চারঘাট উপজেলার শলুয়া-বালুদিয়াড় বিল। দেড় যুগ আগে সেচ সংকট মেটাতে এ বিলে গভীর নলকূপ স্থাপন করে বিএমডিএ। তখন এর নলকূপের আশপাশে কোনো পুকুর ছিল না। গত এক যুগে এর চারপাশের অন্তত ৮০ ভাগ জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে। ফলে চলতি বছর নলকূপের আওতায় ১৪ বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদ হচ্ছে। অথচ প্রায় ১১৫ বিঘা জমির পুকুরে হয়েছে মাছ চাষ।
সদর ইউনিয়নের চৌধুরীর বিলেও দেড় যুগ আগে স্থাপন করা হয় গভীর নলকূপ। তখন মাত্র দুটি পুকুর ছিল। এখন এর আওতায় থাকা জমির ৯৫ শতাংশ জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে। চলতি বছর এ নলকূপের আওতায় বোরো ধান চাষ হয়েছে মাত্র পাঁচ বিঘা জমিতে। আশপাশের প্রায় শত বিঘা জমিতে হচ্ছে মাছ চাষ। শুধু শলুয়া কিংবা চৌধুরীর বিল নয়, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) ৬৪টি গভীর নলকূপের আশপাশের ফসলি জমিতে হাজারো পুকুর খনন হয়েছে।
ফসলে সেচের জন্য ভর্তুকি (রিবেট) সুবিধা নিয়ে বসানো গভীর নলকূপের পানি এভাবে কম খরচে মৎস্য খামারে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে কৃষকরা পানি না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। লোকসানে পড়ে ফসলি জমি মৎস্যচাষিদের কাছে ইজারা দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। চৌধুরীর বিলের কৃষক রেজাউল করিম বলেন, এক যুগ আগেও পুরো বিলে বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ হতো। এখন সব মৎস্য খামার হয়ে গেছে। গভীর নলকূপের পানিতে এসব খামার টিকে আছে। কৃষিজমিতে পানি চাইলে সামান্য পানির জন্য নলকূপ চালু করতে চায় না। যারা এখনও ফসল আবাদ করছেন, তারা শ্যালো মেশিনের পানিতে সেচকাজ চালাচ্ছেন।
মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানা যায়, উপজেলায় এখন পুকুর আছে ৩ হাজার ৪০২টি। অর্ধযুগ আগে ছিল ২ হাজার ৭৬২টি। আর এক যুগ আগে ছিল ১ হাজার ৯৩০টি। সে হিসাবে অর্ধযুগের ব্যবধানে ৬৪০টি এবং এক যুগে ১ হাজার ৪৭২টি নতুন পুকুর হয়েছে। এর অধিকাংশই খনন হয়েছে গভীর নলকূপ আছে, এমন বিল এলাকায়।
বিএমডিএর স্থাপন করা শলুয়া, ভাটপাড়া, নিমপাড়া ও চৌধুরীর বিল নলকূপ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশের আশপাশে চাষযোগ্য কৃষিজমি নেই, বেশির ভাগ কৃষিজমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে। নতুন করে খননের কাজ চলছে। সেচকাজে নলকূপ না চললেও পুকুরগুলোতে এর পানি যাচ্ছে। কৃষিজমিতে সেচ দেওয়া হচ্ছে শ্যালো মেশিন দিয়ে। অনেক স্থানে বিএমডিএর পানির সংযোগ লাইন পুকুরের মাঝে চলে গেছে।
কৃষকরা বলছেন, মৎস্য খামার ক্ষুদ্র শিল্পের মধ্যে পড়ায় সেখানে পানি সরবরাহের কাজে বিদ্যুতের খরচ বেশি। গভীর নলকূপে ব্যবহৃত বিদ্যুতে সরকারের রিবেট সুবিধা থাকায় অর্ধেক খরচে পানি পাওয়া যায়। কৃষকদের প্রলোভন দেখিয়ে মাছ ব্যবসায়ীরা আশপাশের জমি লিজ নিয়ে পুকুর খনন করে খামার করেছেন। এতে জলাবদ্ধতার পাশাপাশি শ্রেণি পরিবর্তন হওয়ায় ফসল উৎপাদন কমছে।
ভাটপাড়া এলাকার মাছচাষি আব্দুল কাদের বলেন, শুষ্ক মৌসুমে কোনো পুকুরেই পানি থাকে না। বেশি দামে বিদ্যুৎ দিয়ে পানি তুলে মাছ চাষ করা কঠিন। সেজন্য তারা লাভবান হতে গভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করছেন। নলকূপ অপারেটর আকরাম হোসেনের কথা, চৌধুরীর বিলে এখন সবই পুকুর হয়ে গেছে। সামান্য কয়েক বিঘা আবাদি জমি আছে। কৃষকরা ক্ষেতে ২০-৩০ মিনিট পানি দেয়। এজন্য সব সময় নলকূপ চালু রাখা সম্ভব হয় না।
নাটোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর তথ্য অনুযায়ী, নলকূপগুলোয় ভর্তুকি থাকায় প্রতি ইউনিটে খরচ হয় ৪ টাকা ৮২ পয়সা। মৎস্য খামার ক্ষুদ্র শিল্পের আওতায় পড়ায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৯ টাকা ৮৮ পয়সা। এ খরচ সেচকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দামের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। সমিতির চারঘাট জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার রঞ্জন কুমার সরকার বলেন, মাছ চাষে রিবেট সুবিধা নেই। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
শলুয়া-বালুদিয়াড় বিলে গভীর নলকূপের পাশে পেঁয়াজের ক্ষেতে শ্যালো মেশিন দিয়ে সেচ দিচ্ছিলেন সবুর আলী। তিনি বলেন, সারারাত গভীর নলকূপ চালিয়ে মৎস্য খামারে পানি দেওয়া হয়। দিনে এক-দেড় ঘণ্টার জন্য নলকূপ চালু করতে চান না অপারেটর। বাধ্য হয়ে পাইপ দিয়ে শ্যালো মেশিনের পানি দিতে হয়। এতে খরচ বাড়ছে। সরকার ভর্তুকি দিলেও কৃষকের লাভ হচ্ছে না।
বিএমডিএ অপারেটর রবিউল ইসলাম নিজেই নলকূপের পাশের প্রায় ১৮ বিঘা জমিতে মৎস্য খামার গড়েছেন। তাঁর ভাষ্য, আগে এ মাঠে বোরো ধানের আবাদ হতো বেশি। এখন সবাই মাছ চাষ করছে বলে তিনিও এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। তাঁর নলকূপের আওতায় ১৪ থেকে ১৬ বিঘা জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। কৃষকের জমিতে পানি না দেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন তিনি।
স্থানীয় কৃষকের ফসল আবাদে অন্যতম সমস্যা পানি উল্লেখ করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন হাসান বলেন, কৃষকের ভর্তুকির পানিতে মাছ চাষ হচ্ছে। কৃষক বিকল্প উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করায় খরচ বাড়ছে। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চারঘাট জোনের সহকারী প্রকৌশলী মো.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: মৎস য খ ম র নলক প চ ল প র আওত য় ব এমড এ এক য গ আশপ শ ব যবহ
এছাড়াও পড়ুন:
গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় গত চার দিনে ১২ শিশুর জামিন নামঞ্জুর
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পথসভাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ১৮ জন শিশু রয়েছে। এর মধ্যে গত চার দিনে ১২ শিশুর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন আদালত।
গতকাল বৃহস্পতিবার সাত শিশুর জামিন আবেদনের শুনানি হয়। গোপালগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) সৈয়দ আরাফাত হোসেন তাদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। এর আগে সোম ও মঙ্গলবার পাঁচ শিশুর জামিন আবেদন করা হয়। তাদের জামিন নামঞ্জুর করা হয়। ওই পাঁচজনের জামিন আবেদন করা হয়েছিল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।
কারাগার সূত্র জানায়, গত ১৬ জুলাই সংঘর্ষের পর ১৭ ও ১৮ জুলাই জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ১৮ শিশুকে আটক করে পুলিশ। ১৮ জুলাই তাদের আদালতে হাজির করে গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। পরে ২১ জুলাই তাদের যশোরের পুলেরহাট শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
আদালতের নথি অনুযায়ী, গ্রেপ্তার হওয়া শিশুদের বয়স, ঠিকানা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ নেই। তবে গতকাল পর্যন্ত ১২ শিশুর নাম ও পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে চার পরিবারের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। অভিভাবকদের অভিযোগ, তাদের সন্তানদের কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই আটক করা হয়েছে।
আরও পড়ুনগ্রেপ্তার হওয়া শিশুদের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ২৭ জুলাই ২০২৫একজন শিশুর বাবা বলেন, ‘সংসারে অভাব–অনটন, নিজেরাই সংসার চালাইতে পারি না। আমার কষ্ট দেখে ছেলে রাজমিস্ত্রির কাজে যোগ দেয়। সে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার রমজান শেখ নামের একটা রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে। কাজের সময় পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়।’
আরেক শিশুর ভ্যানচালক বাবা বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, কোথাও কোনো কাইজের মধ্যে নেই। তিনডা ছেলে, বড়টা একটা মাদ্রাসার শিক্ষক। ছোট দুইডা এখনো পড়ে। যারে ধরছে, সে সবার ছোট। ওই দিন সকালে আমার মাদ্রাসায় গেছে, পরীক্ষা ছিল। পরে দুপুরের আগে আমি নিজে যাইয়ে নিয়ে আসছি। সেদিন বাড়িতেই ছিল। পরের দিনও সারা দিন বাড়ি ছিল, সেদিন তো কারফিউ ছিল। আসরের নামাজের পর আমার কাছ থেকে ২০ টাকা নিয়ে গেছে চটপটি খাইতে। পাশে মাদ্রাসার সামনেই চটপটির দোকান বসে। সেই হান দে ওরে ধইরে নিছে।’
ওই ব্যক্তি আরও বলেন, ‘ধরার ঘণ্টাখানেক পর থানা থেইকা ফোন দিছে, কয় ছেলে ধরা হইছে। আমরা থানায় গিয়া অনেক কইছি, ও তো কোথাও যায় না, কোনো গ্যাঞ্জামের ছেলে না। মাদ্রাসায় পড়ে। কিন্তু কেউ কিছুই শুনল না। ছেলেরে ছাড়ায় আনতে অনেক জায়গায় দৌড়াইছি।’ তিনি জানান, এ ঘটনার পর থেকে তাঁদের প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
এ ছাড়া জামিনের আশ্বাস দিয়ে কয়েকজন লোক তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন একজন অভিভাবক।
আরও পড়ুনগোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলার ঘটনায় আরও একটি মামলা, আসামি ৪৭৭ জন৩১ জুলাই ২০২৫গ্রেপ্তার এক শিশুর আইনজীবী ফিরোজা বেগম বলেন, ১৬ জুলাই সহিংসতার ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় এই শিশুকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ ধারায় দ্রুত তদন্ত করে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে সরকারি কৌঁসুলি তৌফিকুল ইসলাম বলেন, শিশুরা অল্প সময় আগে গ্রেপ্তার হয়েছে, এখনো তদন্ত চলছে। তাই হয়তো বিচারক জামিন নামঞ্জুর করেছেন। এ মামলায় এখনো কারও জামিন হয়নি।
আরও পড়ুনগোপালগঞ্জে সংঘাতের ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট, নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন ১৮ জুলাই ২০২৫