দাগি অপরাধীদের অপতৎপরতার পাশাপাশি ধারাবাহিক ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজির ঘটনায় জনমনে যেই আতঙ্ক ছড়াইতেছে উহা সকলের জন্যই উদ্বেগজনক। শনিবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দীর্ঘদিন কারাগারে থাকিবার পর সম্প্রতি যেই সকল চিহ্নিত সন্ত্রাসী জামিনে বাহির হইয়া আসিয়াছে, তাহারা সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া ফের অপরাধজগৎ দাপাইয়া বেড়াইতেছে। ফলস্বরূপ খুন, জখম, দখল, ছিনতাই, চাঁদাবাজির ন্যায় অপরাধ বাড়িতেছে; এমনকি চাঁদা ও ভাগবাটোয়ারা লইয়া নিজেদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের পাশাপাশি খুনোখুনিও চলিতেছে। পুলিশের অপরাধ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাইতেছে, গত সেপ্টেম্বর হইতে ডিসেম্বর অবধি চার মাসে ঢাকাসহ সারাদেশে ৯৪৭ জন খুন হইয়াছেন। ডাকাতি ও ছিনতাই ঘটনায় ওই চার মাসে মামলা হইয়াছে ৭৯৬টি, অপহরণের ঘটনায় মামলা হয় ৩০২টি। এই সকল পরিসংখ্যানই বলিয়া দেয়, নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা কতটা হুমকির সম্মুখীন। বলিয়া রাখা প্রয়োজন, মামলার সংখ্যা দিয়া দেশের প্রকৃত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কখনোই নিরূপণ করা যায় না। কারণ– প্রথমত, দুর্ভাগ্যবশত, ফৌজদারি মামলার সংখ্যা বৃদ্ধিকে এই দেশের পুলিশ স্টেশন তথা থানাগুলির পরিচালকদের অনেকে বরাবরই নিজেদের ব্যর্থতা হিসাবে দেখে। তাই মামলা গ্রহণে তাহাদের মধ্যে নিরুৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। দ্বিতীয়ত, মূলত দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির কারণে ভুক্তভোগীদের মধ্যে আইনের আশ্রয় গ্রহণে উৎসাহ কম দেখা যায়। ফলে নিছক মামলার সংখ্যা দিয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথাযথভাবে উপলব্ধি করা যায় না। প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ হইবার আশঙ্কা উড়াইয়া দেওয়া যাইবে না।
আমরা জানি, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের থানা, ফাঁড়িসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্র-গুলি লুটের ঘটনা ঘটিয়াছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সেই সময় লুট হওয়া অস্ত্রের সংখ্যা প্রায় ছয় সহস্র, গুলির পরিমাণ ছয় লক্ষাধিক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় অদ্যাবধি প্রায় সাড়ে ৪ সহস্র
অস্ত্র উদ্ধার হইলেও, বেহাত রহিয়াছে প্রায় এক সহস্র চারশত অস্ত্র। আশঙ্কা করা হয়, সেই সকল অস্ত্র-গুলি হাতবদল হইয়া সন্ত্রাসী, এমনকি কিশোর গ্যাংয়ের হস্তে চলিয়া যাইতে পারে। এই অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি অস্বাভাবিক নহে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বলিয়াছেন, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে’ তাহারা সতর্ক রহিয়াছেন। তিনি ওই অপরাধীদের নজরদারিতে রাখা হইয়াছে বলিয়া জানাইয়াছেন। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালকও বলিয়াছেন, যাহারা নতুনভাবে অপরাধে জড়াইতেছে, তাহাদের উপর নজরদারি রহিয়াছে। বাস্তবতা হইল, পুলিশ ও র্যাবের কথিত নজরদারির মধ্যেই অপরাধজনক ঘটনা বৃদ্ধি পাইতেছে। নাগরিকেরা জানমালের নিরাপত্তা লইয়া ক্রমবর্ধমান শঙ্কাবোধ করিতেছেন। এইদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এহেন অবনতি এমন সময়ে ঘটিতেছে, যখন দেশে বিবিধ কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ বিঘ্নিত হইতেছে। পাশাপাশি বিনিয়োগেও ভাটার টান লক্ষ্য করা যাইতেছে, বিশেষত কর্মসংস্থানের উপর যাহার অভিঘাত ভয়াবহ হইতে পারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত না হইলে একদিকে নতুন নতুন অপরাধী জন্ম লইতে পারে, অন্যদিকে উপায়হীন নাগরিকদের মধ্যে আইন স্বীয় হস্তে লইবার প্রবণতা বৃদ্ধি পাইতে পারে। এই অবস্থায় সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অপরাধ আরও বাড়িয়া যাইতে পারে।
