অবশেষে আট বছর পর রাজধানীর বড় সাত কলেজের সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর গতকাল সোমবার এক জরুরি বৈঠকে অধিভুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাত কলেজ এখন ‘অভিভাবকশূন্য’। আগামী দিনগুলোতে তাদের অভিভাবকত্ব কাদের হাতে যাবে– এখনও অনিশ্চিত। শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তারা আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাবেন না। ফলে প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী ও দুই হাজার শিক্ষকের সামনে এখন বড় প্রশ্ন– তাদের কী হবে? 

এ অবস্থায় স্বতন্ত্র কাঠামোর দিকে না গিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছে সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এই সাত কলেজ নিয়ে প্রথমে ‘স্বতন্ত্র উচ্চশিক্ষা কাঠামো’ তৈরির কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাতে রাজি না হওয়ায় আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার বিষয়টি নিয়ে এখন ভাবা হচ্ছে। এই সাত কলেজের জন্য আলাদা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার বিষয়ে ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। 

ইউজিসির এক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা জানান, তারা বিভিন্ন ‘মডেল’ নিয়ে কাজ করছেন। এখনও কিছু চূড়ান্ত হয়নি। ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ সমকালকে বলেন, এই সাত কলেজের বিষয়ে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। এখন এটি আরও ত্বরান্বিত করা হবে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থাকা রাজধানীর সাতটি কলেজকে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কলেজগুলো হলো– ঢাকা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ইডেন কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, সরকারি কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ও মিরপুর বাঙলা কলেজ। প্রায় আট বছর ঢাবির অধীনেই ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম চলেছে এই সাত কলেজের। যে সংকটগুলো নিরসনে কলেজগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন হয়নি। পূরণ হয়নি লক্ষ্যও। উল্টো তৈরি হয়েছে জটিলতা। দূরত্ব বেড়েছে ঢাবি ও সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও। সাত কলেজ যেমন ঢাবির অধীনে থাকতে চায়নি, তেমনি ঢাবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সাত কলেজকে ‘কাঁধের বোঝা’ হিসেবে সব সময় দেখে আসছেন। শুধু ‘আর্থিক লাভের আশায়’ ঢাবি প্রশাসন সাত কলেজকে ছাড়তে গড়িমসি করে এসেছে।

চলমান অদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে সাত কলেজের প্রাক্তন অন্তত চারজন অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। অবসরে থাকায় তারা স্বনামে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তাদের মূল্যায়ন হলো, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ঠিক না করেই ঢাবির অধিভুক্তি বাতিল করায় সাত কলেজের সংকট বরং আরও ঘনীভূত হলো। কারণ, এই সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীরা খুশি হলেও তাদের পাঠদানে নিয়োজিত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকরা অখুশি। অধিভুক্তি বাতিল হলেও কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় বিষয়টির স্থায়ী সমাধান হবে, তা নিয়ে উল্টো এখন ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
কলেজগুলোর অধ্যক্ষের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের গতকালের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, আপাতত শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর গঠন করে দেওয়া বিশেষজ্ঞ কমিটি এই সাত কলেজের সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

কলেজগুলোর দু’জন প্রাক্তন অধ্যক্ষ জানান, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে নতুন ভর্তি বন্ধ হয়ে গেল। বিশেষজ্ঞ কমিটি তো ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারবে না, ডিগ্রিও দিতে পারবে না। ডিগ্রি দিতে গেলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোকে নিতে হবে অথবা শিক্ষার্থীদের দাবি অনুসারে সাত কলেজ নিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে। কোনো সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই অধিভুক্তি বাতিলের ঘটনা তাদের ভাষায় ‘অনেকটা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া’র মতো।
অধ্যক্ষরা জানান, একাডেমিক সংকট আরও আছে। যেমন এসব কলেজের মধ্যে অধিকাংশেই উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা আছে। এর মধ্যে ঢাকা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। ফলে এসব কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেখানে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর থাকতে পারবে না।

কীভাবে চলবে সাত কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম
অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন চালিয়ে আসছেন সাত কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যেই হঠাৎ বাতিল করায় অধ্যয়নরত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। পরীক্ষাসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়েও অনেকে উদ্বিগ্ন। বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন ঢাবির উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেছেন, যেসব শিক্ষার্থী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান শিক্ষা কার্যক্রমের অধীনে রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়িত্বশীল থাকবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত যত শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত, তাদের সার্বিক দিক দেখভাল করবে ঢাবি। সে ক্ষেত্রেও ঝামেলা এড়াতে মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অন্যতম ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আবদুর রহমান বলেন, এই সাত কলেজের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে। সেই বিশ্ববিদ্যালয় কবে হবে– সে ঘোষণার আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী প্রশাসন দিয়ে চালাতে হবে।

এদিকে চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ও অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাগুলো শেষ করা নিয়ে জটিলতা বাড়তে পারে। এ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি প্রক্রিয়া আসন্ন। ঠিক সেই সময়ে ঢাবি কর্তৃপক্ষ সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করায় সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে কলেজগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা হবে বা ভর্তি নেওয়া হবে।
এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ঢাবির উপাচার্য বলেন, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী আসন সংখ্যা, ভর্তি ফি নির্ধারণসহ যাবতীয় বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রতিনিধি হিসেবে বিশেষজ্ঞ কমিটিতে থাকা অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান সমকালকে বলেন, আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। এর মধ্যেই তো এত বড় ঘটনা হয়ে গেল। আমার এখনও বিষয়টি নিয়ে কোনো ধারণা নেই। সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে হয়তো একটা প্রক্রিয়া বের করা হবে। সেটা কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
এ ব্যাপারে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম ইলিয়াস বলেন, অধিভুক্ত সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও থাকছে না, আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও থাকছে না। শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে এই সাত কলেজের জন্য আলাদা কাঠামো তৈরি করা হবে।

নতুন করে জটিলতা ও সংকট সৃষ্টি হলেও অধিভুক্তি বাতিলে খুশি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা মনে করছেন, ঢাবির অধিভুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তারা তাদের স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথে এক ধাপ এগিয়ে গেছেন। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম মোল্লা বলেন, সাত কলেজ নিয়ে এখন স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হবেই। 
তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় উইংয়ের কর্মকর্তারা জানান, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে যথেষ্ট সময় লাগে। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেলেও বর্তমান শিক্ষার্থীরা সে সুবিধা পাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে যারা ভর্তি হবে, তারাই সে সুবিধা পাবে। 


 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ত কল জ পর ক ষ ব ষয়ট সরক র ইউজ স

এছাড়াও পড়ুন:

ছুটি না পেয়ে অসুস্থ শ্রমিকের মৃত্যু, মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ 

নারায়ণগঞ্জের বন্দরের মদনপুর এলাকায় লারিজ ফ্যাশনের পোশাক কারখানায় অসুস্থ হয়ে রিনা আক্তার (৩২) নামের এক শ্রমিকের মৃত্যুর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকরা। 

সোমবার (৩ নভেম্বর) সকালে তারা মদনপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন। খবর পেয়ে থানা পুলিশের সঙ্গে হাইওয়ে ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। 

প্রত্যক্ষদর্শী ও শ্রমিকরা জানিয়েছেন, রিনা আক্তার অসুস্থ অবস্থায় কারখানায় কাজ করছিলেন। রোববার তিনি বেশি অসুস্থতা অনুভব করলে ছুটি চেয়ে আবেদন করেন। তবে, কর্তৃপক্ষ ওই শ্রমিকের আবেদনে সাড়া না দিয়ে কাজ করতে বাধ্য করেন। ওই নারী গুরুতর অসুস্থ হয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে সহকর্মীরা স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি ঘটলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

অবরোধকারী শ্রমিকদের অভিযোগ, তাদের সহকর্মীর মৃত্যুর জন্য মালিকপক্ষ দায়ী। রিনা অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তাকে ছুটি দেওয়া হয়নি। চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন তিনি। 

লারিজ ফ্যাশনের মালিকপক্ষ ও কর্মকর্তাদেরকে গ্রেপ্তার করার দাবি জানিয়েছেন শ্রমিকরা।

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে লারিজ ফ্যাশন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শিমুল বলেছেন, আমাদের একজন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে মৃত্যু হয়। এতে আমাদের কোনো গাফিলতি নেই। আমরা আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি।

কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল কাদের জিলানী বলেছেন, সহকর্মীর মৃত্যুর জন্য গার্মেন্টস মালিকপক্ষ দায়ী, এমন অভিযোগ করে শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছেন। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি। ঘটনাস্থলে থানা পুলিশের সঙ্গে হাইওয়ে ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশও আছে। শ্রমিকরা রাস্তা থেকে সরে গেছেন। যানচলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।

ঢাকা/অনিক/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