Samakal:
2025-06-16@14:44:39 GMT

ছেঁড়া পাতা জোড়া লাগান

Published: 21st, January 2025 GMT

ছেঁড়া পাতা জোড়া লাগান

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের প্রতিবাদের অন্যতম মাধ্যম ছিল গ্রাফিতি। ঢাকা শহরে শুধু নয়, বাংলাদেশজুড়ে বিভিন্ন দেয়ালে লেখা হয়েছে মানুষের মনের কথা। শিক্ষার্থীরা কেমন বাংলাদেশ দেখতে চায়, সেটি ফুটে উঠেছে এসব গ্রাফিতিতে। আগে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের দেয়াল দখল করে রেখেছিল ছাত্রলীগ। গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি আঁকার মধ্য দিয়ে সেই দেয়ালও দখলমুক্ত করে শিক্ষার্থীরা। 

অন্যতম শক্তিশালী গ্রাফিতি ছিল একটি গাছে কয়েকটি পাতা; এক একটিতে লেখা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আদিবাসী। নিচে লেখা ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। গ্রাফিতিটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতীক। এর মধ্য দিয়ে দেখানো হয়েছে, এ দেশে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির মানুষ বাস করে। কাউকে বাদ দেওয়া বা অস্বীকার করা যাবে না। এ গ্রাফিতিটি তার গুরুত্ব বিবেচনায় ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ পুস্তকের শেষ মলাটে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বইটি শিক্ষার্থীদের হাতে এখনও না পৌঁছালেও কিছুদিন থেকে নীলক্ষেতে বইয়ের দোকানে পাওয়া যাচ্ছিল। কীভাবে? সরকার জানে; কিন্তু মনে করছে, অন্যরা জানে না। সব সরকারই জনগণকে বোকা ভাবে এবং এটিই কাল হয়।

যা হোক, গ্রাফিতিটি বিষয়ে অন্যরা বেশি না জানলেও ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ নামে একটি সংগঠন জেনে মাঠে নেমে যায়। সংগঠনটির নাম আগে শোনা যায়নি। কিন্তু তাদের একটি প্রতিবাদের কারণেই সরকার তাড়াহুড়া করে পাঠ্যপুস্তক থেকে সেই গ্রাফিতি সরিয়ে অন্য গ্রাফিতি যুক্ত করে। তার মানে, জনগণ সংগঠনের নাম ও কার্যকলাপ সম্পর্কে না জানলেও সরকার নিশ্চয় ভালোভাবে জানে। তা না হলে সরকারের কাছে কেন তারা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল? তাদের খুশি করতে কেন সরকার ব্যস্ত হয়ে পড়ল?

সরকার শুধুই দাবি মেনে গ্রাফিতি সরিয়েছে, তা নয়। এই সংগঠনের প্রতি সরকারের আশীর্বাদ আরও স্পষ্ট হয় ১৫ জানুয়ারি বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে। পাঠপুস্তক থেকে গ্রাফিতি সরানোর প্রতিবাদে সেদিন এনসিটিবি ঘেরাও কর্মসূচি দিয়েছিল আদিবাসী শিক্ষার্থীরা। একই স্থানে সেদিন স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি পাল্টা দাবিদাওয়া নিয়ে যায় এবং আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। আদিবাসী শিক্ষার্থীরা আগে কর্মসূচি দেওয়ার পরও সরকারের তরফ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া হলো না কেন? বিভিন্ন ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ কর্মীদের হাতে থাকা লাঠির মাথায় জাতীয় পতাকা। পতাকা বাঁধা লাঠি দিয়েই আদিবাসী শিক্ষার্থীদের পেটানো হচ্ছে। তাদের হাতে ক্রিকেট স্টাম্পও ছিল। সেখানে পুলিশও উপস্থিত ছিল। কিন্তু আদিবাসী  শিক্ষার্থীদের রক্ষায় কোনো ভূমিকা নেয়নি। কেন নেয়নি? কারণ, এ সংগঠনের পেছনের শক্তি সম্পর্কে পুলিশ জানে। পরদিন এই হামলার প্রতিবাদে যখন আরেকটি প্রতিবাদী মিছিল হয়, সেই মিছিলেও হামলা হয়। পুলিশ টিয়ার শেলের গ্যাস ছোড়ে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। অন্যকে ‘ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা দেওয়া লোকজন নিজেদের ‘ফ্যাসিজম’ কীভাবে ঢাকবে? 

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হামলার ঘটনাটি সেদিনই হলো যেদিন সংবিধান সংস্কার কমিটি তাদের প্রস্তাবনা প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে। যে প্রস্তাবনায় বাংলাদেশের সংবিধানের প্রধান চার নীতির মধ্যে গণতন্ত্র রেখে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার এবং দরদের কথা যুক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত হয়েছে ‘বহুত্ববাদ’-এর মতো অতি কাঙ্ক্ষিত শব্দ। কিন্তু কোনোটির সঙ্গেই যেন কোনোটি মেলে না। একদিকে বহুত্ববাদের অঙ্গীকার, অন্যদিকে আদিবাসীদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করা। তাদের অন্যায়– তারা আদিবাসীর স্বীকৃতি চায়।

মনে রাখতেই হবে– জুলাইয়ের অভ্যুত্থান হয়েছিল সাম্য, মর্যাদা, প্রাপ্যতা, ন্যায্যতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাষ্ট্রের অঙ্গীকার থেকে। সেই অভ্যুত্থান থেকে তৈরি অন্তর্বর্তী সরকার বারবার বৈষম্যহীনতার অঙ্গীকার থেকে সরে আসছে কেন? সমতা ও মর্যাদার প্রতীক গ্রাফিতিটি কেন পাঠপুস্তকে রাখতে পারল না? 
সাম্প্রতিক একটি বিষয় বেশ নজরে পড়ছে। প্রায়ই কপালে বা লাঠিতে জাতীয় পতাকা বেঁধে অন্যদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। এটা কি জাতীয় পতাকার অবমাননা নয়? হেলমেট বাহিনীর জায়গায় তাহলে তৈরি হচ্ছে পতাকা বাহিনী?

এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর আমরা দেখেছি প্রধান উপদেষ্টাসহ অনেক উপদেষ্টাই আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করছেন। কিন্তু কয়েক দিন পর থেকেই লক্ষ্য করলাম, এ বিষয়ে তারাও আগের সরকারের মতো ‘গাঁইগুঁই’ শুরু করেছেন। আগের মতো ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ ব্যবহার করছেন। কিন্তু কেন? 
আমার তর্কের জায়গা স্পষ্ট। ঘটনার বিচার এবং দুই দিনের হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি প্রদানের দাবির পাশাপাশি প্রথম প্রশ্ন পাড়তে চাই, কেন যে কোনো ভুঁইফোঁড় সংগঠন ছোটখাটো ব্যানার নিয়ে দাঁড়ালেই সরকার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে? সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে বলেই ভুঁইফোঁড় সংগঠনটি আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করতে পেরেছে। নাকি তারা সরকারেরই লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করছে?

ঢাকা শহর বাদেও আদিবাসী অঞ্চলে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হলেই কেবল ঘটনার দুই দিন পর সরকার নিন্দা জানায়। ইতোমধ্যে দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিষয়গুলা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সরকারের কারণেই বিষয়টি এ পর্যায়ে আসতে পেরেছে। নিন্দা প্রকাশ ও দু’জনকে গ্রেপ্তার কি ক্ষততে মলম লাগানো? এ ধরনের আচরণ আগের সরকারও করত। মানুষ সেটি গ্রহণ না করায় তাদের বিদায় নিতে হয়েছে। বর্তমান সরকারকে মনে রাখতে হবে, তারা এসেছে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। অভ্যুত্থানের মূল দাবি ছিল– দেশ কোনো দল বা গোষ্ঠীর নয়; সবার হবে। কিন্তু কই সে বোধ? যে সরকার একটি গ্রাফিতিই রাখতে পারে না, তারা আবার বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করবে? যদি ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’র দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গ্রাফিতি তুলে নিতে পারে, তাহলে আদিবাসী ও অন্যদের দাবি মেনে সেটি আবার পাঠবইয়ে যুক্ত করতে সমস্যা কোথায়? আদিবাসী স্বীকৃতিতেই-বা বাধা কী? যদি এগুলো না করতে পারে, তাহলে ধরে নিতে হবে, বর্তমান সরকারও আগের সরকারের পথেই হাঁটছে।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান 
বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zobaidanasreen@gmail.

com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: য ক ত কর র সরক র সরক র র স গঠন

এছাড়াও পড়ুন:

৩৬ জুলাইকে জাতীয় মুক্তি দিবস ঘোষণাসহ ১৩ দাবি ইনকিলাব মঞ্চের

ছাত্র আন্দোলনের ৩৬ জুলাইকে জাতীয় মুক্তি দিবস ঘোষণাসহ ১৩ দফা দাবি জানিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ।

সোমবার (১৬ জুন) বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবির কথা জানায় সংগঠনটি।

সংগঠনটির মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদী বলেন, “আমাদের স্বাধীনতা দিবস আছে, বিজয় দিবস আছে, কিন্তু আমাদের মুক্তি ঘটেনি। তাই ঐতিকহাসিক ৩৬ জুলাইকে জাতীয় মুক্তি দিবস ঘোষণা করতে হবে। এ ছাড়াও জুলাই সনদ চূড়ান্ত করার আগে জনগণের মতামতের জন্য তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।”

আরো পড়ুন:

বেগম রোকেয়া পদকের জন্য আবেদনপত্র আহ্বান

নিরাপদ খাদ্য দিবস শনিবার: ‘নিরাপদ খাদ্য উচ্চ রক্তচাপ ঝুঁকি কমায়’

তিনি বলেন, “গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মৌলিক সংস্কার এবং ২০২৪ সালের গণহত্যার বিচার নিশ্চিত না করে দেশে যদি নির্বাচন আয়োজন করা হয়, তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘গাদ্দার’ হিসেবে ঘোষণা করা হবে। এই সনদে ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের নিরিখে বৈষম্যবিরোধী ইনসাফভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণের সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে।”

তিনি আরো বলেন, “সংবিধান থেকে জনবিরোধী ও জুলাই সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সব ধারা উপধারা বাতিল করে জুলাই সনদকে সাংবিধানের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব দল, মত এবং লিঙ্গের ন্যায্য শরিকানা নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে বলা হবে- আমরা বাংলাদেশের জনগণ এই ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান সম্পল্প করেছি।”

সংবাদ সম্মেলনে ইনকিলাব মঞ্চ ১৩টি প্রস্তাবনা তুলে ধরে, যা জুলাই সনদের কার্যকর প্রয়োগ ও জাতীয় ঐক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করে।

প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করা সব শহীদকে রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ সন্তান ঘোষণা করতে হবে;  যেসব জুলাই যোদ্ধার স্থায়ী অঙ্গহানি হয়েছে, তাদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে; ফ্যাসিবাদী আমলে সংঘটিত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ভোটারবিহীন অবৈধ নির্বাচন বাতিল করে সংশ্লিষ্ট দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

এছাড়া ফ্যাসিবাদী আমলের সকল মন্ত্রী, এমপি ও দোষী আমলাসহ রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের বিচারের আওতায় এনে অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ জব্দ করে তা শহীদ ও আহতদের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে; দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা রক্ষায় ভারতীয় আধিপত্যবিরোধী ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে; জুলাই, পিলখানা ও শাপলা গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করে দেশি-বিদেশি অপশক্তি চিহ্নিত করতে হবে; রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক সংস্কার করতে হবে যাতে ফ্যাসিবাদ আর স্বৈরতান্ত্রিকতা কখনও ফিরে না আসে; ৩৬ জুলাইকে জাতীয় মুক্তি দিবস ঘোষণা করতে হবে।

বাকি দাবিগুলো হলো- জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের ভিত্তিতে বৈষম্যবিরোধী কল্যাণ রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে; সংবিধান থেকে জনবিরোধী ও জুলাই সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সব ধারা বাতিল করে জুলাই সনদকে সংবিধানের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব দল, মত ও লিঙ্গের ন্যায্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; জুলাই সনদের ভাষাগত দুর্ব্যবহার পরিহার করে জনসাধারণের জন্য সহজ ভাষায় উপস্থাপন করতে হবে এবং সনদ চূড়ান্ত করার পূর্বে জনগণের মতামতের জন্য তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।

আগামী ২৫ জুনের মধ্যে জুলাই সনদ ঘোষণা করা না হলে রাজধানীর শাহবাগ মোড় থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ অভিমুখে ‘লাল মার্চ’ করার ঘোষণাও দিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ।

ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৩৬ জুলাইকে জাতীয় মুক্তি দিবস ঘোষণাসহ ১৩ দাবি ইনকিলাব মঞ্চের
  • নাগরিক সমাজ শাসকদের পক্ষে থাকে কেন?
  • আবু সাঈদ হত্যা: এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
  • রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা: এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের
  • গণঅভ্যুত্থানে আহত সামিউলের দিন কাটছে অনিশ্চয়তায়