জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের প্রতিবাদের অন্যতম মাধ্যম ছিল গ্রাফিতি। ঢাকা শহরে শুধু নয়, বাংলাদেশজুড়ে বিভিন্ন দেয়ালে লেখা হয়েছে মানুষের মনের কথা। শিক্ষার্থীরা কেমন বাংলাদেশ দেখতে চায়, সেটি ফুটে উঠেছে এসব গ্রাফিতিতে। আগে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের দেয়াল দখল করে রেখেছিল ছাত্রলীগ। গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি আঁকার মধ্য দিয়ে সেই দেয়ালও দখলমুক্ত করে শিক্ষার্থীরা।
অন্যতম শক্তিশালী গ্রাফিতি ছিল একটি গাছে কয়েকটি পাতা; এক একটিতে লেখা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আদিবাসী। নিচে লেখা ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। গ্রাফিতিটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতীক। এর মধ্য দিয়ে দেখানো হয়েছে, এ দেশে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির মানুষ বাস করে। কাউকে বাদ দেওয়া বা অস্বীকার করা যাবে না। এ গ্রাফিতিটি তার গুরুত্ব বিবেচনায় ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ পুস্তকের শেষ মলাটে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বইটি শিক্ষার্থীদের হাতে এখনও না পৌঁছালেও কিছুদিন থেকে নীলক্ষেতে বইয়ের দোকানে পাওয়া যাচ্ছিল। কীভাবে? সরকার জানে; কিন্তু মনে করছে, অন্যরা জানে না। সব সরকারই জনগণকে বোকা ভাবে এবং এটিই কাল হয়।
যা হোক, গ্রাফিতিটি বিষয়ে অন্যরা বেশি না জানলেও ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ নামে একটি সংগঠন জেনে মাঠে নেমে যায়। সংগঠনটির নাম আগে শোনা যায়নি। কিন্তু তাদের একটি প্রতিবাদের কারণেই সরকার তাড়াহুড়া করে পাঠ্যপুস্তক থেকে সেই গ্রাফিতি সরিয়ে অন্য গ্রাফিতি যুক্ত করে। তার মানে, জনগণ সংগঠনের নাম ও কার্যকলাপ সম্পর্কে না জানলেও সরকার নিশ্চয় ভালোভাবে জানে। তা না হলে সরকারের কাছে কেন তারা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল? তাদের খুশি করতে কেন সরকার ব্যস্ত হয়ে পড়ল?
সরকার শুধুই দাবি মেনে গ্রাফিতি সরিয়েছে, তা নয়। এই সংগঠনের প্রতি সরকারের আশীর্বাদ আরও স্পষ্ট হয় ১৫ জানুয়ারি বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে। পাঠপুস্তক থেকে গ্রাফিতি সরানোর প্রতিবাদে সেদিন এনসিটিবি ঘেরাও কর্মসূচি দিয়েছিল আদিবাসী শিক্ষার্থীরা। একই স্থানে সেদিন স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি পাল্টা দাবিদাওয়া নিয়ে যায় এবং আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। আদিবাসী শিক্ষার্থীরা আগে কর্মসূচি দেওয়ার পরও সরকারের তরফ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া হলো না কেন? বিভিন্ন ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ কর্মীদের হাতে থাকা লাঠির মাথায় জাতীয় পতাকা। পতাকা বাঁধা লাঠি দিয়েই আদিবাসী শিক্ষার্থীদের পেটানো হচ্ছে। তাদের হাতে ক্রিকেট স্টাম্পও ছিল। সেখানে পুলিশও উপস্থিত ছিল। কিন্তু আদিবাসী শিক্ষার্থীদের রক্ষায় কোনো ভূমিকা নেয়নি। কেন নেয়নি? কারণ, এ সংগঠনের পেছনের শক্তি সম্পর্কে পুলিশ জানে। পরদিন এই হামলার প্রতিবাদে যখন আরেকটি প্রতিবাদী মিছিল হয়, সেই মিছিলেও হামলা হয়। পুলিশ টিয়ার শেলের গ্যাস ছোড়ে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। অন্যকে ‘ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা দেওয়া লোকজন নিজেদের ‘ফ্যাসিজম’ কীভাবে ঢাকবে?
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হামলার ঘটনাটি সেদিনই হলো যেদিন সংবিধান সংস্কার কমিটি তাদের প্রস্তাবনা প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে। যে প্রস্তাবনায় বাংলাদেশের সংবিধানের প্রধান চার নীতির মধ্যে গণতন্ত্র রেখে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার এবং দরদের কথা যুক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত হয়েছে ‘বহুত্ববাদ’-এর মতো অতি কাঙ্ক্ষিত শব্দ। কিন্তু কোনোটির সঙ্গেই যেন কোনোটি মেলে না। একদিকে বহুত্ববাদের অঙ্গীকার, অন্যদিকে আদিবাসীদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করা। তাদের অন্যায়– তারা আদিবাসীর স্বীকৃতি চায়।
মনে রাখতেই হবে– জুলাইয়ের অভ্যুত্থান হয়েছিল সাম্য, মর্যাদা, প্রাপ্যতা, ন্যায্যতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাষ্ট্রের অঙ্গীকার থেকে। সেই অভ্যুত্থান থেকে তৈরি অন্তর্বর্তী সরকার বারবার বৈষম্যহীনতার অঙ্গীকার থেকে সরে আসছে কেন? সমতা ও মর্যাদার প্রতীক গ্রাফিতিটি কেন পাঠপুস্তকে রাখতে পারল না?
সাম্প্রতিক একটি বিষয় বেশ নজরে পড়ছে। প্রায়ই কপালে বা লাঠিতে জাতীয় পতাকা বেঁধে অন্যদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। এটা কি জাতীয় পতাকার অবমাননা নয়? হেলমেট বাহিনীর জায়গায় তাহলে তৈরি হচ্ছে পতাকা বাহিনী?
এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর আমরা দেখেছি প্রধান উপদেষ্টাসহ অনেক উপদেষ্টাই আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করছেন। কিন্তু কয়েক দিন পর থেকেই লক্ষ্য করলাম, এ বিষয়ে তারাও আগের সরকারের মতো ‘গাঁইগুঁই’ শুরু করেছেন। আগের মতো ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ ব্যবহার করছেন। কিন্তু কেন?
আমার তর্কের জায়গা স্পষ্ট। ঘটনার বিচার এবং দুই দিনের হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি প্রদানের দাবির পাশাপাশি প্রথম প্রশ্ন পাড়তে চাই, কেন যে কোনো ভুঁইফোঁড় সংগঠন ছোটখাটো ব্যানার নিয়ে দাঁড়ালেই সরকার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে? সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে বলেই ভুঁইফোঁড় সংগঠনটি আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করতে পেরেছে। নাকি তারা সরকারেরই লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করছে?
ঢাকা শহর বাদেও আদিবাসী অঞ্চলে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হলেই কেবল ঘটনার দুই দিন পর সরকার নিন্দা জানায়। ইতোমধ্যে দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিষয়গুলা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সরকারের কারণেই বিষয়টি এ পর্যায়ে আসতে পেরেছে। নিন্দা প্রকাশ ও দু’জনকে গ্রেপ্তার কি ক্ষততে মলম লাগানো? এ ধরনের আচরণ আগের সরকারও করত। মানুষ সেটি গ্রহণ না করায় তাদের বিদায় নিতে হয়েছে। বর্তমান সরকারকে মনে রাখতে হবে, তারা এসেছে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। অভ্যুত্থানের মূল দাবি ছিল– দেশ কোনো দল বা গোষ্ঠীর নয়; সবার হবে। কিন্তু কই সে বোধ? যে সরকার একটি গ্রাফিতিই রাখতে পারে না, তারা আবার বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করবে? যদি ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’র দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গ্রাফিতি তুলে নিতে পারে, তাহলে আদিবাসী ও অন্যদের দাবি মেনে সেটি আবার পাঠবইয়ে যুক্ত করতে সমস্যা কোথায়? আদিবাসী স্বীকৃতিতেই-বা বাধা কী? যদি এগুলো না করতে পারে, তাহলে ধরে নিতে হবে, বর্তমান সরকারও আগের সরকারের পথেই হাঁটছে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান
বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zobaidanasreen@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: য ক ত কর র সরক র সরক র র স গঠন
এছাড়াও পড়ুন:
গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ঢাবি শিবিরের ৩ দিনব্যাপী কর্মসূচি
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখা।
বুধবার (৩০ জুলাই) বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন শাখা সভাপতি এসএম ফরহাদ।
আগামী ৫, ৬ ও ৭ আগস্ট এই কর্মসূচিগুলো অনুষ্ঠিত হবে। আয়োজনে থাকছে প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন, বিপ্লবী নাটক, গান, কবিতা, আলোচনা সভা ও বিশেষ চিত্র প্রদর্শনী। কর্মসূচির সূচনা হবে ৫ আগস্ট (মঙ্গলবার) ভোর ৫টায় প্রতীকী সাইকেল র্যালির মাধ্যমে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শুরু হয়ে গণভবন পর্যন্ত যাবে।
আরো পড়ুন:
মেয়াদোত্তীর্ণ অগ্নিনির্বাপকে চলছে বেরোবি
তাহলে তো স্পন্সর নিয়ে প্রোগ্রাম করলেই চাঁদাবাজি: সালাউদ্দিন
সকাল ৯টায় টিএসসিতে থাকবে সাধারণ নাস্তার আয়োজন। এর পরপরই প্রদর্শিত হবে ‘জুলাই বিপ্লব’ ভিত্তিক একটি প্রামাণ্যচিত্র। একইসঙ্গে বিপ্লবী গান ও কবিতা পরিবেশিত হবে । সকাল ১০টা থেকে শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের মুখে অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা শোনার আয়োজন থাকবে।
দুপুর ২টায় একটি মাইম পরিবেশনা ও নাটক মঞ্চস্থ হবে। এরপর বিকেল সাড়ে ৩টা ও সাড়ে ৫টায় পরপর আরো দুটি নাটক প্রদর্শিত হবে। সন্ধ্যা ৬টায় ব্যতিক্রমী আয়োজন ‘প্ল্যানচ্যাট বিতর্ক’ অনুষ্ঠিত হবে। এটি একটি প্রতীকী বিতর্ক, যেখানে গণআন্দোলনে নিহতদের উত্তরাধিকার ও আত্মিক উপস্থিতিকে ঘিরে আলাপ-প্রতিআলাপের একটি রূপক পরিসর গড়ে উঠবে ।
৬ আগস্ট দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচির শুরুতেই থাকবে রাজনৈতিক ও দার্শনিক আলোচনা সভা। সকাল ১০টার দিকে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও ফ্যাসিবাদ পলায়নের ১ বছর: প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বিকেল ৩টার দিকে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ছাত্ররাজনীতি ও ডাকসু নির্বাচন’ বিষয়ে আলোচনা হবে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ‘নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তে ইসলাম প্রসঙ্গ’ শীর্ষক মতবিনিময়ের মাধ্যমে পর্দা নামবে দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচির।
কর্মসূচির তৃতীয় দিন ৭ আগস্ট দিনব্যাপী চলবে বিশেষ চিত্র প্রদর্শনী ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন। সেখানে ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ ও গণআন্দোলন সংশ্লিষ্ট নানা দলিল, ছবি ও ভিডিও উপস্থাপন করা হবে।
সার্বিক বিষয়ে ঢাবি শাখা ছাত্রশিবির সভাপতি এসএম ফরহাদ বলেন, “২০২৪ সালের জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া গণজাগরণ ও ছাত্র প্রতিরোধ ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক। সেই ঘটনার স্মরণে এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের পথরেখা নির্ধারণের প্রয়াসে ঢাবির টিএসসি প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাবি শাখা আয়োজন করতে যাচ্ছে তিন দিনব্যাপী ‘আমরাই ৩৬ জুলাই: আমরা থামবো না’ শীর্ষক অনুষ্ঠান।”
তিনি বলেন, “এ আয়োজন হবে শিল্প, সংস্কৃতি, স্মৃতি ও রাজনৈতিক ভাবনার এক সংমিশ্রণ। জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের অভিজ্ঞতা আমাদের অনুপ্রেরণা। আর সংস্কৃতির মাধ্যমে আমরা সেই প্রতিরোধ চেতনাকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই।”
ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী