক, ১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঊষালগ্নে পুলিশ বাহিনীই রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ৩০৩ রাইফেল হাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। পরবর্তী ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধেও কয়েক হাজার পুলিশ সদস্য শহীদ হয়েছেন। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস লিখতে গেলে অবশ্যই এসব পুলিশ সদস্যকে স্মরণ করতে হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশে এত ত্যাগ-তিতিক্ষার পুলিশ বাহিনী নিঃসন্দেহে অনেক জনঘনিষ্ঠ হতে পারত। কিন্তু দুঃখজনক, স্বাধীনতার পর যারাই ক্ষমতায় এসেছে তারাই পুলিশকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে, যা আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক হয়ে ওঠে। তারা পুলিশকে অনেকটা দলীয় ক্যাডার বাহিনীতে পরিণত করে, যার চরম রূপ দেখা গেছে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ব্যাপক নিহত-আহতের ঘটনায়।
ওই আন্দোলনের সময় পুলিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার সঙ্গে নির্মম আচরণের অভিযোগ যেমন উঠেছে, একইভাবে উচ্ছৃঙ্খল জনতা কর্তৃক পুলিশের ওপর আক্রমণের অভিযোগও কম নয়। আন্দোলনের সময় সরকারি হিসাবে ৪২ পুলিশ নিহত হওয়ার কথা বলা হলেও, অনেকের মতে, সংখ্যাটা কয়েক হাজার। অভ্যুত্থানের নেতৃস্থানীয়রাই টেলিভিশন টকশোতে স্বীকার করেছেন– পুলিশ হত্যা না করলে নাকি অভ্যুত্থান সফল হতো না। এই সময়ে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে ১৩ পুলিশ সদস্যের মৃত্যু সম্পর্কে স্থানীয় এক বিএনপি নেতা সেদিনও অনুরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এমনকি খোদ রাজধানীতে অফ-ডিউটি পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করে বিদ্যুতের খাম্বার সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এসবের ফলে সার্বিকভাবে পুলিশ বাহিনীর মাঝে এক ধরনের ট্রমা জন্ম নিয়েছে, যার রেশ এখনও চলমান। তাদের পরিবার-পরিজনও এ ট্রমা থেকে মুক্ত নয়। এখনও অনেকের মাঝে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এমন আতঙ্ক কাজ করা স্বাভাবিক যে, ভবিষ্যতে অন্য কোনো সরকারের সমর্থকরা তাদের বর্তমান সরকারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে! এ অবস্থায় তাদের পক্ষে স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন যে কঠিন, তা বলাই বাহুল্য।
আইনসংগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বহু ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে সংশ্লিষ্ট আসামি ও তার স্বজনের কাছ থেকে এখনও বিগত সরকারের দোসর আখ্যা পেতে হয়। বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে ছাত্র মিছিলে পুলিশের বর্বরোচিত হামলা যে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের ওই তকমা থেকে বাঁচার কৌশল নয়, তা-ই বা কে বলতে পারে!
কথিত দুর্বৃত্তের হাতে পুলিশ সদস্যের প্রাণ হারানো কিন্তু এখনও বন্ধ হয়নি। গত ৯ জানুয়ারি নেত্রকোনার দুর্গাপুরে দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি কোপে মো.
এও মনে রাখা দরকার, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সবকিছুকে উপযোগী করে তোলার নামই সংস্কার। এটি কোনো ওয়ান স্ট্রোক বা এক ধাক্কায় শেষ করার মতো পদক্ষেপ নয়। হঠাৎ এক দিনে বা এক বছরে সবকিছু বদলে দেওয়া যাবে না। তাই এই মুহূর্তে দরকার পুলিশ বাহিনীকে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনা। সরকার, পুলিশ ও জনগণ– এই তিনটি সত্তা যদি পরস্পরকে আস্থায় নিতে না পারে তাহলে পুলিশ বাহিনীর ট্রমা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
স্বীকার্য, ঔপনিবেশিক লিগ্যাসি এবং দলীয়করণের কারণে অনেক পুলিশই বিতর্কিত কাজে জড়িয়ে গেছে। তা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে গোটা ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে, যেখানে সব ধরনের প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে পুলিশকে পুলিশের মতো কাজ করতে দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাদের যেন অতীতের মতো কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর লাঠিয়াল হিসেবে কাজ না করতে না হয়, সে জন্য উপযুক্ত আইনি সুরক্ষাও দরকার। কোনো অপারেশনের রোগীকে যেমন যে কোনো সার্জারি বা অপারেশনের আগে তার শারীরবৃত্তীয় স্বাভাবিকতা নিশ্চিত করতে হয়, তেমনি পুলিশ প্রশাসনেও যে কোনো ধরনের সংস্কার সাধন করতে গেলে প্রথমেই পুলিশকে জুলাই-আগস্ট ট্রমা থেকে বের করে আনতে হবে।
মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ
কর্মকর্তা ও কলাম লেখক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প ল শ সদস য সরক র র
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