Samakal:
2025-06-16@17:12:32 GMT

বহুপক্ষীয় হওয়াই বাঞ্ছনীয়

Published: 10th, February 2025 GMT

বহুপক্ষীয় হওয়াই বাঞ্ছনীয়

বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের প্রাণপ্রবাহ বলিয়া পরিচিত তিস্তা নদী ঘিরিয়া বহুল আলোচিত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যেইভাবে উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে, উহা নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। তিস্তাতীরবর্তী জনসাধারণের উৎসাহ স্বাভাবিকভাবেই দ্বিগুণ হইতে বাধ্য। রবিবার রংপুরে তিস্তা রেলসেতু এলাকায় জেলা প্রশাসন আয়োজিত গণশুনানি অনুষ্ঠানে জনসমাগমেই উহা স্পষ্ট। কেবল সশরীতে উপস্থিতির ক্ষেত্রে নহে, গত কয়েক বৎসর ধরিয়া ঐ অঞ্চলের মানুষ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পক্ষে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে উহার পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করিয়া আসিতেছে। মহাপরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনও কম অনুষ্ঠিত হয় নাই। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারও উহার পক্ষে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ লইয়াছিল। প্রকল্পের প্রস্তাবনা ও বাস্তবায়নের সহিত চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পৃক্ত থাকিবার কারণে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারই শেষ মুহূর্তে কীভাবে পিছাইয়া আসিয়াছিল, আমরা জানি। এমনকি ঐ সরকারের পক্ষে যেইভাবে চীনের পরিবর্তে ভারতকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিবার মাধ্যমে মহাপরিকল্পনাটি যে কার্যত ঝুলাইয়া দেওয়া হইয়ছিল, উহা বুঝিবার জন্য বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন ছিল না। সেই প্রেক্ষাপটে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ উৎসাহব্যঞ্জকই বটে। 

আমরা জানি, ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হইতে বাংলাদেশে নামিয়া আসা নদীটির বর্তমান দশা ঐ জনগোষ্ঠীর জন্যই অধিকতর দুর্যোগময়। বর্ষা মৌসুমে বিপুল প্রবাহ যদ্রূপ প্রবল বন্যা ও করাল ভাঙনের সৃষ্টি করে; শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহস্বল্পতা এমনকি প্রবাহশূন্যতা তদ্রূপ সেচ, নৌ চলাচল ও মৎস্যসম্পদে বিরূপ প্রভাব ফেলিয়া থাকে। স্বীকার্য, তিস্তার ন্যায় পার্বত্য নদীতে মৌসুমভেদে প্রবাহের তারতম্য স্বাভাবিক। কিন্তু নদীটিতে এইরূপ বৈপরীত্যের প্রধান কারণ যতখানি না প্রাকৃতিক, তাহার তুলনায় অধিকতর মনুষ্যসৃষ্ট। কারণ, তিস্তার উজানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে যদ্রূপ গজলডোবা নামক এলাকায় একটি ব্যারাজ তথা পানি প্রত্যাহারকারী স্থাপনা রহিয়াছে, তদ্রূপ আরও উজানে সিকিম রাজ্যে স্থাপিত হইয়াছে আক্ষরিক অর্থেই কয়েক ডজন ড্যাম তথা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। উভয় প্রকার স্থাপনার ক্ষেত্রেই ভাটির দেশ বাংলাদেশের ভাগ্যে পানিশূন্যতা ব্যতীত আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। বাংলাদেশের নীলফামারীর ডালিয়া নামক এলাকায় যদিও অপর একটি ব্যারাজ রহিয়াছে; উজানে পানি প্রত্যাহার ও চক্রায়নের ফাঁদে পড়িয়া উহার সচলতা নামমাত্র। এহেন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদনের প্রচেষ্টা চালাইয়া আসিয়াছে। কিন্তু ২০১১ সাল হইতে উহাও রহিয়াছে ত্রিশঙ্কু অবস্থায়। ভারতীয় পক্ষ হইতে তিস্তা বাহিয়া বৎসর বৎসর কেবল প্রতিশ্রুতিই গড়াইয়াছে; পানি নহে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমরা মনে করিয়াছি, বর্ষার বিপুল প্রবাহ ধারণ করিবার জন্য জলাধার এবং শুষ্ক মৌসুমে স্বল্পপ্রবাহ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নাব্য রক্ষাই হইতে পারে সমাধান। আলোচিত তিস্তা মহাপরিকল্পনাতে এইরূপ সমাধানই নির্দেশ করা হইয়াছিল। অত্র সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা ইহাও একাধিকবার স্মরণ করাইয়া দিয়াছি– কেবল একপক্ষীয় ব্যবস্থাপনায় তিস্তা সংকটের সমাধান সম্ভব নহে। ভাটিতে ‘ব্যবস্থাপনা’ নিশ্চিত করিতে হইলে উজানে ‘প্রাপ্যতা’ নিশ্চিতকরণের বিকল্প নাই। যেই কারণে চীনের প্রযোজনায় যখন মহাপরিকল্পনা গ্রহণের তোড়জোড় চলিতেছিল, তখন আমরা বলিয়াছিলাম, দ্বিপক্ষীয় নহে, প্রকল্পটি হইতে হইবে বহুপক্ষীয়। সেই ক্ষেত্রে চীনের সহিত ভারত তো বটেই, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ন্যায় আন্তর্জাতিক অর্থকরী প্রতিষ্ঠানগুলিকেও সম্পৃক্ত হইতে হইবে। আর প্রকল্পের পূর্বেই অববাহিকার দেশগুলি তথা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পানি বণ্টন চুক্তির মাধ্যমে অববাহিকাভিত্তিক অধিকার নিশ্চিত করিতে হইবে। অন্যথায় প্রকল্প হইলেও সুফল অনিশ্চিত থাকিয়া যাইবার আশঙ্কা ষোলআনা থাকিয়া যাইবে।