সত্য, বাহিনী হিসেবে বিশেষত পুলিশ এখনও সম্পূর্ণ সংগঠিত রূপ ফিরিয়া পায় নাই। কিন্তু এই অজুহাত দিয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্তাদের দায়িত্ব এড়াইবার অবকাশ নাই। এখনও সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাহাদের সহযোগিতা করিতে মাঠে আছেন, যাহারা ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাও পাইয়াছেন। আমাদের বিশ্বাস, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিন বাতিলের আইনি উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি সর্বত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল কার্যক্রম জোরদার এবং গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হইলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব নহে। সর্বোপরি আটক করিতে হইবে ডোরা নির্বিশেষে। যেই দল বা গোষ্ঠীরই হউক, অপরাধীর পরিচয় অপরাধ দিয়াই নির্ধারিত হওয়া উচিত।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর স থ ত নজরদ র অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্যের ৪৫% রাজনৈতিক
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত ভুল তথ্য ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এ সময়ে যাচাই করা ভুল তথ্যের ৪৫ শতাংশই ছিল রাজনৈতিক। গতকাল বুধবার তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত ভুল তথ্য ছিল ১ শতাংশ। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে তা বেড়ে ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সংখ্যার হিসাবে গত প্রান্তিকে এ ধরনের ভুল তথ্য ছিল মাত্র ১১টি। সেটি এ বছরের প্রথম তিন মাসে সাত গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৭টিতে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট আটটি ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পেয়েছে ডিসমিসল্যাব।
সংস্থাটির গবেষণায় দেখা গেছে, জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ফ্যাক্ট চেক প্রতিষ্ঠানগুলো ১ হাজার ২৩৬টি তথ্য যাচাইয়ের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে স্বতন্ত্র ভুল তথ্য পাওয়া গেছে ৮৬৭টি, যা আগের প্রান্তিকে রেকর্ড করা ৮১৬টির তুলনায় কিছুটা বেশি। ভুল তথ্যের প্রায় অর্ধেকই (৪৫ শতাংশ) রাজনীতি সম্পর্কিত ছিল। এর পর ছিল ধর্ম-সংক্রান্ত ভুল তথ্য (১৩ শতাংশ), যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় সামান্য কম।
অপরাধ-সম্পর্কিত ভুল তথ্য বেড়েছে
বছরের প্রথম তিন মাসে প্রচারিত খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ও ডাকাতি-সংক্রান্ত খবর ছিল ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনা ছিল ভারতের, যা বাংলাদেশের বলে ভুলভাবে প্রচার করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে একটি ইউটিউব চ্যানেলে হোটেল থেকে লাফিয়ে পড়া এক ভিডিও প্রচার করে বাংলাদেশের বলে দাবি করা হয়, কিন্তু সেটি ছিল মূলত ইন্দোনেশিয়ার।
রাজনৈতিক ভুল তথ্য
চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে যাচাই করা ভুল তথ্যের ৪৫ শতাংশই রাজনৈতিক। আগের বছরও রাজনীতি-সংক্রান্ত ভুল তথ্য প্রচারিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ (৩৪.৮ শতাংশ) ও অন্তর্বর্তী সরকারকে (২১.৮ শতাংশ) নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। তবে আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করে প্রচারিত ভুল তথ্যগুলোর অধিকাংশই (৬৮ শতাংশ) ছিল ইতিবাচক। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি, জামায়াত-শিবির ও সমন্বয়কদের নিয়ে ছড়ানো অধিকাংশ ভুল তথ্য ছিল নেতিবাচক।
ধর্ম-সংক্রান্ত ভুল তথ্য
ধর্ম-সম্পর্কিত ভুল তথ্যের সংখ্যা সর্বশেষ প্রান্তিকে কিছুটা কমেছে। গত বছরের শেষ প্রান্তিকে ধর্ম-সংক্রান্ত ভুল তথ্যের পরিমাণ ছিল মোট যাচাইকৃত ভুল তথ্যের ১৮ শতাংশ, যা চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে। তবে এর ধরন ছিল একই রকমের। যেমন, পুরোনো বা সম্পাদিত ছবি-ভিডিও সাম্প্রতিক বলে প্রচার করা।
বেড়েছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভুল তথ্য
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভুল তথ্যের পরিমাণ বাড়তে দেখা গেছে। ২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভুল তথ্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ২৭টি ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদন। সেখানে এ বছরের প্রথম তিন মাসে এই সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪টিতে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব ভুল তথ্যের ২৪ শতাংশ ছিল রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট।