লোককবি ফকির লালন শাহকে (?-১৮৯০) ঘিরে রয়েছে অসংখ্য রহস্য। এই রহস্যগুলোর ব্যাখ্যা খোঁজা মানে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক গভীর স্তরকে উন্মোচন করা। এমনকি লালনের জন্মপরিচয়ও রহস্যে আচ্ছন্ন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই পণ্ডিতেরা বিতর্ক করে আসছেন—লালন কি হিন্দু পরিবারে জন্মেছিলেন, নাকি মুসলমান পরিবারে? ১৮৯৫ সালে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লালন সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘লালনের ধর্ম্মমত অতি সরল ও উদার ছিল। তিনি জাতিভেদ মানিতেন না, হিন্দু–মুসলমানকে সমভাবে দেখিতেন এবং শিষ্যদিগের মধ্যে হিন্দু–মুসলমান সকল জাতিকেই গ্রহণ করিতেন। লালন হিন্দু নাম, সা উপাধি মুসলমানজাতীয়। সুতরাং অনেকেই তাহাকে জাতির কথা জিজ্ঞাসা করিত। তিনি কোনো উত্তর না দিয়া কেবল স্বপ্রণীত নিম্নলিখিত গানটি শুনাইতেন:

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে?
লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।’

এই অংশ ইঙ্গিত করে যে লালনের জন্মপরিচয় নিয়ে অনেকের কৌতূহল ছিল এবং তাঁকে বারবার সে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কিন্তু এমন প্রশ্নের জবাবে লালন কোনো সরাসরি বা সন্তোষজনক উত্তর দেননি। বরং তিনি গানেই সেই প্রশ্ন ফিরিয়ে দিয়েছেন মানুষের দিকে, যেখানে জাত ও ধর্ম নিয়ে তাঁর মুক্ত, অনাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। এটি ব্রিটিশ আমলের অন্যতম প্রাচীন একটি নিবন্ধ, যেখানে প্রথম দিকের শিক্ষিত মহল লালনের স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্বকে স্বীকার করতে শুরু করে।

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র পর কাঙ্গাল হরিনাথ, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, বসন্তকুমার পাল, ক্ষিতিমোহন সেনসহ আরও অনেকে লালন বিষয়ে গবেষণা ও আলোচনা শুরু করেন। বিশেষ করে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—যিনি সাহিত্যে প্রথম অ-ইউরোপীয় নোবেলজয়ী—বাউলদের ধর্মদর্শনকে বাংলার ও বিশ্বের বুদ্ধিজীবী মহলে পরিচিত করে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তৎকালীন অনেক পশ্চিমা গবেষক ও ঔপনিবেশিক প্রশাসক মনে করতেন, বাঙালিরা জাত-পাত ও ধর্মীয় বিভেদের গভীর সংকটে নিমজ্জিত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছিলেন বাংলার সমাজে নিহিত সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্য ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক গুণাবলি, যা তিনি প্রায়ই পাশ্চাত্যের সমাজব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করতেন।

রবীন্দ্রনাথের সময়েই বাংলায় জাত ও ধর্মসম্প্রদায়ভিত্তিক অবিশ্বাস ও সংঘাত ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, যা আংশিকভাবে ছিল ব্রিটিশ শাসকদের ‘ফাটল ধরাও ও শাসন করো’ নীতির ফল। এমন এক সময়ে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল [লালনের মতো] সর্বজনীন ধর্মীয় অভিজ্ঞতা ও সহনশীলতার চেতনা প্রচারের, যে মূল্যবোধ সংস্কৃতি, ধর্ম ও জাতিগত সীমানাকে অতিক্রম করে মানবিকতার এক বৃহত্তর পরিসর তৈরি করে।

রবীন্দ্রনাথের সময়েই বাংলায় জাত ও ধর্মসম্প্রদায়ভিত্তিক অবিশ্বাস ও সংঘাত ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, যা আংশিকভাবে ছিল ব্রিটিশ শাসকদের ‘ফাটল ধরাও ও শাসন করো’ নীতির ফল। এমন এক সময়ে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সর্বজনীন ধর্মীয় অভিজ্ঞতা ও সহনশীলতার চেতনা প্রচারের, যে মূল্যবোধ সংস্কৃতি, ধর্ম ও জাতিগত সীমানাকে অতিক্রম করে মানবিকতার এক বৃহত্তর পরিসর তৈরি করে।

লালনকে ঘিরে আরেকটি বড় রহস্য লুকিয়ে আছে বাউলগানের রহস্যময় জগতে।

লালন মূলত একজন লোকগায়ক হিসেবে পরিচিত। তিনি অসংখ্য গান রচনা করেছেন এবং নিজেও সেগুলো গেয়েছেন। নিশ্চয়ই, তিনি এমন বহু মনোমুগ্ধকর ও আবেগপূর্ণ গান রেখে গেছেন, যেখানে ফুটে উঠেছে বাংলার গ্রামের প্রকৃতির সৌন্দর্য ও কোমল জীবনের ছবি। তবে লালন শুধু গায়কই নন, তিনি ছিলেন একজন বাউলগুরু, যিনি তাঁর গানের আড়ালে বোনা গূঢ় আধ্যাত্মিক সাধনার প্রতীকী রূপগুলো নিজের জীবনে অনুশীলন করতেন।

‘বাউল’ শব্দটির সাধারণ অর্থ হলো গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো এক ভিক্ষুব্রতী সাধক, যাকে ইংরেজিতে প্রায়ই মিনস্ট্রেল বা ভবঘুরে গায়ক বলা হয়। কিন্তু লালনের গূঢ় ও রহস্যময় পদাবলিতে যে ধর্মজগতের আভাস পাওয়া যায়, তার শিকড় ছড়িয়ে আছে প্রাক্‌-আধুনিক সুফি সংস্কৃতি, মধ্যযুগীয় হিন্দু চিন্তা এবং প্রাচীন বৌদ্ধ সাধনাপদ্ধতির ভেতর।

মূলত বাউলরা এমন এক সন্ন্যাসধর্মী সম্প্রদায়, যাদের কোনো লিখিত শাস্ত্র, সংগঠিত ধর্মগুরুতন্ত্র বা মন্দির সংস্থা নেই। বাউলরা গানকেই বেছে নিয়েছেন আধ্যাত্মিক বাণী প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। তাঁদের কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় মতবাদ নেই। তাঁদের মধ্যে জাতপাত বা ধনসম্পদের বিভাজনও নেই; মুসলমান বা হিন্দু—যে কেউই হতে পারে বাউল। ঊনবিংশ শতকের বাংলায় সক্রিয় লালন সাঁই ছিলেন এই অনন্য আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের প্রধান সাধক ও গুরু, যিনি নিজ সাধনা ও সংগীতে বাউল দর্শনের সেই সর্বজনীন চেতনা জীবন্ত করে তুলেছিলেন।

২০০৫ সালে ইউনেসকো বাউলগানকে মানবজাতির মৌখিক ও অমূর্ত ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা করে, যা এখন বাংলাদেশের এক অনন্য সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত। তাদের ঘোষণাপত্রে ইউনেসকো বাউল ঐতিহ্যকে এমন এক আধ্যাত্মিক সাধনা হিসেবে বর্ণনা করে, যা দক্ষিণ এশিয়ার বহুবিধ ধর্মীয় ঐতিহ্যকে আলিঙ্গন করে নেয় এবং লালন সাঁইকে উল্লেখ করে ‘বঙ্গের এক মহান বাউলগুরু’ হিসেবে।

