তিস্তা সেতু ঝুঁকিতে ফেলে তুলছে বালু
Published: 31st, January 2025 GMT
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে তিস্তা নদীর ওপর নির্মাণাধীন হরিপুর-চিলমারী তিস্তা পিসি গার্ডার সেতুর পাশেই খননযন্ত্র দিয়ে তোলা হচ্ছে বালু। মহিলা দলের এক নেতা ও স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী এ কাজে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। অবাধে বালু তোলায় পিলার দুর্বল হয়ে সেতু ধসে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি সেতুর উত্তর ধারে হরিপুরের পাত্রখাতা মৌজায় বালু তোলা হচ্ছে জেনে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমান পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় উপজেলা মহিলা দলের সভাপতি বিউটি বেগমকে বালু তুলতে নিষেধ করা করা হয়। ভূমি কর্মকর্তা চলে যাওয়ার পরও বন্ধ হয়নি বালু উত্তোলন।
এদিকে অবাধে বালু তোলায় সেতু এলাকায় ৬০ থেকে ৭০ ফুট গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে বেশি দিন চলতে থাকলে যে কোনো মুহূর্তে সেতুটি ধসে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে বলছেন সেতু নির্মাণ প্রকল্পের পরামর্শক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহিদুল রহমান প্রামাণিক।
অভিযোগ প্রসঙ্গে উপজেলা মহিলা দলের সভানেত্রী বিউটি বেগমের ভাষ্য, সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণে চরের শতাধিক অসহায় মানুষের বসতভিটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে তাঁর ঘরও রয়েছে। ভেঙে ফেলা এসব ঘরবাড়ি তোলার জন্য নিজেদের জমি থেকে বালু তুলেছেন। প্রশাসন বাধা দেওয়ায় বালু তোলা বন্ধ রাখা হয়েছে। তিনি একাই নন, সাইদুর রহমান নামে এক ব্যক্তিও দীর্ঘদিন ধরে সেতু এলাকা থেকে বালু তুলে বিক্রি করছেন। প্রশাসন তাকে বাধা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। এ সময় তিনি সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত
পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও দ্রুত বসতবাড়ি নির্মাণ করে দেওয়ার দাবি জানান।
২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হরিপুর-চিলমারী তিস্তা সেতুর ভিত্তি উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। ২০২০ সালের ৬ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর-চিলমারী উপজেলা সদরের সঙ্গে সংযোগকারী সড়কে তিস্তা নদীর ওপর ১ হাজার ৪৯০ মিটার দীর্ঘ পিসি গার্ডার সেতু নির্মাণ (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্প অনুমোদন দেয়। এলজিইডির বাস্তবায়নে ৭৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় সেতুটি নির্মাণ করে চীনের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। চলতি বছরের মার্চ মাসে যাতায়াতের জন্য খুলে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ও কুড়িগ্রামের চিলমারীবাসীর স্বপ্নের তিস্তা পিসি গার্ডার সেতু। ইতোমধ্যে ৯৫ ভাগ কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। সেতু এলাকায় অবাধে বালু তোলা হলে স্বপ্নের এ সেতু ঝুঁকির মুখে পড়বে– সম্প্রতি সেতু পরিদর্শনে এসে এমন মন্তব্য করেন এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী গোপাল কৃষ্ণ দেবনাথ।
তিস্তা সেতু বাস্তবায়ন আন্দোলনের নেতা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আ.
হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাবেক উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোজাহারুল ইসলাম বলেন, উত্তরাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন এ সেতুটি। এ সেতুতে চলাচল শুরু হলে রংপুর থেকে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতে সময় অর্ধেক বেঁচে যাবে। দেশের এ সম্পদের ক্ষতি যে করবে, সে দলের হলেও ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজির হোসেন বলেন, বালু তোলার অভিযোগ পেয়ে সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। অভিযুক্তরা বালু তুলবেন না প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার পরও সেতুর ক্ষতি হয় এমন কাজ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
কিশোরদের যৌন সম্পর্ক কি অপরাধ, কী চাচ্ছেন ভারতের শিশু অধিকারকর্মীরা
ভারতে ১৮ বছরের কম বয়সীদের জন্য যৌন সম্পর্ক বেআইনি। প্রচলিত আইনে এটিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এ বিধান নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন দেশটির আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং। এ–সংক্রান্ত আইনকে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে ভারতে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
জয়সিং যুক্তি দেন, পারস্পরিক সম্মতিতে ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক শোষণমূলক নয় কিংবা নিপীড়নমূলকও নয়। এ ধরনের সম্পর্ককে ফৌজদারি অপরাধের আওতার বাইরে রাখতে আদালতের প্রতি অনুরোধ করেন তিনি।
আদালতে জমা দেওয়া আনুষ্ঠানিক নথিতে জয়সিং বলেন, আইনের মাধ্যমে যৌন সম্পর্কের বয়সসীমা নির্ধারণের উদ্দেশ্য হলো নিপীড়ন রোধ করা, ওই সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা নয়।
তবে কেন্দ্রীয় সরকার জয়সিংয়ের এই দাবির বিরোধিতা করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের কম বয়সীদের যৌন সম্পর্কের বৈধতা দিলে শিশুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা হুমকির মুখে পড়বে। এতে তারা নিপীড়ন ও শোষণের শিকার হতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টে জয়সিংয়ের এই চ্যালেঞ্জের কারণে ভারতে আবারও যৌন সম্পর্কে সম্মতি এবং শিশুদের যৌন সুরক্ষা আইন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। শিশুদের যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে ভারতের প্রধান আইন পসকো অ্যাক্ট-২০১২।
এ আইন অনুযায়ী, পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেও ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীরা যৌন সম্পর্কে জড়ালে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। বিষয়টি পসকো আইন থেকে বাদ দেওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে ভারতে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
অনেক দেশের মতো ভারতও যৌন সম্পর্কের জন্য সম্মতির বয়স নির্ধারণ নিয়ে সংগ্রাম করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গরাজ্যভেদে এই বয়স ভিন্ন হতে পারে। তবে ভারতজুড়ে একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া আছে।শিশু অধিকারকর্মীরা বলছেন, কিশোর-কিশোরীদের এই আইনের আওতামুক্ত রাখলে তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকবে। অন্যদিকে এই মতের বিরোধীরা বলছেন, এতে মানব পাচার ও বাল্যবিবাহের মতো অপরাধ আরও বাড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, নিপীড়নের শিকার হলে কিশোর-কিশোরীরা কি আদৌ প্রমাণের দায়ভার বহন করতে সক্ষম? তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—যৌন সম্পর্কের জন্য সম্মতির বয়স নির্ধারণ করে দেয় কে। আর এই আইন আদতে কার স্বার্থ রক্ষা করে?
অনেক দেশের মতো ভারতেও যৌন সম্পর্কের জন্য সম্মতির বয়স নির্ধারণ নিয়ে তর্কবিতর্ক চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গরাজ্যভেদে এই বয়স ভিন্ন হতে পারে। তবে ভারতজুড়ে একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া আছে।
ইউরোপের অধিকাংশ দেশ কিংবা যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো দেশে যৌন সম্পর্কের বৈধ বয়স ১৬। কিন্তু ভারতে যৌন সম্পর্কের বয়সসীমা এর চেয়ে বেশি।
১৮৬০ সালে যখন ভারতে ফৌজদারি বিধি চালু হয়, তখন যৌন সম্পর্কের জন্য সম্মতির ন্যূনতম বয়স ছিল ১০ বছর। ১৯৪০ সালে এই বিধি সংশোধনের মাধ্যমে তা বাড়িয়ে ১৬ বছর করা হয়।
পরে ২০১২ সালে পসকো আইনের মধ্য দিয়ে বড় পরিবর্তন আসে। এতে যৌন সম্পর্কের জন্য সম্মতির বয়স ১৮ বছরে উন্নীত করা হয়। এক বছর পর ভারতের ফৌজদারি আইন এই পরিবর্তন অনুযায়ী সংশোধিত হয়। ২০২৪ সালে প্রণীত নতুন দণ্ডবিধিতেও এই বয়সসীমা বহাল রাখা হয়েছে।
ভারতে কিশোর-কিশোরীদের সম্মতিমূলক যৌন সম্পর্ক কেন অপরাধ
কিন্তু এক দশকের বেশি সময় ধরে অনেক শিশু অধিকারকর্মী এবং এমনকি আদালতও যৌন সম্পর্কের বৈধ বয়সসীমার সমালোচনা করেছেন এবং এই বয়সসীমা ১৬ বছরে নামিয়ে আনার পক্ষে মত দিয়েছেন। তাঁদের মতে, পসকো আইন কিশোর-কিশোরীদের পারস্পরিক সম্মতিতে গড়ে ওঠা সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং প্রায়ই প্রাপ্তবয়স্করা এ ধরনের সম্পর্কে বাধা দিতে এই আইনের অপব্যবহার করেন। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি বেশি ঘটে।
ভারতে এখনো যৌনতা একটি নিষিদ্ধ ও অস্বস্তিকর বিষয়। যদিও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কোটি কোটি ভারতীয় কিশোর-কিশোরী যৌন সম্পর্কে সক্রিয়।
শিশুদের যৌন নিপীড়ন রোধে কাজ করা সংস্থা ফাউন্ডেশন ফর চাইল্ড প্রোটেকশন-মুসকানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা শর্মিলা রাজ বলেন, ‘আমাদের সমাজ জাত, শ্রেণি ও ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত। ফলে সহজেই এ আইনের অপব্যবহার করা যায়।’
কিন্তু এক দশকের বেশি সময় ধরে অনেক শিশু অধিকারকর্মী এবং এমনকি আদালতও যৌন সম্পর্কের বৈধ বয়সসীমার সমালোচনা করেছেন এবং এই বয়সসীমা ১৬ বছরে নামিয়ে আনার পক্ষে মত দিয়েছেন।২০২২ সালে কর্ণাটক হাইকোর্ট ভারতের আইন সংস্কার সংস্থা ল’ কমিশনকে নির্দেশ দেন, যেন তারা পসকো আইনের আওতায় যৌন সম্পর্কের জন্য সম্মতির বয়স পুনর্বিবেচনা করে। এ ক্ষেত্রে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে বলা হয়।
আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, বহু ক্ষেত্রে ১৬ বছর পেরোনো কিশোরীরা প্রেমে পড়ে পালিয়ে যায় এবং যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলে। কিন্তু পরে শুধু ছেলেটির বিরুদ্ধে পসকো আইন ও দণ্ডবিধির আওতায় অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়।
পরের বছর ২০২৩ সালে ল’ কমিশনের প্রতিবেদনে বয়সসীমা কমানোর প্রস্তাব নাকচ করা হয়। তবে কমিশন সুপারিশ করেছে, ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীর মধ্যে যদি পারস্পরিক সম্মতিতে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সে ক্ষেত্রে সাজা দেওয়ার সময় বিচারকদের জন্য ‘নির্দেশিত বিচারিক বিবেচনার’ সুযোগ রাখা উচিত। এর অর্থ হলো বিচারক যাতে পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশনার আলোকে সাজা কমাতে বা মওকুফ করতে পারেন।
এটি এখনো কার্যকর না হলেও মামলার তথ্য ও ভুক্তভোগীর বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে ইতিমধ্যে ভারতের বিভিন্ন আদালত এই নীতির ভিত্তিতে জামিন, খালাস বা মামলা বাতিলের সিদ্ধান্তও নিচ্ছেন।
ভারতে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পসকো আইনের আওতায় বিশেষ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল প্রায় ২ দশমিক ৫ লাখ।শর্মিলা রাজসহ অনেক শিশু অধিকারকর্মী চান, এই বিধানটি যাতে আইনে পরিণত হয়। শুধু প্রস্তাব আকারে থাকলে আদালত তা উপেক্ষা করতে পারেন।
ইন্দিরা জয়সিং মনে করেন, শুধু বিচারকের বিবেচনা যথেষ্ট নয়। কারণ, অভিযুক্তকে পুলিশের জেরা, আদালতের দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া ও সামাজিক লজ্জার মুখোমুখি হতে হয়। ভারতের বিচারব্যবস্থা এতটাই ধীর যে বহু মানুষ এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই শাস্তি পেয়ে যান।
ইন্দিরা জয়সিং আরও বলেন, প্রতিটি মামলা বিচারকের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়া সেরা সমাধান নয়। কারণ, এতে ফলাফল অসম হতে পারে এবং পক্ষপাতিত্বের আশঙ্কাও থেকে যায়।
ভারতে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পসকো আইনের আওতায় বিশেষ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই লাখ।
জয়সিংয়ের দাবি, বয়সের ব্যবধান যদি খুব সামান্য হয় এবং উভয়েই সম্পর্কের জন্য সম্মত থাকে, তবে সে যৌন সম্পর্ককে যাতে ধর্ষণ বা শোষণের মতো অপরাধ হিসেবে বিবেচনা না করা হয়।