মানুষ কষ্টে আছে। কিন্তু রাজনীতির ডামাডোলে মানুষের কষ্টের কথাগুলো চাপা পড়ে যায়। চারদিকে শুধু সংস্কার আর নির্বাচনের কথা। এর মধ্যে চলছে নানান আন্দোলন ও আবদার। বিশ্ববিদ্যালয় দিতে হবে, চাকরি স্থায়ী করতে হবে, গ্রেড বদলাতে হবে, ক্যাডারে নিতে হবে কিংবা ক্যাডার থেকে বাদ দিতে হবে, মহার্ঘ ভাতা দিতে হবে ইত্যাদি। এসব করতে অনেক টাকার দরকার। সরকারের টাকা নেই। জনগণের কষ্টের রোজগারের টাকা সরকারের টাকা নামে চালিয়ে দেওয়া হয়। যাঁরা আন্দোলন-আবদার করছেন, তাঁরা কি জানেন না যে এত কিছু চাইলে জনগণের ওপর কত চাপ পড়বে? এমনিতেই তো মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের অবস্থা ত্রাহি মধুসূদন!

দেশে একটা নতুন সরকার এসেছে। একটা গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আসলে এটা আর সব সরকারের মতোই। কথাবার্তায়, আচার-আচরণে কোনো ফারাক নেই। তাঁদের অনেকেরই এক বা একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাড়ি আছে। কিন্তু প্রায় সবাই ‘সরকারি’ গাড়ি-বাড়ি’ নিয়েছেন। কাউকে বলতে শুনলাম না, আমার গাড়ি আছে, আমি সরকারি গাড়ি নেব না। এটা বলতে মেরুদণ্ড লাগে, গাটস লাগে। লাল ম্যাটের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা ফিতা কেটে প্রকল্প উদ্বোধন করছেন, সাংবাদিকদের সামনে কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছেন। ১৬ বছর এটা হয়নি, ওটা হয়নি বলে আক্ষেপ করছেন। এভাবে কত দিন যাবে?

অনেক মানুষ এখনো বিশ্বাস করেন, তাঁদের দেখভাল করার জন্য, তাঁদের মুশকিল আসান করতে কয়েক বছর পরপর আসমান থেকে দেবদূতেরা এসে হাজির হন। মন্ত্রীরাও এ রকম। এখন তাঁদের বলা হচ্ছে উপদেষ্টা। পদমর্যাদায় মন্ত্রী। পাকিস্তান আমলে বলা হতো উজির। তাঁরা কি জানেন না, সাধারণ মানুষের সমস্যা কী, প্রয়োজন কী, দাবি কী? তাঁরা তো একসময় ‘সাধারণের’ কাতারেই ছিলেন।

একটা সভ্য সমাজে টিকে থাকতে ও চলাফেরা করতে ন্যূনতম চারটি বিষয় লাগে—স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গণপরিবহন ও নিরাপত্তা (আইনশৃঙ্খলা)। আমাদের দেশে এসব সব সময়ই ছিল অপর্যাপ্ত। এগুলোও এখন ধ্বংসের পথে, ব্যক্তি খাতে চলে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গণপরিবহন এখন আর সামাজিক খাতে নেই। এগুলো মুনাফাখোরদের হাতে চলে গেছে। টাকা থাকলে এসব সেবা কেনা যায়। যাঁর টাকা নেই, তাঁর আল্লাহ ভরসা।

এ দেশের মুনাফাখোরেরা টাকার পেছনে দৌড়ালেও মানের দিকে নজর দেন না। মানসম্পন্ন সেবা দিয়েও যে মুনাফা করা যায়, এটি তাঁরা জানেন না বা মানেন না। যে লুণ্ঠনপ্রক্রিয়া এ দেশে চালু হয়েছিল পাঁচ দশক আগে, এখন তা সর্বব্যাপী। এ দেশে বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। তার বদলে তৈরি হয়েছে লুটেরা শ্রেণি, ‘লুম্পেন বুর্জোয়া’। তাঁরা কলকারখানা, মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, পাহাড়-জলাভূমি সব খেয়ে ফেলেছেন। তারপরও তাঁদের পেট ভরেনি। শহরে পাখি নেই, নিশ্বাস নেওয়ার মতো এতটুকু বাতাস নেই, খাওয়ার মতো এক আঁজলা জল নেই, খেলাধুলার জন্য নেই এক টুকরা মাঠ। সব ছিনতাই হয়ে গেছে।

