যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার্স হামলার মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ন্যারেটিভ। ২০০১ সালের ওই ঘটনার পর বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে চলে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত। এসব সংঘাতের ধারাবাহিকতায় আসে ২০২৪ সাল। বছরটির শুরুতেই একে বলা হচ্ছিল ভোটের বছর।
বিশ্বে এক বছরে ৮০টির বেশি দেশে নির্বাচন হয়েছে। পাল্টে যায় অনেক ছক, হিসাবনিকাশ। গত বছর সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের আকস্মিক পতন, রাশিয়ার পক্ষে লড়াই করতে শুরু করে উত্তর কোরীয় সেনারা, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মিসাইল ইউক্রেনে পাঠানো এবং রাশিয়ার ওপর হামলা, ইরানের মিসাইল রাশিয়ায় পাঠানো। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রে সজ্জিত ইসরায়েলের বিমান হামলা লেবানন ও গাজায়, ইয়েমেনের মিসাইল ইসরায়েলের দিকে নিক্ষেপ– এসব সংঘর্ঘ একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, বিশ্বের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কি আরও বেশি দেশ একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে? চলমান সংঘাতগুলোর সমষ্টিগত রূপ আসলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি না, তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। তবে এটি পরিষ্কার, বিশ্বের অনেক সংঘাতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রয়েছে। তাহলে এই সংযোগগুলো কীভাবে গঠিত হচ্ছে? এর উত্তর আছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক ফ্যাক্টরের মধ্যে। সেগুলোর দিকে তাকানো যেতে পারে।
ইউক্রেনে উত্তর কোরিয়ার সৈন্য মোতায়েন: নতুন সংকটের ইঙ্গিত
ধারণা করা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়া ১০ থেকে ১২ হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে রাশিয়ায়। প্রায় এক ডিভিশনের সমান ওই যোদ্ধারা এরই মধ্যে রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনে লড়াই করছে। শুধু উত্তর কোরিয়া নয়, ইরানও সহায়তা করছে রাশিয়াকে মিসাইল ও স্বল্পমূল্যের ড্রোন দিয়ে। এসব সহায়তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ইউরোপ, আমেরিকা ও খোদ ইউক্রেন। কারণ, পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে সহায়তা করলেও সেই সহায়তা যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনীয় যোদ্ধাদের পূর্ণ মাত্রায় কাজে লাগছে না। ইউক্রেনের যুদ্ধ আক্ষরিক অর্থেই এখন শুধু দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। একাধিক দেশ পরোক্ষভাবে এতে জড়িয়ে একটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধের রূপ দিয়েছে। বেলারুশ সহায়তা করছে রাশিয়াকে। এ নিয়ে বিবিসির ইউক্রেন বিশেষজ্ঞ ভিটালি শেভচেঙ্কো বলেন, “আমরা এখানে দুটি ভিন্ন কৌশলের মধ্যে অসমতা দেখছি। পশ্চিমা দেশগুলো সতর্কতা ও নিয়ন্ত্রণনীতি অনুসরণ করছে, যা ইউক্রেনের কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধতা তৈরি করেছে। মস্কো এই যুদ্ধের বিস্তার নিয়ে ততটা চিন্তিত নয়, বরং তারা এটিকে আরও বাড়ানোর পক্ষে।”
মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সমীকরণ
মধ্যপ্রাচ্যের জটিলতা এতটাই বেশি যে, ইউক্রেন যুদ্ধ তুলনামূলকভাবে সহজ মনে হতে পারে। অঞ্চলটিতে একাধিক সংঘাত চলছে। এর মধ্যে কিছু সক্রিয়, কিছু চাপা, কিন্তু সবই একই সময়ে বিদ্যমান। একটি বিষয় পরিষ্কার করা জরুরি, বিশ্ব গণমাধ্যমে যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যের চিত্র উপস্থাপিত হয়, বাস্তবতা ততটা সংঘাতময় নয়। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ অঞ্চলে বর্তমানে যুদ্ধ নেই। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং মিসরের মতো দেশে স্বাভাবিক জীবন চলছে, যুদ্ধের কোনো সরাসরি প্রভাব সেখানে নেই। এমনকি ইরাক ও ইরানের মতো দেশেও, যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংঘাত হয়েছে, সেখানকার অধিকাংশ মানুষের জীবন এখন শান্তিপূর্ণ।
নতুন শাসকের অধীনে সিরিয়া
সিরিয়ায় রাতারাতি সরকারের পতন হবে, তা কেউই আগাম অনুমান করতে পারেনি। না সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ, না তেহরান, মস্কো বা দক্ষিণ বৈরুত, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও। মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ইসলামপন্থি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) একের পর এক শহর দখল করেছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য এ গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে এসে তারা দ্রুত এলাকা দখল করেছে। এখন তারাই সিরিয়ার নতুন শাসক। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা দিক। হামাসের নেতৃত্বে দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলার অন্যতম প্রভাব হলো– ইরানের আঞ্চলিক মিত্রদের ওপর বড় ধাক্কা। আসাদের মিত্র রাশিয়া এখন ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যস্ত, হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের সঙ্গে স্বল্প সময়ের যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইরান দেখেছে কীভাবে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান সহজেই তার আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। ফলে আসাদের মিত্ররা তাকে সহায়তা করতে পারেনি বা করতে চায়নি। অন্যদিকে, বিদ্রোহীদের সমর্থনকারী তুরস্ক এই পরিস্থিতি নিজের সুবিধার জন্য কাজে লাগিয়েছে।
বিরামহীন সংঘাতের নাম গাজা
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালায়। এতে প্রায় ১২০০ ইসরায়েলি নিহত ও আড়াইশ জনকে জিম্মি করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল ১৫ মাস ধরে গাজায় হামলা চালিয়ে ৪৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। সম্প্রতি কয়েকটি দেশের মধ্যস্থতায় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়েছে। ইসরায়েল দাবি করছে, তাদের হামলায় হামাস অনেকাংশে দুর্বল হয়ে গেছে। যুদ্ধবিরতির পর হামাস যেভাবে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দিচ্ছে, তা দেখে অনেক আন্তর্জাতিক সাংবাদিকই মানতে নারাজ যে হামাস শেষ হয়ে গেছে। গাজা এখন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। অঞ্চলটির প্রায় ২৪ লাখ মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠই এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। এদের বেশির ভাগই তাঁবুতে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বসবাস করছে। গরমে সাপ, বিষধর পোকামাকড় ও চর্মরোগে আক্রান্ত এবং শীতে আবহাওয়ার চাপে কষ্ট পাচ্ছে।
ইরান ও তার ছায়াসঙ্গীরা
ইরান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মিত্র বা ‘প্রক্সি’ মিলিশিয়া বাহিনীকে সমর্থন করে। তাদের টাকা, অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দেয় ইরানের কুদস ফোর্সের মাধ্যমে। এসব মিলিশিয়া বাহিনী ইসরায়েলের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন এবং ইরান এদের ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ হিসেবে দেখে। লেবাননে বহু বছর ধরেই শক্তিশালী অবস্থানে হিজবুল্লাহ। ইরান এই গোষ্ঠীকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দিয়ে আসছে। ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে হামলা চালালে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। ইসরায়েলও হিজবুল্লাহর ওপর হামলা করে। এক পর্যায়ে হিজবুল্লাহকে পরাজয় মেনে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে হয় ইসরায়েলের সঙ্গে।
আফ্রিকা: মস্কোর পেছনের উঠান
ইরান তার প্রধান মিত্র সিরিয়া হারালেও, লিবিয়ার খলিফা হাফতার এখন রাশিয়ার বড় মিত্র। রাশিয়া লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগরে তার প্রভাব বিস্তার করতে চায় এবং সেখানে ভাড়াটে সৈন্যদের কাজকর্ম চালাচ্ছে। রাশিয়ার ভাড়াটে সৈন্য গোষ্ঠী, যা আগে ওয়াগনার নামে পরিচিত ছিল, এখন ‘আফ্রিকা কর্পস’ নামে পরিচিত। বাহিনীটি সাহেল অঞ্চলের দেশগুলোতে পশ্চিমা বাহিনীকে সরিয়ে ফেলেছে।
পরিণতি
২০২৪ সালের বাস্তবতা দেখাচ্ছে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ন্যারেটিভ ক্রমশ ভেঙে পড়েছে। বরঞ্চ যেসব দেশ বা গোষ্ঠীগুলোকে সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে বৈশ্বিক পর্যায়ে গোলযোগ বাধিয়ে রাখা হয়েছিল, সেসব দেশ বা গোষ্ঠীর সঙ্গেই এখন নতুন করে মিত্রতা করছে অনেক দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ট্রাম্প প্রশাসনকেও তাই যুদ্ধাস্ত্র বেচার ধান্দা বাদ দিয়ে বাণিজ্যের মাধ্যমে মোড়লগিরি বজায় রাখার দিকে মনোযোগ দিতে দেখা যাচ্ছে। কাল যে ছিল শত্রু, আজ সে মিত্র হয়ে যাচ্ছে। তবে নতুন শত্রুও সৃষ্টি করেছে।
সূত্র: বিবিসি
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইউক র ন পর স থ ত ইসর য় ল ইউক র ন ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
কার্টুন, মিমে অভ্যুত্থানের ভিন্ন ধারার দৃশ্যায়ন
টাকার বস্তার ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে আছেন শুভ্র কেশ, সফেদ দাড়ি, চশমা পরিহিত এক লোক। তাঁর ছবি দেখে তো বটেই, এই বর্ণনা থেকেও তাঁকে চিনবেন দেশবাসী। বর্তমানে কারাগারের বাসিন্দা পতিত স্বৈরশাসকের এই উপদেষ্টা বলছেন, ‘টাকার ওপর আমার বিশ্বাস উঠে গেছে।’ এই ছবির পাশেই এক কাটআউট। সেখানে ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ বলতে বলতে দৌড়ে পালাচ্ছেন ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার মসনদ থেকে উৎপাটিত শেখ হাসিনা।
এমন মজার মজার কার্টুন, মিম, গ্রাফিতি, ভিডিও স্থাপনাকর্মসহ বৈচিত্র্যময় সৃজনসম্ভার নিয়ে শুরু হয়েছে ‘বিদ্রূপে বিদ্রোহ’ নামের ব্যতিক্রমী এক প্রদর্শনী। আয়োজন করেছে অনলাইনভিত্তিক স্যাটায়ার সাময়িকী ‘ইয়ারকি’। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দিনের এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। চলবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। সবার জন্য প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা।
গত বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল ছিল জুলাই। একটি বৈষম্যহীন, উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য পথে নেমেছিলেন অগণিত মানুষ। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উৎখাত করতে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের অনেকে। আহত হয়েছেন বেশুমার। রক্তরঞ্জিত রাজপথ বেয়ে এসেছে জনতার বিজয়।
প্রদর্শনীতে প্রবেশপথটির দুই পাশে লাল রঙের পটভূমিতে বড় বড় ডিজিটাল পোস্টার। সেখানে ২ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিনের বিভিন্ন ঘটনার আলোকচিত্র, সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশনের রিপোর্ট, ছবি, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট—এসব তুলে আনা হয়েছে এ পোস্টারগুলোতে। প্রবেশপথটিও লাল রঙের। ‘জুলাই করিডর’ নামে এই রক্তিম পথটি বেয়ে দর্শনার্থীরা প্রদর্শনীতে প্রবেশের সময় অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোর উত্তাপ ফিরে পাবেন।