ঘড়ির কাঁটায় নেপাল সময় সকাল ৭টা। আড়চোখে মোবাইলে নেপালের বর্তমান তাপমাত্রা দেখে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। থামেলের তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। লেপের নিচ থেকে উঠতে মন চাইছিল না। কিছু সময় পর অভিনব দাদার ফোন– আর ঘুমিয়ো না, এবার উঠে তৈরি হয়ে নাও।
আজ আমার আর সানন্দার নেপাল ভ্রমণের তৃতীয় দিন। অন্নপূর্ণা কিংবা এভারেস্ট জয়ের জন্য সারাবছরই পর্বতারোহীরা এখানে ভিড় করেন। অন্যদিকে সাধারণ পর্যটকরা এখানে যান হিমালয়ের পাশ থেকে সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে।
আমাদের আজকের ভ্রমণ গন্তব্য চন্দ্রগিরি হিল। ঢাকার মতো যানজট আছে; রাস্তার হাল আরও খারাপ কাঠমান্ডুর। দিনভর বেশ তাপ। শেষ রাতে গা কিছুটা শিনশিন করে। সূর্যদেবের ছোঁয়ায় উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। সকালে ঠান্ডার তীব্রতা দেখে বেশ কয়েকটি ঠান্ডা কাপড় পরেছি। এবার ঘেমে উঠছি বারবার। তখনই দাদা বললেন, ‘একটু অপেক্ষা কর। ঠান্ডায় কাঁপবে।’ কাঠমান্ডু শহর থেকে দেড় ঘণ্টার পথ চন্দ্রগিরি।
প্রায় দুই ঘণ্টা মাইক্রোবাসে চেপে নামলাম থানকোট। সেখান থেকে শুরু হলো পাহাড়ি পথ। এরপর পাহাড় কেটে তৈরি শক্ত কংক্রিটের সুদৃশ্য পথ এঁকেবেঁকে গিয়ে থামল চন্দ্রগিরি কেবল কার স্টেশনে। বিশাল এ এলাকা থেকে নিচের থানকোট শহর স্পষ্ট। একটি পাহাড় ডিঙিয়ে কাঠমান্ডু। চন্দ্রগিরিতে এসে রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় সাড়ে আট হাজার ফুট। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে এগিয়ে যেতে লাগলাম। হিমশীতল বাতাসে একটু পরপর শরীর কেঁপে উঠছিল। সিঁড়ি বেয়ে উঁচু একটি ভবনে উঠে কেবল কারের মূল স্টেশনে পৌঁছালাম। এর আগে টিকিট কাটতে হলো। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মাথাপিছু টিকিট ১ হাজার ১০০ নেপালি রুপি। ভবনের ভেতরে প্রবেশের পর সহস্রাধিক মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখতে পেলাম। আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। চন্দ্রগিরির উচ্চতা ৮ হাজার ২৬৮ ফুট। কেবল কারের যাত্রাটি মোটামুটি ২ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। পাহাড়ের উচ্চতায় যেতে সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ মিনিট, সেটি আবার নির্ভর করে বাতাসের গতির ওপর। কেবল কার থেকে কাঠমান্ডু উপত্যকা, প্রাকৃতিক দৃশ্য ও অন্নপূর্ণা থেকে এভারেস্ট পর্যন্ত হিমালয় পর্বতমালার চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। কেবলওয়ে সিস্টেমে ৩৪টি গন্ডোলা রয়েছে, যা প্রতি ঘণ্টায় এক হাজার যাত্রী বহনে সক্ষম। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর আমরা উঠে বসলাম কেবল কারে। যত ওপরে উঠছি, নিচের শহর তত ছোট হয়ে যাচ্ছে। নিচে ঘন সবুজ বন কালচে হচ্ছে। খানিকটা উঠেছি, এরই মধ্যে কোত্থেকে একদল মেঘ এসে লাগল কারে, গায়ে। ভিজিয়ে দিয়ে গেল গ্লাস। মেঘের ছোঁয়ায় বিন্দু বিন্দু জলকণা জমে আছে সেখানে। আমাদের গায়ে লাগল হিমেল পরশ। নিচের দিকে তাকাতেই পিলে চমকে ওঠল। আমার অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। অন্যদিকে কেবল কারের যাত্রীদের মধ্যে এখন শুধু ‘ওয়াহ’, ‘কী সুন্দর’, ‘বাহ’ ধ্বনি। কিছু দূর উঠে নিচে শুধু মেঘের খেলা চোখে পড়ল। এখন বনও অদৃশ্য। কালচে মেঘের চাদর ঢেকে দিয়েছে সবুজ। ঠান্ডা আরও বাড়ছে। মেঘের খেলা দেখতে দেখতে, ভয়মিশ্রিত তীব্র ভালো লাগায় ভাসতে ভাসতে, অনেক ভাসা মেঘের পরশ গায়ে মেখে তারের ওপর দিয়ে চলা আমাদের ছোট গাড়িটি গিয়ে থামল চন্দ্রগিরি স্টেশনে। আড়াই কিলোমিটারের কেবল কার ভ্রমণ শেষ হলো। আমরা কেবল কার থেকে নেমে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। চারপাশের শীতল বন্য ফুলের সুবাসিত স্নিগ্ধ বাতাসে মন প্রফুল্ল হবে যে কারোর। মনে মনে ভাবলাম, উচ্চতার ভয়ে যদি এখানে না আসতাম তাহলে মিস করতাম নেপাল ভ্রমণের সবচেয়ে সুন্দর ও রোমাঞ্চকর জায়গার দর্শন। ঠান্ডা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে অর্ডার দিলাম গরম গরম চায়ের, সঙ্গে নিলাম পপকর্ন। এতে শরীর বেশ খানিকটা উষ্ণ হলো। তিনটি রেস্তোরাঁ এখানে। আছে নিরামিষ-আমিষের ভিন্ন ব্যবস্থা। কেউ অর্ডার দিলে সামনাসামনি রান্না করে দেওয়ার বন্দোবস্ত আছে। এখানে তৈরি হচ্ছে একটি রিসোর্ট। আছে শিশুদের ছোট পার্ক, ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ি পথে চলার ব্যবস্থা। বেলা গড়িয়ে এলো। এবার নামতে হবে। আবার গিয়ে চড়লাম কেবল কারে। এবার ভয় খানিকটা কমে গেছে। আবারও বিস্ময়, মেঘ ছোঁয়ার আনন্দ নিয়ে ফিরে এলাম।
যারা যেতে চান চন্দ্রগিরি: সপ্তাহের সাত দিনই যাওয়া যায় চন্দ্রগিরি। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কেবল কার চলে। ছুটির দিন চলে সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। ভাড়া প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ১ হাজার ১০০ নেপালি রুপি। তিন ফুটের নিচে উচ্চতার শিশুদের কোনো ভাড়া দিতে হবে না। তিন থেকে চার ফুট উচ্চতার শিশুরা ৪০ শতাংশ কম ভাড়ায় ভ্রমণ করতে পারবে। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।