কত বছর ধরে শুনে আসছি, শহরে মানুষের তুলনায় রাস্তা কম, যানবাহন বেশি। ছোট গাড়িগুলো একজন বা দুজনকে নিয়ে শাঁই করে চলে যায়। অনেক বেশি যাত্রী নিয়ে বড় গাড়ি চলাচল করলে মানুষের সুবিধা বাড়ে। যানজট কম হয়। এত বছরেও সেটির বাস্তবায়ন দেখলাম না। ঢাকা শহরে বিভিন্ন রুটে কয়েক হাজার ডাবলডেকার বাস নামিয়ে দিলে মানুষ আরাম পেত। কিন্তু পাবলিকের টাকায় সোফাসমেত গাড়ি চড়ে যাঁরা পোদ্দারি করেন, সিদ্ধান্ত তো নেন তাঁরা। সে জন্য গণপরিবহনের ব্যবস্থা হয় না। এক রুটের মেট্রোরেল দিয়ে বিগত সরকার যে তেলেসমাতি দেখাল, তার গন্ধ হাতে চেটে আর কত কাল কাটাবে মানুষ!

জননিরাপত্তা নিয়ে কী আর বলব? এক উপদেষ্টা বলেছেন, পুলিশের শতকরা ৮০ ভাগই নাকি ছাত্রলীগের ক্যাডার। তার মানে, জননিরাপত্তা নয়, তাঁদের নেতাকে সুরক্ষা দিতেই তাঁরা বেতন-ভাতা নিতেন। আমরা দেখলাম, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর রাস্তায় ট্রাফিক সামলেছেন ছাত্ররা। অভিজ্ঞতার অভাবে তাঁরা ছিলেন অনেকটা এলোমেলো। প্রশিক্ষণ পেলেই তাঁরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতেন। এই তারুণ্যকে কাজে লাগাতে পারত ইউনূস সরকার। সেটি হয়নি। পুলিশের অনেক লোক পলাতক ছিলেন। অনেকেই ফিরে আসেননি। ওই তরুণদের মধ্য থেকেই এক লাখ সদস্যকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে পুলিশ বিভাগে নিয়োগ দেওয়া যেত। তাঁদের অনেকেরই ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে।  যখন যে কাজটি করতে হয়, তার সিদ্ধান্ত নিতে হয় চটজলদি। একটি বিপ্লবী সরকার থাকলে তা-ই হতো। সিদ্ধান্ত নিতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগত না। নবিশরাই কালক্ষেপণ করে।

কথাবার্তায় মনে হয়, এই সরকারের প্রধান কাজ হলো অতীতের জঞ্জাল সাফ করা। অর্থাৎ গত ১৬ বছরে যে ময়লা জমেছে, তা পরিষ্কার করা। এখানেও একটা শুভংকরের ফাঁকি আছে। সমস্যাটা ১৬ বছরের নয়, এটি ৫৩ বছরের। শুধু অতীতের জাবর কাটলে তো জীবন চলবে না। তাকাতে হবে সামনের দিকে। আপনারা কাকে ধরবেন, কাকে ডান্ডাবেড়ি পরাবেন, কাকে ঝোলাবেন, সেটি নাহয় চলবে। কিন্তু ১০-২০ হাজার লোককে জেলে ঢোকালে আমাদের কী লাভ? আমরা তো ঘরের কাছের হাসপাতালে চিকিৎসা চাই। শেখ হাসিনা যেমন হাসপাতালে কারফিউ দিয়ে একা একা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ১০ টাকার স্লিপ কেটে ডাক্তার দেখাতেন, সে রকম নয়। হাসপাতালে ডাক্তার-নার্স থাকবেন, যন্ত্রপাতি থাকবে, চাওয়ামাত্র চিকিৎসা পাওয়া যাবে, এ রকম ব্যবস্থা নেই কেন? ওয়ার্ডবয়কে ঘুষ দিয়ে বেড নিতে হয় কেন?

বছরের শুরুতে সন্তানের স্কুলে ভর্তি নিয়ে মা-বাবার ঘুম হারাম হয়ে যায়। বছরের পর বছর কি এমন চলতে থাকবে? দেশের প্রাথমিক শিক্ষার বারোটা বেজে গেছে। আর আপনারা একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করছেন? বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার যে মান, তাদের বিদেশে তো দূরের কথা, দেশে চাকরি মেলাই ভার। এরা তো অনেকে ঠিকমতো কথাই বলতে পারে না?

দেশে সংস্কার দরকার। এটা আজ নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই দরকার ছিল। কিন্তু আমাদের শাসকেরা শুধু নিজের, পরিবারের আর গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখেছেন, সাধারণ মানুষের কথা ভাবেননি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর পরিবহন সেক্টর তুলে দিয়েছেন প্রাইভেট মাফিয়ার হাতে। একটা উদাহরণ দিই। এ দেশের নেতা, এমপি, মন্ত্রীরা নিজ এলাকায় যথেচ্ছ স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বানিয়েছেন, নিজের কিংবা বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ির নামে। তারপর সেগুলো এমপিওভুক্ত করিয়েছেন। এমপিওভুক্ত হলে সরকারি কোষাগার থেকে শিক্ষকদের জন্য বেতনের টাকা পাওয়া যায়। তো তাঁরা ইচ্ছেমতো তাঁদের আত্মীয়স্বজন ও খিদমতগারদের ওই সব প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়েছেন। এখন তাঁরা অনেকেই দাবি করছেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে হবে। এসব দাবি মানার আগে যাচাই করে দেখা দরকার ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্ম-ইতিহাস।

পাঁচ হাজার ডাবলডেকার বাস আমদানি করতে কত টাকা লাগে? কত দিন লাগে? সরকার চাইলে কত কি না পারে। এ দেশে দুষ্টচক্রের মতো পরিবহন মাফিয়া তৈরি হয়েছে। সব সরকার সেগুলো নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে লালন–পালন করেছে। এই মাফিয়া না ভাঙতে পারলে নতুন পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো পাবলিকের টাকায় গাড়ি, তেল, ড্রাইভার ব্যবহার করতে করতে যাঁরা আকারে-প্রকারে বড় হয়েছেন, তাঁরা কি আদৌ গণপরিবহনের কথা ভাবেন?

আপনারা যথেচ্ছ রাজনীতি করুন। কিন্তু সাধারণ মানুষের কথাও একটু ভাবুন। মানুষ শুধু ভোটার নয়, আন্দোলনে কামানের খোরাক নয়। দেশ মানেই মানুষ। মানুষের জন্যই রাষ্ট্র, সংবিধান, সরকার। মানুষ একবার খেপে গেলে কেউই রক্ষা পায় না। এটা আমরা দেখেছি একাত্তরের মার্চে, চব্বিশের আগস্টে।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র র র জন য করছ ন দরক র বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদ নিয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে

ফরাসি বিপ্লবের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলা হয়ে থাকে ‘বিপ্লব তার সন্তানদেরই খেয়ে ফেলে’। আধুনিক যুগের বিপ্লব প্রায়ই পুরোনো সংবিধানকে খেয়ে ফেলে। ব্রিটিশ রাজকবি আলফ্রেড টেনিসনের ভাষায়, পুরোনো বন্দোবস্ত সরে গিয়ে স্থান করে দেয় নতুন ব্যবস্থাকে। জার্মান আইনবিদ কার্ল স্মিটের ভাষায়, ‘স্টেট অব এক্সেপশন’ অর্থাৎ ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’র উদ্ভব ঘটে। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা এবি সিয়েসের মতে, জনগণের গাঠনিক ক্ষমতার উন্মেষ ঘটে।

স্মিটের মতে, ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় যে বা যাঁরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তিনি বা তাঁরাই সার্বভৌম। এই সার্বভৌম শক্তি আইনের বাইরে ও আইনের ঊর্ধ্বে। পুরোনো আইনব্যবস্থা, শাসনতন্ত্র, ক্ষমতাকাঠামো বা বিধিবিধান, কোনো কিছু দিয়েই এই পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করা যায় না; সেসব থেকে এর চূড়ান্ত বৈধতার নিদান খোঁজাও যায় না। পুরোনো ব্যবস্থা সেই সমাধান দিতেও সক্ষম নয়। বিদ্যমান সবকিছুই পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায় নয়া সার্বভৌম শক্তির সব সিদ্ধান্তের অধীনে প্রয়োগ হয়।

চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামোয় যে অবস্থা বিরাজ করছে, সেটাকে এক ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’ বলা যায়। কারণ, বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় এটাকে ব্যাখ্যা করা ও সেই ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না; কোনো না কোনো অধিসাংবিধানিক প্রক্রিয়ার শরণ নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

বাস্তবে ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ পুরোনো ব্যবস্থার পদ্ধতি মেনেই নেওয়া হয়। কারণ, পদ্ধতিগুলো প্রায় সব জায়গাতেই একই থাকে। পার্থক্য থাকে শুধু কোন সার্বভৌম শক্তি সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, কেন, কীভাবে, কখন, কাকে দিচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে।

আরও একটি কারণে আগের মতো করেই কাজগুলো করা হয়, সেটা হলো, এ পদ্ধতিগুলো শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা, সার্বভৌম শক্তিকে সাধারণ জনগণের কাছে সহজে অনুভূত বা আবির্ভূত হওয়া ও অনুকরণযোগ্য সবচেয়ে ভালো শাসনতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রয়োগ করা সুবিধাজনক। কিন্তু যত যা–ই হোক না কেন, সব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপই নতুন সার্বভৌম শক্তির সিদ্ধান্তের অধস্তন হয়ে যায়।

২.

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আমরা যে ‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’য় ঢুকে গিয়েছি, তা ছাত্র–জনতার দাবি ও সক্রিয় আন্দোলনের মুখে সাংবিধানিক পদাধিকারী বিভিন্ন ব্যক্তির পদত্যাগ বা অব্যাহতির ঘটনা থেকে আঁচ করা যায়। স্বাভাবিক সাংবিধানিক অবস্থায় ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ বা জাতীয় সংসদে অভিশংসনের প্রক্রিয়া ছাড়া এদের পদচ্যুত করার সুযোগ নেই; কিন্তু সবই হয়েছে আর তা হয়েছে পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায়, যেখানে অভ্যুত্থানে বিজয়ীদের অভিপ্রায়ই প্রাধান্য লাভ করে।

তত্ত্বে যেভাবেই থাক না কেন, আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার ইতিহাসে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৯৫৮ সালের পাকিস্তানে আইয়ুব খান সংবিধান রদ করে ‘আইন (বলবৎকরণ) আদেশ, ১৯৫৮’ জারি করেন। তাতে ১৯৫৬ সালের সংবিধানকে মৃত সংবিধান অভিহিত করে রদ করা হলেও সেটিকেই আবার ‘ভেন্টিলেশন’–এ আনা হয়। বলা হয়, রাষ্ট্রীয় সব কর্মকাণ্ড যত দূর সম্ভব ‘মৃত সংবিধান’ অনুযায়ীই চলবে, তবে সামরিক আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে।

১৯৬৯ সালে আইয়ুব নিজেই যখন মসনদ ছাড়তে বাধ্য হন, তখন ইয়াহিয়া খান মার্শাল ল জারি করে সংবিধান রদ করে হুবহু একই পদ্ধতি অবলম্বন করেন ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৬৯’ দিয়ে।

আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে মতভেদ এত প্রবল কেন?৩০ আগস্ট ২০২৫

বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্টে জারি করা মার্শাল ল প্রোক্লেমেশনের ঙ ও চ—দফার মাধ্যমে ঘোষণাপত্র ও সামরিক আইন বিধিমালা ও আদেশ সাপেক্ষে সংবিধান বলবৎ রাখা হয়। এই অধিসাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনেই ১৯৭৫-৭৯ পর্যন্ত প্রণীত অনেকগুলো ‘প্রোক্লেমেশন অর্ডার’ বলেই সংবিধান সংশোধন করা হয়।

এসব সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন ঘটানো সাংবিধানিক কাঠামো দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করে ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সেই সাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনেই সম্পন্নের পর গঠিত জাতীয় সংসদে সেগুলো অনুমোদিত হয়। ভুলে গেলে চলবে না যে পঞ্চম সংশোধনী দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে সংবিধানে কোনো সংশোধনীই আনা হয়নি, শুধুই অধিসাংবিধানিক বন্দোবস্তের অধীনে আনা সংশোধনীগুলোই অনুমোদন করা হয়।

১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সংবিধান স্থগিত করে দেন এবং আরেক কাঠি সরেস হয়ে ২৪ মার্চ ১৯৮২ জারি করা মার্শাল ল প্রোক্লেমেশনকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে ঘোষণা করে এর অধস্তন হিসেবে পূর্ববর্তী সব আইনকানুন, ব্যবস্থা চালু রাখেন। এর অধীনে তিনিও ‘প্রোক্লেমেশন অর্ডার’ জারি করে সংবিধানে সংশোধনী আনেন, যেগুলো পরে সপ্তম সংশোধনী হিসেবে অনুমোদিত হয়।

১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশ সরকার একটি আইন জারি করে ‘আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ, ১৯৭১’ নামে। এ আইনের বলে ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত বিদ্যমান সব আইন, বিধিবিধানকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অধীনে কার্যকর রাখা হয়। এরও আগে ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির সময়েও দেখা যায়, নতুন বন্দোবস্তের আলোকে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ এর ১৮(৩) ধারাতেও উভয় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আগের সব আইন কার্যকর রাখা হয়।

এসব দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায়, যারাই একটা নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করে, তারা পূর্বের সংবিধান বা আইনি কাঠামোর যেটুকু মানতে চায়, সেটুকুই নিতে পারে। চাইলে পুরোটাই নিতে পারে, না চাইলে পুরোপুরি বাদও দিতে পারে। একবার পূর্ববর্তী সংবিধানের কিছু নিয়েছে বলেই তা সব সময় মেনে চলতে হবে, এ রকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

প্রকৃতপক্ষে এটা অভ্যুত্থানের একটা মূলনীতি; পূর্বের কাঠামো থেকে যত দূর সম্ভব বেরিয়ে আসা। কিন্তু যত দিন পর্যন্ত পুরোপুরি বেরিয়ে আসা সম্ভব না হয়, তত দিন আগের রাষ্ট্রকাঠামোর কলকবজাগুলো প্রয়োজনমতো গৃহীত বা বর্জিত হয়। তাদের এই ম্যান্ডেট দেয় অভ্যুত্থানকারী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী।

৩.

এমন পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের রাজনৈতিক পরিসরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা আরেকটা বয়ান নিয়ে দুটো কথা না বললেই নয়। এটি প্রথম প্রকাশ্যে আনেন কবি, লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তাঁর মতে, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী শপথ নেওয়ার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘বিপ্লবী চরিত্র’ নষ্ট হয়ে গেছে।

ফরহাদ মজহারের এ রকম বক্তব্যে যুক্তি আছে কি নেই, তাঁর চেয়ে বড় কথা হলো, গণ–অভ্যুত্থানের রাজনীতি, সরকারের বৈধতা, শাসনতান্ত্রিক পরম্পরার ব্যাপারগুলোতে এটাই একমাত্র বা শেষ কথা নয়। এর কারণটি হলো, কাঠামো বদলে গেলেই বৈধতার নতুন পথ তৈরি হয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানিরা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী অনেক জাতীয় পার্লামেন্ট সদস্যকে (এমএনএ) অযোগ্য ঘোষণা করে। তারপর সেসব আসনে উপনির্বাচন দিয়ে বেশির ভাগ আসনে পছন্দের প্রার্থীদের একতরফাভাবে জিতিয়ে আনে।

কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী পূর্বের পার্লামেন্ট সদস্যরাই গণপরিষদের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেন। একই সময় পাকিস্তানেও একটি গণপরিষদ গঠিত হয় ’৭০–এর নির্বাচনে বিজয়ীদের নিয়ে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত দুজন এমপি ছিলেন নুরুল আমীন ও রাজা ত্রিদিব রায়। বাংলাদেশের গণপরিষদে আবার এই দুজনকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

এ থেকে বোঝা যায়, জনগণের অভিপ্রায় বদলে গিয়েছিল বলেই নতুন কাঠামোর জন্ম হয়েছিল, বৈধতার নতুন নতুন নিয়ম ও পদ্ধতি তৈরি হয়েছিল।

বিশুদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া পরবর্তী সংসদকেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য করার সুযোগ নেই। কারণ, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সেই সংসদও নিজেদের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ম্যান্ডেট পাবে। তখন তারা নতুন আরেকটি সাংবিধানিক কাঠামোর জন্ম দেবে। তারা যদি জুলাই সনদের আংশিক বাস্তবায়ন করে, তখন তাদের বাধ্য করার ক্ষমতা সংবিধানে থাকবে না; শুধুই রাজপথই হতে পারে তার সমাধান।৪.

আধুনিক কালে সরকার বা কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈধতার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পথ হলো সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ভূখণ্ডের নাগরিক, সামাজিক–রাজনৈতিক সংগঠন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ। শুরুতেই জনগণ ও বহির্বিশ্বের স্বীকৃতির ভেতর দিয়ে জুলাই-উত্তর নয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা তার সার্বভৌম ক্ষমতা সুসংহত করেছে।

এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে চলতি সংবিধানের আওতায় শপথ নিলেও তাতে অন্তর্বর্তী সরকারের বিপ্লবী চরিত্র ক্ষুণ্ন হয়নি বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ, ৩৬ জুলাই এখানে জনগণের গাঠনিক ক্ষমতার উন্মেষ ও একটা ‘পরম ব্যতিক্রমী অবস্থা’র জন্ম দিয়েছে।

‘পরম ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’ সার্বভৌম ক্ষমতাকে বাছাই করার ম্যান্ডেট দেয়, কী করতে হবে আর কী না করলেও চলবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে আদালতের মতামত নেওয়া এবং বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণকে ‘অবৈধ’ বলার সুযোগ নেই।

আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে কিছু ভাবনা১৮ আগস্ট ২০২৫৫.

তাহলে জুলাই সনদ নিয়ে কি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে? এর জবাব হলো, সেটা হতেও পারে, আবার না–ও হতে পারে। এটাও সার্বভৌম ক্ষমতার সিদ্ধান্তের বিষয়। এ রকম প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন হলো, আগামী নির্বাচন কি গণপরিষদ নির্বাচন হবে? সেখানে কি জুলাই সনদ অনুযায়ী সংবিধান পুনর্লিখন করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত?

লক্ষণীয়, ১৯৭২ সালে গঠিত গণপরিষদ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তারা পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য রায় পেয়েছিলেন। আবার সেই নির্বাচনে জয়ী দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে ভোট পেয়েছিল ৭৫ দশমিক ১১ শতাংশ। ফলে অঙ্কের হিসাবেই এখানকার ২৫ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্বও সেই গণপরিষদের ছিল না।

আবার গণপরিষদ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে গণপরিষদের সদস্যদের সদস্যপদ বাতিল আদেশ পাস করে এর তাঁদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মতপ্রকাশের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এভাবে ২০ জনকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। ফলে ওই গণপরিষদের পক্ষে স্বাধীনভাবে জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা সম্ভব ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

সর্বোপরি ওই গণপরিষদের দ্বারা প্রণীত সংবিধান অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি; এ দেশে বারবার ঘটা গণ–অভ্যুত্থান, সংবিধান স্থগিত, সংবিধান পুনর্লিখনের মতো ঘটনাগুলো থেকেই তা বোঝা যায়। এর ফলে জনগণকে স্বাধীনভাবে তাদের অভিপ্রায় প্রকাশের সুযোগ দিতে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিকে ইতিবাচক বলেই প্রতীয়মান হয়।

 এ রকম পটভূমিতে জুলাই সনদের আইনগত অবস্থান বা এর বাস্তবায়নের পদ্ধতিকে বিবেচনায় নিতে হবে। ৫ আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় থাকা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা। আর এই পুরো কর্মযজ্ঞের প্রতিভূ হিসেবেই ধরতে হবে জুলাই সনদকে। সে ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বন্দোবস্তের ভেতর দিয়েই এর বাস্তবায়ন হওয়াই মানানসই হয়।

আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে গতানুগতিক সাংবিধানিক বন্দোবস্তে ফেরত আসার পর জুলাই সনদের বাস্তবায়নকে বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে বা এর মুখাপেক্ষী করা হলে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা তার কর্তৃত্ব হারাবে। এতে যে সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে উৎখাত করে জুলাই সংঘটিত হয়েছিল, সেই ব্যবস্থার অধীনেই জুলাই অভ্যুত্থানের বৈধতা-অবৈধতার বিচার বা পর্যালোচনার বিষয়টি উন্মুক্ত হয়ে পড়বে।

আরও পড়ুনজুলাই ঘোষণাপত্র: জন-আকাঙ্ক্ষা এবং রাষ্ট্রের অভিপ্রায়০৮ আগস্ট ২০২৫

আবার পরবর্তী সংসদই কেবল এগুলো বাস্তবায়ন করার আইনগত ক্ষমতার অধিকারী, এটাও অলঙ্ঘনীয় কোনো ব্যাপার নয়।

পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর ক্ষেত্রে এ রকম দেখা গেছে; একইভাবে জুলাই সনদ আগে বাস্তবায়ন করে পরে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে অনুমোদন নেওয়া যেতে পারে।

বিশুদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া পরবর্তী সংসদকেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বাধ্য করার সুযোগ নেই। কারণ, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত সেই সংসদও নিজেদের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ম্যান্ডেট পাবে। তখন তারা নতুন আরেকটি সাংবিধানিক কাঠামোর জন্ম দেবে। তারা যদি জুলাই সনদের আংশিক বাস্তবায়ন করে, তখন তাদের বাধ্য করার ক্ষমতা সংবিধানে থাকবে না; শুধুই রাজপথই হতে পারে তার সমাধান।

কিন্তু সব রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা রাজপথে হওয়া রাজনৈতিক পরিপক্বতার লক্ষণ নয়। কিছু ফয়সালা জাতীয় ঐকমত্য, কিছু নির্বাচনে আর কিছু সংসদে নেওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে রাষ্ট্রের স্থিতিশীতলতা। জুলাই সনদ প্রশ্নে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে।

মিল্লাত হোসেন আইন–আদালত, সংবিধান বিষয়ে লেখক ও গবেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদ নিয়ে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে