সাধারণ মানুষের কথাও একটু ভাবুন
Published: 7th, February 2025 GMT
মানুষ কষ্টে আছে। কিন্তু রাজনীতির ডামাডোলে মানুষের কষ্টের কথাগুলো চাপা পড়ে যায়। চারদিকে শুধু সংস্কার আর নির্বাচনের কথা। এর মধ্যে চলছে নানান আন্দোলন ও আবদার। বিশ্ববিদ্যালয় দিতে হবে, চাকরি স্থায়ী করতে হবে, গ্রেড বদলাতে হবে, ক্যাডারে নিতে হবে কিংবা ক্যাডার থেকে বাদ দিতে হবে, মহার্ঘ ভাতা দিতে হবে ইত্যাদি। এসব করতে অনেক টাকার দরকার। সরকারের টাকা নেই। জনগণের কষ্টের রোজগারের টাকা সরকারের টাকা নামে চালিয়ে দেওয়া হয়। যাঁরা আন্দোলন-আবদার করছেন, তাঁরা কি জানেন না যে এত কিছু চাইলে জনগণের ওপর কত চাপ পড়বে? এমনিতেই তো মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের অবস্থা ত্রাহি মধুসূদন!
দেশে একটা নতুন সরকার এসেছে। একটা গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আসলে এটা আর সব সরকারের মতোই। কথাবার্তায়, আচার-আচরণে কোনো ফারাক নেই। তাঁদের অনেকেরই এক বা একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাড়ি আছে। কিন্তু প্রায় সবাই ‘সরকারি’ গাড়ি-বাড়ি’ নিয়েছেন। কাউকে বলতে শুনলাম না, আমার গাড়ি আছে, আমি সরকারি গাড়ি নেব না। এটা বলতে মেরুদণ্ড লাগে, গাটস লাগে। লাল ম্যাটের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা ফিতা কেটে প্রকল্প উদ্বোধন করছেন, সাংবাদিকদের সামনে কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছেন। ১৬ বছর এটা হয়নি, ওটা হয়নি বলে আক্ষেপ করছেন। এভাবে কত দিন যাবে?
অনেক মানুষ এখনো বিশ্বাস করেন, তাঁদের দেখভাল করার জন্য, তাঁদের মুশকিল আসান করতে কয়েক বছর পরপর আসমান থেকে দেবদূতেরা এসে হাজির হন। মন্ত্রীরাও এ রকম। এখন তাঁদের বলা হচ্ছে উপদেষ্টা। পদমর্যাদায় মন্ত্রী। পাকিস্তান আমলে বলা হতো উজির। তাঁরা কি জানেন না, সাধারণ মানুষের সমস্যা কী, প্রয়োজন কী, দাবি কী? তাঁরা তো একসময় ‘সাধারণের’ কাতারেই ছিলেন।
একটা সভ্য সমাজে টিকে থাকতে ও চলাফেরা করতে ন্যূনতম চারটি বিষয় লাগে—স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গণপরিবহন ও নিরাপত্তা (আইনশৃঙ্খলা)। আমাদের দেশে এসব সব সময়ই ছিল অপর্যাপ্ত। এগুলোও এখন ধ্বংসের পথে, ব্যক্তি খাতে চলে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গণপরিবহন এখন আর সামাজিক খাতে নেই। এগুলো মুনাফাখোরদের হাতে চলে গেছে। টাকা থাকলে এসব সেবা কেনা যায়। যাঁর টাকা নেই, তাঁর আল্লাহ ভরসা।
এ দেশের মুনাফাখোরেরা টাকার পেছনে দৌড়ালেও মানের দিকে নজর দেন না। মানসম্পন্ন সেবা দিয়েও যে মুনাফা করা যায়, এটি তাঁরা জানেন না বা মানেন না। যে লুণ্ঠনপ্রক্রিয়া এ দেশে চালু হয়েছিল পাঁচ দশক আগে, এখন তা সর্বব্যাপী। এ দেশে বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। তার বদলে তৈরি হয়েছে লুটেরা শ্রেণি, ‘লুম্পেন বুর্জোয়া’। তাঁরা কলকারখানা, মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, পাহাড়-জলাভূমি সব খেয়ে ফেলেছেন। তারপরও তাঁদের পেট ভরেনি। শহরে পাখি নেই, নিশ্বাস নেওয়ার মতো এতটুকু বাতাস নেই, খাওয়ার মতো এক আঁজলা জল নেই, খেলাধুলার জন্য নেই এক টুকরা মাঠ। সব ছিনতাই হয়ে গেছে।
কত বছর ধরে শুনে আসছি, শহরে মানুষের তুলনায় রাস্তা কম, যানবাহন বেশি। ছোট গাড়িগুলো একজন বা দুজনকে নিয়ে শাঁই করে চলে যায়। অনেক বেশি যাত্রী নিয়ে বড় গাড়ি চলাচল করলে মানুষের সুবিধা বাড়ে। যানজট কম হয়। এত বছরেও সেটির বাস্তবায়ন দেখলাম না। ঢাকা শহরে বিভিন্ন রুটে কয়েক হাজার ডাবলডেকার বাস নামিয়ে দিলে মানুষ আরাম পেত। কিন্তু পাবলিকের টাকায় সোফাসমেত গাড়ি চড়ে যাঁরা পোদ্দারি করেন, সিদ্ধান্ত তো নেন তাঁরা। সে জন্য গণপরিবহনের ব্যবস্থা হয় না। এক রুটের মেট্রোরেল দিয়ে বিগত সরকার যে তেলেসমাতি দেখাল, তার গন্ধ হাতে চেটে আর কত কাল কাটাবে মানুষ!
জননিরাপত্তা নিয়ে কী আর বলব? এক উপদেষ্টা বলেছেন, পুলিশের শতকরা ৮০ ভাগই নাকি ছাত্রলীগের ক্যাডার। তার মানে, জননিরাপত্তা নয়, তাঁদের নেতাকে সুরক্ষা দিতেই তাঁরা বেতন-ভাতা নিতেন। আমরা দেখলাম, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর রাস্তায় ট্রাফিক সামলেছেন ছাত্ররা। অভিজ্ঞতার অভাবে তাঁরা ছিলেন অনেকটা এলোমেলো। প্রশিক্ষণ পেলেই তাঁরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতেন। এই তারুণ্যকে কাজে লাগাতে পারত ইউনূস সরকার। সেটি হয়নি। পুলিশের অনেক লোক পলাতক ছিলেন। অনেকেই ফিরে আসেননি। ওই তরুণদের মধ্য থেকেই এক লাখ সদস্যকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে পুলিশ বিভাগে নিয়োগ দেওয়া যেত। তাঁদের অনেকেরই ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে। যখন যে কাজটি করতে হয়, তার সিদ্ধান্ত নিতে হয় চটজলদি। একটি বিপ্লবী সরকার থাকলে তা-ই হতো। সিদ্ধান্ত নিতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগত না। নবিশরাই কালক্ষেপণ করে।
কথাবার্তায় মনে হয়, এই সরকারের প্রধান কাজ হলো অতীতের জঞ্জাল সাফ করা। অর্থাৎ গত ১৬ বছরে যে ময়লা জমেছে, তা পরিষ্কার করা। এখানেও একটা শুভংকরের ফাঁকি আছে। সমস্যাটা ১৬ বছরের নয়, এটি ৫৩ বছরের। শুধু অতীতের জাবর কাটলে তো জীবন চলবে না। তাকাতে হবে সামনের দিকে। আপনারা কাকে ধরবেন, কাকে ডান্ডাবেড়ি পরাবেন, কাকে ঝোলাবেন, সেটি নাহয় চলবে। কিন্তু ১০-২০ হাজার লোককে জেলে ঢোকালে আমাদের কী লাভ? আমরা তো ঘরের কাছের হাসপাতালে চিকিৎসা চাই। শেখ হাসিনা যেমন হাসপাতালে কারফিউ দিয়ে একা একা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ১০ টাকার স্লিপ কেটে ডাক্তার দেখাতেন, সে রকম নয়। হাসপাতালে ডাক্তার-নার্স থাকবেন, যন্ত্রপাতি থাকবে, চাওয়ামাত্র চিকিৎসা পাওয়া যাবে, এ রকম ব্যবস্থা নেই কেন? ওয়ার্ডবয়কে ঘুষ দিয়ে বেড নিতে হয় কেন?
বছরের শুরুতে সন্তানের স্কুলে ভর্তি নিয়ে মা-বাবার ঘুম হারাম হয়ে যায়। বছরের পর বছর কি এমন চলতে থাকবে? দেশের প্রাথমিক শিক্ষার বারোটা বেজে গেছে। আর আপনারা একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করছেন? বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার যে মান, তাদের বিদেশে তো দূরের কথা, দেশে চাকরি মেলাই ভার। এরা তো অনেকে ঠিকমতো কথাই বলতে পারে না?
দেশে সংস্কার দরকার। এটা আজ নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই দরকার ছিল। কিন্তু আমাদের শাসকেরা শুধু নিজের, পরিবারের আর গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখেছেন, সাধারণ মানুষের কথা ভাবেননি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর পরিবহন সেক্টর তুলে দিয়েছেন প্রাইভেট মাফিয়ার হাতে। একটা উদাহরণ দিই। এ দেশের নেতা, এমপি, মন্ত্রীরা নিজ এলাকায় যথেচ্ছ স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বানিয়েছেন, নিজের কিংবা বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ির নামে। তারপর সেগুলো এমপিওভুক্ত করিয়েছেন। এমপিওভুক্ত হলে সরকারি কোষাগার থেকে শিক্ষকদের জন্য বেতনের টাকা পাওয়া যায়। তো তাঁরা ইচ্ছেমতো তাঁদের আত্মীয়স্বজন ও খিদমতগারদের ওই সব প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়েছেন। এখন তাঁরা অনেকেই দাবি করছেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে হবে। এসব দাবি মানার আগে যাচাই করে দেখা দরকার ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্ম-ইতিহাস।
পাঁচ হাজার ডাবলডেকার বাস আমদানি করতে কত টাকা লাগে? কত দিন লাগে? সরকার চাইলে কত কি না পারে। এ দেশে দুষ্টচক্রের মতো পরিবহন মাফিয়া তৈরি হয়েছে। সব সরকার সেগুলো নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে লালন–পালন করেছে। এই মাফিয়া না ভাঙতে পারলে নতুন পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো পাবলিকের টাকায় গাড়ি, তেল, ড্রাইভার ব্যবহার করতে করতে যাঁরা আকারে-প্রকারে বড় হয়েছেন, তাঁরা কি আদৌ গণপরিবহনের কথা ভাবেন?
আপনারা যথেচ্ছ রাজনীতি করুন। কিন্তু সাধারণ মানুষের কথাও একটু ভাবুন। মানুষ শুধু ভোটার নয়, আন্দোলনে কামানের খোরাক নয়। দেশ মানেই মানুষ। মানুষের জন্যই রাষ্ট্র, সংবিধান, সরকার। মানুষ একবার খেপে গেলে কেউই রক্ষা পায় না। এটা আমরা দেখেছি একাত্তরের মার্চে, চব্বিশের আগস্টে।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র র জন য করছ ন দরক র বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
‘শত শত বাস আসছে, পা ফেলানোর জায়গা নাই’
টাঙ্গাইলের কালিহাতীর নারান্দিয়ার বাসিন্দা শেফালী বেগম। সাভারের বাইপাইল এলাকার একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন তিনি। ঈদুল আজহার ছুটি শেষ হওয়ায় শনিবার (১৪ জুন) বিকেলে প্রায় চার ঘণ্টা কালিহাতীর এলেঙ্গায় বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন এই নারী। বাসে উঠতে না পেরে কর্মস্থলে যেতে তাকে উঠতে হয় পিকআপ ভ্যানে। ২০০ টাকার জায়গায় ৩৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে রওনা হন গন্তব্যে।
যাত্রা শুরুর আগে শেফালী বলেন, “গরম ও সড়কের ধুলাবালিতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। সড়কে চার ঘণ্টা দাঁড়িয় থেকে উপায় না পেয়ে পিকআপে করে ঢাকায় যেতে হচ্ছে।”
শুধু শেফালী নয়, তার মতো লাখ লাখ মানুষ আজ দিনভর ভোগান্তি নিয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল-যমুনা সেতু মহাসড়কে দিয়ে ঢাকায় কর্মস্থলে ফিরছেন। শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে শত শত মানুষকে গণপরিবহনের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। কেউ ২ ঘণ্টা, কেউ ৩ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছিলেন গণপরিবহনের জন্য।
আরো পড়ুন:
গাজীপুরে মহাসড়কে কর্মস্থলে ফেরা মানুষের চাপ
সিরাজগঞ্জে গাড়ির অপেক্ষায় কর্মস্থলে ফেরা মানুষ
জুলেখা বেগম বলেন, “আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। উত্তরবঙ্গ থেকে শত শত বাস আসছে, কিন্তু কোনো বাসেই পা ফেলানোর মতো জায়গা নাই। গরমও সহ্য হচ্ছে না।”
কর্মস্থলে ফিরতে বাসের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের একাংশ
ইকবাল আলী বলেন, “মহাসড়কে ভোগান্তি ছাড়া কিছুই দেখছি না। পরিবহনগুলোতে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।”
হারুন মিয়া নামে এক ট্রাক চালক বলেন, “সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত আসতে ১০ ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। স্বাভাবিক সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা।”
এর আগে, গতকাল শুক্রবার মধ্যরাত থেকে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, একাধিক সড়ক দুর্ঘটনা ও যানবাহন বিকল হওয়ায় যমুনা সেতুর টোলপ্লাজা থেকে টাঙ্গাইলের রাবনা পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে তা কমে ১৪ কিলোমিটারে আসে। এছাড়া, মহাসড়কে গণপরিবহনের সংকট থাকায় কয়েক গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খোলা ট্রাক ও পিকআপে গন্তব্যে যাচ্ছে মানুষ। সব মিলিয়ে কর্মস্থলে ফেরা মানুষের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
শুক্রবার রাত ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪৯ হাজার ১৮২টি যানবাহন যমুনা সেতা পারাপার করেছে। এ থেকে টোল আদায় হয়েছে ৩ কোটি ৪৩ লাখ ১৩ হাজার ২০০ টাকা।
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, “মহাসড়কে যানজট নিরসনে পুলিশ কাজ করছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।”
ঢাকা/কাওছার/মাসুদ