২০০৫ সালে ইউনেসকো বাউলগানকে মানবজাতির মৌখিক ও অমূর্ত ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা করে, যা এখন বাংলাদেশের এক অনন্য সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত। তাদের ঘোষণাপত্রে ইউনেসকো বাউল ঐতিহ্যকে এমন এক আধ্যাত্মিক সাধনা হিসেবে বর্ণনা করে, যা দক্ষিণ এশিয়ার বহুবিধ ধর্মীয় ঐতিহ্যকে আলিঙ্গন করে নেয় এবং লালন সাঁইকে উল্লেখ করে ‘বঙ্গের এক মহান বাউলগুরু’ হিসেবে।

তবে মাজারভিত্তিক জনপ্রিয় ভক্তিমূলক চর্চাগুলোকে কঠোর ধর্মতাত্ত্বিকেরা অনেক সময় ইসলামের মূলধারার নীতির বিপরীত বা বিচ্যুতি হিসেবে সমালোচনা করেন। বাউল সাধকেরা, যাঁরা নানা লোকধর্মীয় ঐতিহ্য ও আচারকে গ্রহণ করেন, তাঁরাও প্রায়ই সংস্কারপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তু হন—যাঁরা ধর্মকে ‘বিশুদ্ধ’ করার নামে এসব প্রথা দমন করতে চান। উদাহরণস্বরূপ, মাজারে সাধনা করা এবং বিশেষ ধরনের পোশাক ও চুলের ধরন বজায় রাখার কারণে অনেক বাউলকে জোর করে চুল কেটে ফেলা বা অনুশোচনামূলক ধর্মীয় রীতিতে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়েছে, যেন তাঁরা তথাকথিত ‘শুদ্ধ ইসলামি শিক্ষায়’ ফিরে আসেন।

এমন সব আন্দোলনের মধ্যেই কুষ্টিয়ায় লালন সাঁইয়ের মাজারকে ঘিরে নানা ঘটনার সূত্রপাত ঘটে, যা এই দ্বন্দ্বের প্রতীক হয়ে আছে। পরবর্তী অংশে সেই ঘটনাগুলোর কয়েকটি বর্ণনা করা হলো।

কুষ্টিয়ায় লালনের মাজারে সমসাময়িক অস্থিরতার শুরু ১৯৮৪ সালে। সে বছর কুষ্টিয়ার এক নতুন জেলা প্রশাসক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। লালন সাঁইয়ের প্রতিকৃতি দেখে তিনি লালনের শিষ্যদের জিজ্ঞেস করেন, ‘উনি হিন্দু না মুসলমান?’

(আজকের কাগজ, ২২ অক্টোবর ১৯৯৯; প্রথম আলো, ৫ নভেম্বর ১৯৯৯)

এরপরই ঘটে রেফারেন্স ১–এ বর্ণিত ঘটনা। ১৯৯৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি লালনের মাজারের সেবাকমিটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যে আবেদনপত্র জমা দেয়, সেখানে এই ঘটনার বিবরণ রয়েছে।

রেফারেন্স ১: লালনের মাজারের সেবাকমিটির আবেদনপত্র

বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর

বিষয়: লালনের মাজারকে লালন একাডেমির অধীন থেকে বাউলদের তত্ত্বাবধানে হস্তান্তরের আবেদন।

১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাসে লালনের তিরোধান দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক লালনের মাজার প্রাঙ্গণে একটি মুসলিম ধর্মীয় সভা আহ্বানের নির্দেশ দেন এবং সেখানে ইসলামি আলেম ও পুলিশ বাহিনী অবস্থান করান। এরপর তিনি লালনের শিষ্য ও বাউলদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন, ‘লালনের মাজারে ইসলামের পাঠ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন থেকে এখানে লালনের গান গাওয়া যাবে না। বাউলদের এই ধর্মীয় সভায় অংশগ্রহণ করতে হবে।’

এ ঘটনা লালনকে ঘিরে আরেকটি রহস্য উন্মোচন করে। তাঁর গানে লালন মানুষকে যেন স্মরণ করিয়ে দেন—যে ‘ধর্ম’ মানুষের মনকে মুক্ত করার কথা, তা-ই কখনো কখনো মানুষকে বাঁধন দেয়; জন্ম দেয় লিঙ্গ, শ্রেণি কিংবা জাতিগত বৈষম্যের। তাঁর বাণীতে ধর্মের পার্থক্য আসলে চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছানোর ভিন্ন পথমাত্র। কিন্তু এই ধর্মভেদেই কখনো কখনো লালনের মাজারে বিভেদ ও সংঘাতের জন্ম হয়েছে।

সে সময় বাউলরা প্রশাসকের ওই নির্দেশ মানেননি। তখন তিনি পুলিশকে আদেশ দেন, ‘বাউলদের লাঠিপেটা করো, আর লালনের মাজার প্রাঙ্গণ থেকে তাড়িয়ে দাও।’

এই হামলায় বহু বাউল গুরুতরভাবে আহত হন, কেউ কেউ যন্ত্রণায় মূর্ছা যান। বিশেষ করে মারাত্মকভাবে আহত বীরাট শাহ কয়েক দিন পর মারা যান। এরপর বাউলদের কাছ থেকে জোরপূর্বক মাজারের চাবি ও দানবাক্সের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেওয়া হয়। তাঁদের মাজারের যাবতীয় কার্যক্রম থেকেও বাদ দেওয়া হয়।

এই আবেদনপত্রে ইঙ্গিত মেলে যে লালনের ধর্মভেদাতীত মনোভাবকে অনেকেই অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থক বলে মনে করেছিলেন এবং ইসলামি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা তার সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু লালনের শিষ্যরা আধুনিক ধর্মীয় শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী লালনকে হিন্দু না মুসলমান—এ প্রশ্নে কোনো গুরুত্ব দেননি। তবু দেখা যায়, লালনসহ ধর্মীয়ভাবে প্রান্তিক মানুষদের প্রচলিত ধর্মীয় ঘেরাটোপে ফেলে শ্রেণিবদ্ধ করার প্রবণতা তৈরি হয়েছিল, যেমনটি ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশ কর্মকর্তারাও করেছিলেন। এটাই ছিল এক গভীর দ্বন্দ্ব।

ফলে কুষ্টিয়ার স্থানীয় প্রশাসনের নেতৃত্বাধীন পরিচালনা কমিটির সঙ্গে লালনের শিষ্যদের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে। মাজারে নিজেদের অধিকার ফিরে পেতে লালনের শিষ্যরা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদনপত্রও জমা দেন।

এ ঘটনা লালনকে ঘিরে আরেকটি রহস্য উন্মোচন করে। তাঁর গানে লালন মানুষকে যেন স্মরণ করিয়ে দেন—যে ‘ধর্ম’ মানুষের মনকে মুক্ত করার কথা, তা-ই কখনো কখনো মানুষকে বাঁধন দেয়; জন্ম দেয় লিঙ্গ, শ্রেণি কিংবা জাতিগত বৈষম্যের। তাঁর বাণীতে ধর্মের পার্থক্য আসলে চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছানোর ভিন্ন পথমাত্র। কিন্তু এই ধর্মভেদেই কখনো কখনো লালনের মাজারে বিভেদ ও সংঘাতের জন্ম হয়েছে।

১৯৯৭ সালে যখন সরকার লালনের মাজারকে পর্যটনকেন্দ্রে রূপান্তরের লক্ষ্যে একটি কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়, তখন এ সমস্যা আবারও প্রকাশ্যে আসে।

১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ৮০ মিলিয়ন ইয়েন (৩৬ লাখ ৪৩ হাজার টাকা) বাজেটে লালন মাজার উন্নয়ন প্রকল্প ঘোষণা করেন। এ প্রকল্পের আওতায় একটি চারতলা গবেষণাগারসহ গ্রন্থাগার ও জাদুঘর, একটি সংগীত ভবন এবং একটি অতিথিশালা নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু লালন শিষ্যরা তাঁদের অধিকার পুনরুদ্ধারের দাবিতে মামলা করায় ঢাকার হাইকোর্ট নির্মাণকাজের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

তবে প্রকল্পটির বিপুল বাজেট স্থানীয় রাজনীতিক ও ঠিকাদারদের জন্য লাভজনক ছিল। ফলে হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে ২০০০ সালের আগস্টে—যখন আমি বাংলাদেশে অবস্থান করছিলাম—একতরফাভাবে নির্মাণকাজ আবার শুরু হয়। এই নির্মাণের বিরোধিতা করে লালনের মাজার সংরক্ষণের আন্দোলন শুরু হয়।

ঢাকায় ফিরে আমি ‘লালনের মাজার রক্ষা কমিটি’র সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। কমিটির সভাপতি কবি শামসুর রাহমান আমাকে প্রস্তাব দেন, আমি যেন একজন জাপানি একাডেমিক গবেষক হিসেবে এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখি। নিচে যে লেখাটি দেওয়া হলো, সেটিই সেই নিবন্ধ, যা প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলোয় ৩০ নভেম্বর ২০০০ তারিখে। এই নিবন্ধ প্রকাশের দুই দিন পরই লালনের মাজারে নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়।আরও পড়ুনলালনের চিরপরিচিত মাজার ফিরে চাই৯ ঘণ্টা আগে

নির্মাণ শুরু হতেই ঢাকার বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকেরা প্রবল প্রতিবাদে সরব হন। তাঁরা ‘লালনের মাজার রক্ষা কমিটি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। অক্টোবর মাসে ঢাকায় বিভিন্ন প্রাঙ্গণ ও সড়কে প্রতিবাদ সভা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। পত্রিকার প্রথম পাতায় কবি শামসুর রাহমানের প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থানের ছবি প্রকাশিত হয়। ফলে কুষ্টিয়ার মাজারসংক্রান্ত এই বিতর্ক জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। এটি আর কেবল স্থানীয় সমস্যা রইল না, এটি হয়ে ওঠে সরকারের পর্যটন উন্নয়ন প্রকল্প বনাম সাংবাদিক ও সংস্কৃতিমনস্ক নাগরিকদের আন্দোলন।

এই প্রতিবাদের জবাবে প্রকল্পের পৃষ্ঠপোষক সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্মাণকাজ বন্ধের ঘোষণা দেন। কিন্তু ঘোষণার পরও কুষ্টিয়ায় স্থানীয়ভাবে কাজ চলতে থাকে। পরের মাস নভেম্বরের ২৩ তারিখে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী সব ধরনের নির্মাণকাজ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেন। তবু স্থানীয় প্রভাবশালীদের উদ্যোগে আবারও কাজ শুরু হয়।

ফলে নির্মাণপক্ষ ও বিরোধীপক্ষের দ্বন্দ্ব প্রতিদিন পত্রিকার শিরোনাম হতে থাকে। এমনকি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসও এই সংঘাত নিয়ে সংবাদ প্রচার শুরু করে। ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে এসে লালন কমপ্লেক্স প্রকল্পটি এক জাতীয় বিতর্কের রূপ নেয়।

২০০০ সালের নভেম্বরে আমি যখন আবার বাংলাদেশে ফিরে এলাম, কুষ্টিয়ার পরিস্থিতি তখনো একই রকম ছিল। কুষ্টিয়া প্রেসক্লাব থেকে ঢাকার বিভিন্ন সংবাদপত্রের দপ্তরে নির্মাণকাজ বন্ধ হওয়ার খবর পাঠানো হয়েছিল। শোনা গেল, স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের প্ররোচনায় এই খবর ছড়ানো হয়েছে। আমি নিজে কুষ্টিয়ার মাজারে গিয়ে দেখি, বাস্তবে নির্মাণকাজ তখনো অব্যাহত—এলাকার মানুষের উদ্বেগ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কাজ চলছিল অবিরাম।

ঢাকায় ফিরে আমি ‘লালনের মাজার রক্ষা কমিটি’র সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। কমিটির সভাপতি কবি শামসুর রাহমান আমাকে প্রস্তাব দেন, আমি যেন একজন জাপানি একাডেমিক গবেষক হিসেবে এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখি। নিচে যে লেখাটি দেওয়া হলো, সেটিই সেই নিবন্ধ, যা প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলোয় ৩০ নভেম্বর ২০০০ তারিখে।

এই নিবন্ধ প্রকাশের দুই দিন পরই লালনের মাজারে নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে লালনের মাজার রক্ষার আন্দোলন বাংলাদেশে এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। তবে এই আন্দোলনে আমার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ও প্রকাশিত বিবৃতির মাধ্যমে ভূমিকা রাখার কারণে আমি দীর্ঘদিন ধরে একধরনের অস্বস্তি ও মানসিক দ্বন্দ্ব অনুভব করেছি।

উদাহরণস্বরূপ, বলা অদ্ভুত শোনাবে যে একজন জাপানি নৃতত্ত্ববিদ, যিনি তাঁর নিজস্ব দেশে আধুনিক জীবন যাপন করছেন, কুষ্টিয়ার লালনের মাজারে গিয়ে কোনো মহান সংস্কৃতি ‘আবিষ্কার’ করেছেন। এমন বিবৃতি একটি ওরিয়েন্টালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে, যা চেষ্টা করে একটি ‘সরল স্থানীয় সংস্কৃতি’কে তার মূল রূপে সংরক্ষণ করতে। আমি উপলব্ধি করি, আমার নিজের কথাও সম্ভবত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্মকর্তা ও শিক্ষাবিদেরা সেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিধ্বনি বহন করতে পারেন।

এরপর ২০০৮ সালে একটি পরিকল্পনা প্রস্তাবিত হয়েছিল ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে লালনের মূর্তি স্থাপন করার জন্য, যাতে ইউনেসকোর অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকাভুক্তির স্মরণ করা যায়। তবে এই পরিকল্পনা শিগগিরই সমালোচনার মুখে পড়ে এবং নির্মাণাধীন মূর্তিটি অবশেষে ধ্বংস করা হয়।

এভাবে লালনের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিতর্ক বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় পরিচয়–সংক্রান্ত বৃহত্তর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এই অর্থে, লালন যেই প্রশ্ন রেখেছিলেন, তা আজও বাংলাদেশের মানুষ ও তার বাইরে অন্যদের জন্য একটি অমীমাংসিত রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ঔপন ব শ ক ১৯৯৭ স ল গ রহণ কর ই ন বন ধ প রক শ ত দ বন দ ব কর ছ ল ন ক জ বন ধ ম সলম ন প রকল প এমন এক ত হয় ছ র জন ম ব তর ক হয় ছ ল মন ত র জ ত গত কম ট র ই কখন ইসল ম প রথম ল লনক রহস য

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষায় সম্পর্ক জোরদার করতে রাজি বাংলাদেশ-কুয়েত

বাংলাদেশ ও কুয়েত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা, শ্রম, উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা গভীর করতে সম্মত হয়েছে। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও জোরদার ও বহুমাত্রিক সহযোগিতায় রূপ দিতে দুই দেশের প্রথম রাজনৈতিক পরামর্শক সভায় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে ঐকমত্য হয়েছে।

রোববার বাংলাদেশ ও কুয়েতের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের রাজনৈতিক পরামর্শ সভা শেষে সন্ধ্যায় প্রচারিত এক যৌথ বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সকালে অনুষ্ঠিত ওই সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপক্ষীয়) নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের এবং কুয়েতের এশীয়–বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাষ্ট্রদূত সামিহ ইসা জোহর হায়াত তাঁর দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।

এদিকে ওই বৈঠকের পর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে তাঁর দপ্তরে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন সামিহ ইসা জোহর হায়াত। সৌজন্য সাক্ষাতের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সামিহ ইসা বলেন, বাংলাদেশ ও কুয়েত শ্রম সহযোগিতাসহ সম্পর্ক জোরদারে শিগগিরই একাধিক খাতে নতুন চুক্তি করবে।

দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক পরামর্শ সভার উল্লেখ করে সামিহ ইসা বলেন, বৈঠকে খাদ্যনিরাপত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী বিনিময় কর্মসূচি, সামরিক সহযোগিতা এবং বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান—এসব খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও সম্প্রসারণে ঐকমত্য হয়েছে। শিগগিরই একাধিক নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।

সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামিহ ইসা জোহর হায়াত বলেন, সকালে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধানসহ বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এরপর দুই দেশের প্রতিনিধিরা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেন। পরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ আলীর একটি চিঠি হস্তান্তর করেছেন। চিঠিতে দুই দেশের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।

সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামিহ ইসা আরও বলেন, ‘আমরা আবারও ১৯৯০ সালে কুয়েতে দখলদারত্বের সময় বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সমর্থনের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই। তখন থেকে পাঁচ হাজারের বেশি বাংলাদেশি সেনা আমাদের পাশে থেকে মাইন অপসারণ ও মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছেন।’

বৈঠকে বেসামরিক বিমান চলাচল ও ফ্লাইট বৃদ্ধি নিয়েও আলোচনা হয় বলে জানান কুয়েতের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, বর্তমানে কুয়েত এয়ারওয়েজ সপ্তাহে ৭টি, আল–জাজিরা এয়ারওয়েজ ১৪টি ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ৩টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। বাংলাদেশে আরও নতুন রুট ও ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে মতৈক্য হয়েছে, যা খুব শিগগির বাস্তবায়িত হবে।

সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামিহ ইসা বলেন, শ্রম সহযোগিতা নবায়নের বিষয়ে নতুন চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি চলছে, যা ভবিষ্যতে উচ্চপর্যায়ের সফরের সময় সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

যৌথ বিবৃতি

বাংলাদেশ ও কুয়েত প্রথম রাজনৈতিক পরামর্শ সভায় প্রতি দুই বছর পরপর পর্যায়ক্রমে এ বৈঠক ঢাকা ও কুয়েত সিটিতে আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফর ও বিনিময় বাড়ানোর বিষয়েও সম্মতি হয়।

বৈঠকে দুই পক্ষ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা পর্যালোচনা করে। ‘অপারেশন কুয়েত পুনর্গঠনের’ অধীন বাংলাদেশের অবদানের কথা উল্লেখ এবং প্রশিক্ষণ, দুর্যোগ মোকাবিলা ও অনলাইন নিরাপত্তায় সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত হয়। দুই পক্ষই ‘কুয়েত ভিশন ২০৩৫’–এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জনশক্তি সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং আলোচনায় থাকা সমঝোতা স্মারকগুলো চূড়ান্ত করার বিষয়ে পর্যালোচনা করে।

জ্বালানি, অবকাঠামো, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি এবং হালাল খাদ্য খাতে উভয় পক্ষ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর জোর দেয়। দুই দেশ যৌথ বাণিজ্য কমিটি পুনরায় সক্রিয় করার পাশাপাশি ২০২৬ সালে বাংলাদেশ-কুয়েত ব্যবসায়ী ফোরাম আয়োজনে রাজি হয়েছে। বৈঠকে কুয়েত ফান্ড (কেএফএইডি) সহায়তার ওপর সন্তোষ প্রকাশ করা হয় এবং নবায়নযোগ্য শক্তি, জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো ও বিমান যোগাযোগে নতুন সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ খুঁজতে সম্মত হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