বর্তমানে চীনের সহিত মিলিয়া নূতন করিয়া তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও আমরা পুরাতন সতর্কতা উচ্চারণ করিতে চাহি; প্রকল্পটি বহুপক্ষীয় হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যাহাতে চীন, ভারতের সহিত বিশ্বব্যাংক ও এডিবি যুক্ত হইবার মধ্য দিয়া বাস্তবায়িত প্রকল্পের সুফল পাইবার মাধ্যমে রংপুরবাসীর উৎসাহ সার্থক হইয়া উঠে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রকল প র সহ ত উৎস হ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

জীবনের অপচয় রোধ জরুরি

দেশে পানিতে ডুবিয়া শিশুর প্রাণহানির যেই চিত্র শনিবার সমকালের এক প্রতিবেদনে উঠিয়া আসিয়াছে, উহা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। ঈদুল আজহার ছুটি আরম্ভ হইবার পূর্বের ১০ দিবসেই বিভিন্ন স্থানে ১৫ জন পানিতে ডুবিয়া প্রাণ হারাইয়াছে, যাহাদের মধ্যে ১৩ জন ছিল শিশু। উপরন্তু, ঈদুল ফিতরের পূর্বাপর ১২ ছুটিতে মোট ৪৯ জন অনুরূপভাবে প্রাণ হারাইয়াছে, যথায় শিশুর সংখ্যা ৪৭। এদিকে ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ঈদুল ফিতরে ৫৮ জন ও ঈদুল আজহায় ৬৫ শিশু পানিতে ডুবিয়া প্রাণ হারাইয়াছিল। এই ধারণা অমূলক নহে যে ঈদের ছুটিতে শহরবাসী অনেকে ছুটিয়া যায় গ্রামাঞ্চলে, যেইখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ শিশুদের আকৃষ্ট করিয়া থাকে। তাহারা পানির আশপাশে খেলার বিপদ সম্পর্কে সচেতন থাকে না, জানে না খাল-বিল, ডোবা-পুকুর কতটা বিপজ্জনক পরিণতি ডাকিয়া আনিতে পারে। গ্রামের বিস্তৃত ও অপেক্ষাকৃত নির্জন পরিবেশে শিশুদের তদারকির অভাবও প্রকট। অভিভাবকগণ সাধারণত গৃহকর্মে ব্যস্ত থাকেন, তেমন নজর থাকে না শিশুর গতিবিধির উপর। এই সকল কিছু মিলাইয়া সংশ্লিষ্ট শিশুর জন্য সৃষ্টি হয় মৃত্যুফাঁদ। দুর্ভাগ্যজনক হইল, এই সকল বিয়োগান্তক ঘটনার কারণে গ্রামের মুক্ত পরিবেশে অনেক পরিবারে ছুটির উচ্ছ্বাস নিমেষে মাটি হইয়া যাইবার পরও জনচেতনতা পরিলক্ষিত হইতেছে না। ফলস্বরূপ, এহেন হৃদয়বিদারক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়াই চলিয়াছে।

প্রতিটি শিশুর প্রাণই মূল্যবান। একটি জীবন অকালে ঝরিয়া যাইবার অর্থ একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু, একটি ভবিষ্যতের হারাইয়া যাওয়া। এই ক্ষতি শুধু সংশ্লিষ্ট পরিবারের নহে, সম্পূর্ণ সমাজের এবং রাষ্ট্রের। অথচ এহেন মৃত্যু রোধে রাষ্ট্রীয়ভাবেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নহে। প্রতিবেদনমতে, ২০১১ সালের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে পানিতে ডুবিয়া শিশুমৃত্যুর ঘটনাকে জনস্বাস্থ্য সমস্যারূপে চিহ্নিত করিবার পর ২০২২ সালে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৮ সহস্র কমিউনিটিবেজড চাইল্ড কেয়ার সেন্টার স্থাপনের ঘোষণা দেয়। উদ্দেশ্য ছিল এক হইতে পাঁচ বৎসর বয়সী শিশুর জন্য নিরাপদ পরিবেশ ও সাঁতার শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি। বাস্তবে কয়েকটি প্রশিক্ষণ ব্যতীত কিছুই হয় নাই। ২০১৫ সালে স্কুল-কলেজে সাঁতার শিখাইবার নির্দেশনা প্রদান করা হইলেও তাহা এখনও উপেক্ষিত। জেলা প্রশাসকদের ভূমিকা নির্ধারিত থাকিলেও বাস্তবায়নের চিত্র প্রায় শূন্য। এই অবস্থায় দ্য সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এবং আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় ধরা পড়িয়াছে, দেশে প্রতিবৎসর প্রায় ১৪ সহস্র শিশু পানিতে ডুবিয়া মারা যায়। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৪০টি শিশু প্রাণ হারায়। তাদের ৭৫ শতাংশের বয়স পাঁচ বৎসরের নিচে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে পানিতে ডুবিয়া প্রতিবৎসর আহত হয় অন্তত এক লক্ষ শিশু। ইহাদের মধ্যে প্রায় ১৩ সহস্র পঙ্গু হইয়া যায়। পরিণামে ঐ শিশুরা পরিবারের পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজের বোঝা হইয়া দাঁড়ায়।

বিশেষজ্ঞগণ বলিয়াছেন, দেশে অপঘাতজনিত শিশুমৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ পানিতে ডুবিয়া যাওয়া। এমনকি নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় যত শিশু মৃত্যুবরণ করে, ততোধিক শিশু মারা যায় পানিতে ডুবিয়া। এতদসত্ত্বেও এই প্রাণহানি লইয়া কোনো তথ্যপ্রবাহ ব্যবস্থা নাই, অতএব সরকারি কোনো তথ্যভান্ডারও গড়িয়া উঠে নাই। অথচ ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে তথ্যাদি নথিভুক্তি শুরু হইলে বৎসরান্তে ইহার অন্তত হিসাব মিলিত। বিলম্বে হইলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বোধোদয় ঘটুক, ইহাই আমাদের প্রত্যাশা। এই বিষয়ে প্রয়োজনে ইউনিসেফের ন্যায় সংস্থাসমূহকেও কাজে লাগানো যায় বলিয়া আমরা মনে করি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জীবনের অপচয় রোধ জরুরি