কে এম সফিউল্লাহ যে কারণে স্মরিত হবেন
Published: 27th, January 2025 GMT
চলে গেলেন দেশের প্রথম সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বীরউত্তম। রোববার সকালে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৯০ বছর বয়সী কে এম সফিউল্লাহ গড় বাঙালির তুলনায় বেশ দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন বললে ভুল হবে না। কর্মেও তিনি ছিলেন গড় বাঙালির তুলনায়, এমনকি সমসাময়িক সেনা কর্মকর্তা বা মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের তুলনায় দীর্ঘ।
তবুও বলতে হবে, অনেকটা নীরবে-নিভৃতেই জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ঘটনা মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এ নায়ককে বিদায় নিতে হলো। মুক্তিযুদ্ধে কে এম সফিউল্লাহ ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন, আমরা জানি। একই সঙ্গে তিনি স্বনামের আদ্যাক্ষর দিয়ে গঠিত ব্রিগেড ‘এস ফোর্স’-এর অধিনায়কও ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মাত্র তিনটি ব্রিগেড ছিল। বাকি দুটি ছিল ‘জেড ফোর্স’ ও ‘কে ফোর্স’, যেগুলো গঠিত হয় যথাক্রমে অন্য দুই বীর তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান ও মেজর খালেদ মোশাররফের নামে। তিন ব্রিগেড অধিনায়কই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীতে তাদের অধীন সেনাদের নিয়ে। সম্ভবত এ বিষয়টিই মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী সমমর্যাদার আরও কয়েকজন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা থেকে তাদের স্বতন্ত্র করে তোলে।
এ কথাও বলতে হয়, মুক্তিযুদ্ধের তিন ব্রিগেডের নেতাদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ও খালেদ মোশাররফকে আমাদের কুটিল সামরিক-বেসামরিক রাজনীতি বেশি দিন বাঁচতে দেয়নি। কে এম সফিউল্লাহ সৌভাগ্যক্রমে দীর্ঘায়ু পেলেও ওই একই কারণে তাঁকেও অন্তত জীবনের শেষাংশটা কাটাতে হয়েছে পাদপ্রদীপের আড়ালে।
কাজী মোহাম্মদ সফিউল্লাহ তথা কে এম সফিউল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ গ্রামে। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করে তিনি ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে নিযুক্ত হন। কমিশনপ্রাপ্তির পর ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে, স্টাফে এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করেন। একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চে তিনি ছিলেন জয়দেবপুর সেনানিবাসে; দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীন সংশ্লিষ্ট ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড-ইন কমান্ড হিসেবে। সেখান থেকেই প্রায় পুরো ব্যাটালিয়ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সফিউল্লাহর একাধিক বই আছে। একটির নাম ‘বাংলাদেশ অ্যাট ওয়ার’– ইংরেজিতে লেখা। বাংলা অনুবাদে এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’। বইটিতে তাঁর মুক্তিযুদ্ধে যোগদান নিযে যে বর্ণনা আছে, তা এক কথায় অসাধারণ। পড়তে গিয়ে যে কারও মনে হবে, তিনি যেন ১৯৭১ সালের সেই মার্চে ফিরে গেছেন।
গাজীপুরে সেই মার্চের ১৯ তারিখে সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয় শ্রমিক-জনতার রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধের কথা আমরা জানি, যাকে বলা হয় বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ। মনে রাখতে হবে– তখনও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। ফলে কে এম সফিউল্লাহদের পক্ষে বিদ্রোহ বা বিক্ষোভকারী জনতার ওপর গুলি চালাতে ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশ অমান্য করাও ছিল অসম্ভব। আবার জনতার ক্ষোভের আগুন নিভে গেলে বাঙালি সেনারাই বিপদে পড়বেন– সেটাও মাথায় ছিল। পুরো পরিস্থিতি কে এম সফিউল্লাহ অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সামাল দেন। সফিউল্লাহরা অস্ত্র নিয়ে ২৮ মার্চ বিদ্রোহ করে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
সফিউল্লাহর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অর্থাৎ ব্যাটালিয়ন কমান্ডারও বাঙালি ছিলেন। কিন্তু পরিবারের নিরাপত্তার অজুহাতে তিনি সঙ্গে যাননি। অথচ সফিউল্লাহ পরিবারের মায়া না করেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বইটি পড়লেই বোঝা যায়, মূলত মার্চের শুরু থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর যা তাঁর কাছে পাখির চোখ হয়ে ওঠে।
যুদ্ধকালে সফিউল্লাহ এমনকি কখনও কখনও সম্মুখ যুদ্ধে শামিল হন। সেক্টর বা ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিরাপদ দূরত্ব থেকে যুদ্ধ পরিচালনার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্পষ্টত, প্রকৃতই তিনি দেশমাতৃকার মুক্তির বেদিতে জীবন উৎসর্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। তিনি সম্ভবত সেই বিরল সেনা কর্মকর্তাদের একজন, যিনি একই সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির ১৯ মার্চের প্রথম প্রতিরোধ এবং ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণকালে প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন।
এটা ঠিক, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি সেনাপ্রধান ছিলেন, তাই বাঙালির ইতিহাসের অন্যতম বর্বরোচিত ওই ঘটনার দায় তিনি এড়াতে পারেন না। কিন্তু সেই সময় সেনাবাহিনীতে যে চরম বিশৃঙ্খলা ছিল, তা সফিউল্লাহর একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর ছিল না। এখানে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংশ্লিষ্টতা ছিল। এমনকি সেনাপ্রধানকে এড়িয়েও সেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেনাবাহিনীর বিষয়ে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এক কথায় বলা যায়, পুরো সেনাবাহিনী যেমন সফিউল্লাহর একক নিয়ন্ত্রণে ছিল না, তেমনি মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে তখন ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সুযোগও ছিল।
এ ক্ষেত্রেও জেনারেল সফিউল্লাহর যে বৈশিষ্ট্য অনন্য তা হলো, ১৫ আগস্টের ঘটনায় নিজের ব্যর্থতা বরাবর অকপটে স্বীকার করে গেছেন। তদুপরি, নীতি ও নেতার প্রতি তাঁর আনুগত্য আমৃত্যু বহাল ছিল। মুক্তিযুদ্ধ ছিল তাঁর চিন্তা-চেতনায়। সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে এর নজির ছড়িয়ে আছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হন সফিউল্লাহ। ক্ষমতাসীন দলের অন্য এমপিদের সঙ্গে তুলনা করলেও তাঁর অনন্যতা স্পষ্ট হয়।
দেশের প্রথম সেনাপ্রধান, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য বীর হিসেবে কে এম সফিউল্লাহ হয়তো যোগ্য ফিউনারাল বা বিদায়ানুষ্ঠান পাননি; তবে একই কারণে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তিনি যে স্মরিত হবেন– এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কম ন ড র র রহম ন র প রথম র জন ত
এছাড়াও পড়ুন:
সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস
বাবা সন্তানের ওপর ছায়ার মতো স্নেহময় এক উপস্থিতি। নিঃশর্ত ভরসার প্রতীক। সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনের প্রয়োজনে নিজের বর্তমান, এমনকি নিজের স্বপ্নও নীরবে উৎসর্গ করে দিতে পারেন যিনি– আজ তাদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর দিন। বাবা দিবস উপলক্ষে সমতা’র বিশেষ আয়োজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা বৃহত্তর বরিশালে। এখন সেই জায়গাটা পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি পৌরসভার সমুদয়কাঠি গ্রাম। তখনকার সামাজিক পরিসরে আমাদের পরিবারের অবস্থা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভালো ছিল। আমার বাবা বিজয় কুমার আইচ তখন পিরোজপুরে কাজ করতেন। তাঁর রেশনের দোকান ছিল। প্রতি শনিবার বাড়ি আসতেন। আমরা বাবার আশায় বসে থাকতাম। এটি ছিল আমাদের জন্য একরকম আশীর্বাদের মতো।
বাবার একটি ব্যবসাও ছিল। এ থেকে মূলত আমাদের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের চেয়ে সম্ভবত বাবার জ্ঞান বা বোধ উন্নততর ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য দশ গ্রামের লোকজন তাঁকে মানত। গ্রামে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকত। বাবার সঙ্গে কথা না বলে কেউ থানা-পুলিশ করতে যেত না। বাবা সবাইকে খুব বুঝিয়ে বলত– মামলা করলে কে জিতবে, কে হারবে– এটি অনেক পরের কথা। মামলা নিয়ে বরিশাল-পিরোজপুরে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে দুই পক্ষই নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তারচেয়ে বরং তোমরা নিজেরা মিটমাট করে ফেল।
গ্রামের পণ্ডিতরা তখন তালপাতায় অ-আ-ক-খ শেখাতেন হাত ধরে ধরে। আমার সেটি একদম পছন্দ হতো না। বাবা কী করলেন, তিনি একটা স্লেট ও পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। অ-আ-ক-খ দিয়ে যত ছবি আঁকা হয়, তা শেখাতেন। এর মধ্যে আমার যে ছবিটা পছন্দ হতো, সেটি আমি মনের মধ্যে গেঁথে নিতাম। যার ফলে বাবার মাধ্যমে অত্যন্ত আনন্দদায়ক এক শিক্ষা পেয়েছি আমি।
আমার বাবারা ছিলেন ৪ ভাই। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দু’জন পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আমার বাবা ও এক কাকা বাড়ি ছেড়ে যাননি। আমরা ছিলাম ৬ ভাই ৩ বোন। কাকাতো ভাই ৪ জন, বোন একজন। মোট ১৪ ভাইবোন। কাকা কম বয়সেই গত হন। বিলাসী জীবন আমাদের ছিল না। তবে গ্রামের মানুষের কাছে আমরা ছিলাম বড়লোক। পরিবারে অনেক সদস্য থাকলেও খাবারের অভাব হতো না কখনোই। এমনকি দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থায়ও খাবারের কষ্ট করতে হয়নি। আমাদের একটা গুদামঘর ছিল। সেখানে বাবা পাশের বন্দর কাউখালী থেকে সারা বছরের চাল, ডাল, পাউডার দুধ, চিনি, লবণ, গুড় এনে ড্রামে ভরে রাখতেন। বাইরে যত সংকটই থাকুক না কেন, বছরজুড়ে খাবারের অভাব হতো না। সমস্যা হতো ঝড়ের সময়। উপকূলীয় অঞ্চলে এমন ঝড় মাঝে মাঝেই আসত। কখনও ঘরের চাল উড়ে গেলে আমরা সমস্যায় পড়ে যেতাম।
অন্যদের সামনে বাবা নিজের অবস্থানের জন্যই বেশি হাসি-তামাশা করতেন না। যখন আমাদের সঙ্গে থাকতেন, তখন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো হাসি-খুশি থাকতেন। তখনকার বাবাদের আমরা মারধর করতে দেখেছি, এমনকি খড়ম দিয়ে পেটাতে দেখেছি। বাবা আমার গালে জীবনেও একটা চড় মারেনি। কোনো ভাইবোনকেও মারধর করতে দেখিনি। তখন হয়তো আরও এমন বাবা ছিলেন। তবে গ্রামে আমি এমন বাবা আর দেখিনি। সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলেও তিনি কখনও জিজ্ঞেস করতেন না, কেন দেরি করে ঘরে ফিরেছি।