শাহবাগ ছাড়লেন প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকেরা
Published: 24th, January 2025 GMT
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন কাঠামো দশম গ্রেডে উন্নীত করার দাবিতে আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে শাহবাগ ছেড়েছেন শিক্ষকেরা।
শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) রাত পৌনে ৮টায় রাজধানীর শাহবাগে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে থেকে ফিরে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষক প্রতিনিধি মনিবুল হক বসুনিয়া।
তিনি বলেন, “আজ আমরা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে দশম গ্রেড বাস্তবায়নের দাবির স্মারকলিপি জমা দিয়েছি। বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টা বিদেশে অবস্থান করছেন। সেজন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। আমরা কর্তৃপক্ষের অনুরোধের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে দশম গ্রেট বাস্তবায়নের ঘোষণা দিতে হবে। যদি এই সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হয় তাহলে এ পরবর্তী সময়ে কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হব।”
আরো পড়ুন:
যমুনা অভিমুখে যেতে বাধা, প্রাথমিক শিক্ষকরা শাহবাগে
দশম গ্রেডের দাবিতে রাজপথে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা
তিনি আরো বলেন, “আমরা আর ঢাকায় আসবো না। স্ব-স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে কর্মবিরতি পালন করব। তবে আমরা প্রত্যাশা করছি, এর মধ্যেই আমাদের এই দাবি বাস্তবায়ন করা হবে।”
এ সময় আরেক শিক্ষক প্রতিনিধি খাইরুন নাহার লিপি বলেন, “আমরা আজ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছি। তবে এর জেরে যদি দেশের কোন প্রান্তে আমাদের কোন সহকর্মীকে হয়রানি করা হয় তাহলে আমরা রাস্তায় নেমে আসব। আমরা প্রত্যাশা করছি, আমাদের এই দাবি বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষ সদয় হবেন।”
এর আগে রাজধানীর জাতীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শিক্ষকরা যমুনা অভিমুখে রওনা হলে শাহবাগে তাদের আটকে দেয় পুলিশ। সেখানেই তারা বসে পড়েন। পরে সরকারের সঙ্গে কথা বলে যমুনায় স্মারকলিপি দিতে যাওয়ার অনুমতি পান বিক্ষোভরত শিক্ষকরা।
শুক্রবার সকাল থেকে রাজপথে রয়েছেন সরকারি প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা। তাদের দাবি একটাই- ‘পে-স্কেলের দশম গ্রেডে অন্তর্ভুক্তি’।‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি দিয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হন প্রাথমিকের শিক্ষকরা। বিশেষ করে ঢাকা ও আশপাশের জেলার শিক্ষকরাই সমাবেশ ভরে তোলেন। সমাবেশে সংহতি জানিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগ দেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর।
প্রাথমিক শিক্ষকরা কয়েক বছর ধরে বেতন বৈষম্য দূরীকরণ ও দশম গ্রেডে উন্নীতকরণের জন্য আন্দোলন করে আসছে। ২০২৪ সালজুড়ে ঢাকায় অনেক কর্মসূচি দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমন্বয় পরিষদ। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ছিল তেমন একটি কর্মসূচি। সেদিনই তারা দাবি পূরণের লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো.
ঢাকা/রায়হান/সাইফ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর দশম গ র ড শ ক ষকর সহক র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আরও বিস্তৃত হয়েছে শ্রমিকের সংগ্রামের জমিন
মে দিবস। পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষের দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন শ্রমিকেরা। পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ প্রাণ হারান। কিন্তু সেই রক্তের বিনিময়েই কাগজে–কলমে হলেও প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমের মর্যাদা, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি ও সংগঠনের অধিকার। একসময় এসব দাবিই রূপ নেয় আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের ভিত্তিতে।
কিন্তু ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা যখন এই দিনে ফিরে তাকাই, তখন প্রশ্ন আসে, এখনো কি সেই সব দাবি প্রাসঙ্গিক? নাকি সময় পাল্টে দিয়েছে সব? এখন তো কাজের ধরনই বদলে গেছে—একদিকে অটোমেশন, অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়যাত্রা। উৎপাদনের পদ্ধতি যেভাবে বদলেছে, তাতে পুরোনো ধরনের শ্রমিক যেন ক্রমে অদৃশ্য হয়ে পড়ছেন।
আজকের দুনিয়ায় পুঁজি এক ক্লিকে দেশান্তরিত হয়, কারখানা গড়ে ওঠে যেখানে মজুরি কম এবং আইনের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল। মানুষ এখন আর কেবল শ্রমিক নয়; তাঁদের বলা হচ্ছে ‘ফ্রিল্যান্সার’, ‘কন্ট্রিবিউটর’, ‘পার্টনার’, ‘ডেলিভারি ম্যান’। কিন্তু আসলে, এদের অনেকেই এক নতুন ধরনের দিনমজুর; যাঁদের নেই নিরাপত্তা, নেই সুনির্দিষ্ট অধিকার। কাজ করছেন তাঁরা—কখনো রাস্তায় খাবার পৌঁছে দিয়ে, কখনো কম্পিউটারে চ্যাটবট প্রশিক্ষণ দিয়ে, আবার কখনো অ্যালগরিদম পরিশোধনে; কিন্তু কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন। তাঁরা জানেন না যে তাঁদের কাজের ফল কোথায় যাবে, কীভাবে ব্যবহৃত হবে।
এই ব্যবস্থার একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে অ্যামাজন। তাদের গুদাম ও সরবরাহ চেইনে রোবট, ড্রোন ও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। শ্রমিকেরা সেখানে নির্ধারিত সময়ের বেশি কাজ করতে বাধ্য হন, মেশিনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অথচ যখন তাঁরা সংগঠিত হতে চান, তখন কোম্পানির বিরুদ্ধে ওঠে লবিং, বিরোধিতা, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ। ২০২৩ সালে অ্যামাজনের একাধিক গুদামে ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টাকে রুখে দিতে কোম্পানিটি কোটি কোটি ডলার খরচ করে আইনি দল গঠন করে।
মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়; সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে নাশুধু অ্যামাজন নয়, গোটা দুনিয়াতেই শ্রমের এক নতুন রূপ তৈরি হচ্ছে—ডিজিটাল ও প্ল্যাটফর্মভিত্তিক শ্রম। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকেরা কাজ করেন উবার, ফুডপান্ডা, আপওয়ার্ক বা ফাইভারের মতো অ্যাপে যুক্ত হয়ে। অথচ তাঁদের নেই কোনো কর্মস্থল, নেই কর্মঘণ্টার নিশ্চয়তা, নেই অসুস্থতার ছুটি বা পেনশনের মতো সামাজিক সুরক্ষা। বাস্তবে তাঁরা একা, বিচ্ছিন্ন। প্রতিযোগিতার চাপে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় অনিরাপত্তার ভেতর।
২০২৩ সালের একটি আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের অন্তত ৮০% গিগ-ওয়ার্কার দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। অথচ তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ মাস শেষে কোনো নির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি পান না। গ্লোবাল গিগ ইকোনমির এই বাস্তবতা বাংলাদেশেও দৃশ্যমান। আমাদের শহরগুলোয় এখন হাজারো বাইক বা সাইকেলচালক কাজ করছেন খাবার কিংবা পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য, কিন্তু তাঁরা কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন।
এর পাশাপাশি আরও একটি বড় পরিবর্তন এনেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান। প্রশ্ন উঠেছে, এআই কি শ্রমিকের বন্ধু, না প্রতিদ্বন্দ্বী? যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার এক গবেষণা অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরে এআই কমপক্ষে ৮০ কোটি মানুষের কাজের ধরন পাল্টে দেবে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ সম্পূর্ণভাবে কাজ হারাতে পারেন। হোয়াইট-কলার পেশাগুলো যেমন হিসাবরক্ষণ, গ্রাহকসেবা, এমনকি সাংবাদিকতার কাজও এই প্রযুক্তির কারণে সংকটে পড়ছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২৩ সালের ‘দ্য ফিউচার অব জবস’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৮ কোটি ৫০ লাখ কাজ হারিয়ে যাবে প্রযুক্তি ও অটোমেশনের কারণে। তবে একটা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। যদি উৎপাদিত পণ্যের খরিদ্দার না থাকে, তাহলে উৎপাদন করে কীভাবে মুনাফা আসবে? আর শ্রমিক না থাকলে কিনবে কে? তবে একই সময়ে ৯ কোটি ৭০ লাখ নতুন ধরনের কাজের সৃষ্টি হতে পারে। কাজগুলো হবে ডেটা অ্যানালিটিকস, প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালনা এবং সৃজনশীল ও মানবিক দক্ষতানির্ভর কাজ। এই নতুন শ্রমিকদের অবস্থার কথা ওপরে বলা হয়েছে।
কিন্তু এই নতুন কাজের মালিকানা কার হাতে? শ্রমিকদের নয়, রাষ্ট্রেরও নয়—এই ক্ষমতা এখন করপোরেট অলিগার্কদের হাতে কেন্দ্রীভূত। যুক্তরাষ্ট্রে ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, মার্ক জাকারবার্গদের মতো প্রযুক্তি ধনকুবেররা শুধু প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রকই নন, তাঁরা রাজনীতিতেও সরাসরি প্রভাব ফেলছেন। করপোরেট লবিংয়ের মাধ্যমে আইন তৈরির পেছনে তাঁদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে; যেমন ট্যাক্স ছাড়, শ্রম আইন শিথিলকরণ বা প্রতিযোগিতা নীতির ধ্বংস।
বাংলাদেশেও দৃশ্যপট খুব আলাদা নয়। তৈরি পোশাকশিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাঁরা দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের ভিত্তি। কিন্তু তাঁরা এখনো ন্যূনতম মানবিক মজুরি পান না। গত বছর শ্রমিকেরা ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা মজুরি চাইলেও সরকার তা নামিয়ে ১২ হাজারে নিয়ে আসে। আন্দোলনের জবাবে আসে পুলিশি দমন, ধরপাকড়, ভয়ের পরিবেশ। মালিকেরা নতুন প্রযুক্তি বসিয়ে আরও কম শ্রমিক দিয়ে আরও বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করবেন। আগে–পরে এটা অবধারিত।
এই প্রেক্ষাপটে মে দিবস আজ আমাদের সামনে এক নতুন প্রশ্ন তোলে—শ্রমিক আসলে কে? তাঁর অধিকার কী? আর লড়াইটা কিসের জন্য?
যদি শ্রমিকের সংজ্ঞাই বদলে যায়, তাহলে লড়াইয়ের রূপও কি পাল্টাতে হবে না? একসময়ের আট ঘণ্টার কাজের দাবি এখন হয়তো পুরোনো মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে বহু মানুষ এখনো দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। কেউ কাজ পাচ্ছেন না, কেউ কাজ করেও মাস শেষে ঠিকমতো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। কেউ এমন এক ধরনের ডিজিটাল শ্রম করছেন, যার নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা তাঁর নয়, তিনি জানেনই না যে কার জন্য কাজ করছেন।
তাই আজ মে দিবস শুধু অতীত স্মরণের দিন নয়—এটি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনারও দিন। এটি নতুন ধরনের দাবির জায়গা—ডিজিটাল শ্রমের স্বীকৃতি, গিগ-ওয়ার্কারদের অধিকার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি। আর অবশ্যই আমাদের মতো দেশে গায়ে খাটা শ্রমের ন্যায্য মজুরির দাবি।
মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়, সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক, শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে না।
এই সত্য যত দিন থাকবে, মে দিবস তত দিন থাকবে; নতুন প্রশ্ন নিয়ে, নতুন লড়াই নিয়ে।
জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী