অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের প্রতিষ্ঠাকালীন সিনেটর এবং বর্তমানে পরিচালক। প্রায় ১৫ বছর ধরে তিস্তাসহ দেশের সব নদী নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন। নদী বিষয়ে নিয়মিত কলাম লিখছেন ১৫ বছর ধরে। নদীবিষয়ক তাঁর দুটি বই ‘নদী সুরক্ষায় দায়িত্বশীলতা’, ‘রংপুর অঞ্চলের নদনদী’। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনে কয়েকটি নদী অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক মাহফুজুর রহমান মানিক।

সমকাল: সম্প্রতি আপনি লিখেছেন, ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনার নামে ছেলে ভোলানোর গল্প আর কত দিন?’ এর পর সেখানে সরকারের দু’জন উপদেষ্টা সফর করে এ ব্যাপারে যে আশ্বাস দিয়েছেন, তাতে কতটা আশাবাদী হওয়া যায়?

তুহিন ওয়াদুদ: দেখুন, তিস্তা নিয়ে যে কোনো প্রতিশ্রুতির ওপর তিস্তাপারের মানুষের তেমন আস্থা নেই। আমরা যখন তিস্তাপারে মানুষের দুঃখ-কষ্টের আলাপ করতে যাই, তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন– ‘তিস্তা নদীর কাম কি হইবে বাহে? মনে হয় হবার নয়।’ সে কারণে আমি লিখেছি– ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনার নামে ছেলে ভোলানোর গল্প আর কত দিন?’ অন্তর্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তিস্তাপারের গণশুনানি সমাবেশে এসেছিলেন। ওই দিন একজন কৃষক দুই উপদেষ্টার উদ্দেশে বলেন– ‘এবার হামাক ঠকান না বাহে!’ এ কথাটি বেশ সাড়া ফেলেছে। এটিই তিস্তাপারের মানুষের মনের কথা। ফলে দু’জন উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট কার্যপরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি দিলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিনে তৈরি হওয়া অবিশ্বাস আর অনাস্থা দূর হয়নি। তবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ভাঙন বন্ধে কাজ শুরুর নির্দেশ জারি করার কথা বলেছেন।

সমকাল: তিস্তা মহাপরিকল্পনা এতদিন ঝুলে থাকার কারণ কী বলে মনে হয় আপনার?

তুহিন ওয়াদুদ: তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়ার দুটি প্রধান কারণ– প্রথমত, সদিচ্ছার অভাব। দ্বিতীয়ত, রংপুর অঞ্চলের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সারাদেশে ৩ লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প যখন হাতে নিয়েছিল, তখন রংপুর বিভাগের জন্য কোনো মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেনি। তিস্তা মহাপরিকল্পনা হতে পারত এ অঞ্চলের মেগা প্রকল্প। তিস্তা নদীতে প্রতিবছর ভাঙন ও বন্যার ক্ষতি অর্থমূল্যে পরিমাপ করা অসম্ভব। তারপরও বছরে আর্থিক ক্ষতি প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। অথচ তিন বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করলে বছরে ৩ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট ৯ হাজার কোটি টাকায় তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো। মাত্র ৯ হাজার কোটি টাকা যে লাখ লাখ কোটি টাকার সুরক্ষা দিতে পারত, এটি সরকার একবারও ভাবার প্রয়োজন মনে করেনি। ৩ লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পে দেশের যে আর্থিক লাভ হবে, এক তিস্তা মহাপরিকল্পনায় তার চেয়ে বেশি আর্থিক লাভ করা সম্ভব। আসলে কোনো সময়ই কোনো সরকার রংপুর অঞ্চলের সমস্যা দূরীকরণে সদিচ্ছা পোষণ করেনি।

সমকাল: ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি না থাকায় উত্তরাঞ্চল মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। বর্ষায়ও সংকট তৈরি হচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা ভারতের সঙ্গে করতে চাইলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা কীভাবে দেখেন?

তুহিন ওয়াদুদ: ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারে নেতিবাচক প্রভাব কেবল শুষ্ক মৌসুমে নয়, বর্ষা মৌসুমেও পড়ছে। এটি যথার্থই বলেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার আন্তরিকভাবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা করতে চেয়েছে– এটি কখনোই মনে হয়নি। ভারতও ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশন লঙ্ঘন করে একতরফা তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে গেছে। এটি মানবতারও লঙ্ঘন। শুধু নদীর প্রশ্নে নয়; তিস্তার পানি প্রত্যাহার করার কারণে বাংলাদেশ পরিবেশ-প্রতিবেশসহ আর্থিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের এত বড় ক্ষতি ভারত করতে পারে না।

সমকাল: ২০১১ সালে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। এখন পর্যন্ত হচ্ছে না কেন?

তুহিন ওয়াদুদ: তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ভারতও যেমন করতে চায়নি, তেমনি বাংলাদেশের পক্ষেও জোরালোভাবে এ দাবি উত্থাপন করা হয়নি। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমার্ধে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল। সে সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন। একই সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও আসার কথা ছিল। মনমোহন সিং বললেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না আসায় তিস্তা চুক্তি হলো না। এটি আসলে চুক্তি না করার অভিনব কৌশল। ভারতের প্রধানমন্ত্রীও তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি চাননি। এর একটি প্রমাণ উল্লেখ করা যায়, যে বছর তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি হয়নি, ঠিক সেই বছরে কেন্দ্রীয় সরকারপ্রধান মনমোহন সিং পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে তাদের তিস্তায় সেচ প্রকল্পের আওতা বৃদ্ধির জন্য প্রচুর টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। এতে বোঝা যায়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাদের তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতা বৃদ্ধি করতে আগ্রহী, চুক্তি করতে নয়। পশ্চিমবঙ্গ এবং কেন্দ্রের মধ্যে সাজানো খেলার অংশ হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বাংলাদেশে আসেননি।

সমকাল: তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর ক্ষেত্রে ভারতের অন্যায্য ভূমিকায় বাংলাদেশের করণীয় কী?

তুহিন ওয়াদুদ: নদী প্রসঙ্গে ভারতের অন্যায্য ভূমিকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের শক্ত ও সরব অবস্থান গ্রহণ জরুরি। শুধু তিস্তা নয়; ভারত আরও অনেক নদীতে অশুভ দৃষ্টি ফেলেছে। বাংলাদেশে যে ধরলা নদী, ভারতে এর নাম জলঢাকা। ভারত এ নদীর পানি খাল খনন করে তিস্তায় নেওয়ার কাজ শুরু করেছে। ভারত ধরলা নদীর পানি প্রত্যাহার শুরু করলে তিস্তা ও ধরলার মধ্যবর্তী সানিয়াজান, রত্নাই, সিংগিমারীসহ কয়েকটি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি হারাবে বাংলাদেশ। ফলে সব আন্তঃসীমান্ত নদীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের করণীয় ঠিক করতে হবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী আছে, বলা হয়। এটি ঠিক নয়। রিভারাইন পিপল থেকে গবেষণায় আমরা দেখিয়েছি, বাংলাদেশ-ভারত আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা অন্তত ১২৩। এগুলো চিহ্নিত করে যৌথ নদী রক্ষা কমিশন থেকে স্বীকৃত হতে হবে। একই সময়ে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার বিষয়ে আপত্তি জানাতে হবে। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে প্রতিকার চাওয়া ও আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হবে। এতে ভারতের পানিবিষয়ক আগ্রাসন দুনিয়াবাসী জানবে। সামাজিক একটি চাপ সৃষ্টি হবে। বিশ্ববাসীর কাছে ভারতের পানিশোষক চরিত্র ব্যাপকভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন।

সমকাল: ভারতের এক ধরনের অসহযোগিতায় অন্তর্বর্তী সরকার চীনের সঙ্গে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে যেভাবে এগোচ্ছে, তা আপনি কীভাবে দেখছেন? 

তুহিন ওয়াদুদ: দেখুন, দীর্ঘদিন তিস্তা নদীর সংকট দূরীকরণে আন্দোলন করে আসছি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এতটাই উচ্চ-নিম্ন পর্যায়ের ছিল যে, বাংলাদেশ কখনও ভারতের পানি শোষণ প্রশ্নে ‘টুঁ’ শব্দটি করেনি। ২০১৪ সাল থেকে একতরফা পানি প্রত্যাহার শুরু করে ভারত। ওই বছর তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকায় পানির অভাবে জমি ফেটে চৌচির হয়েছিল। কৃষকের কান্নায় জনপদের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল। প্রায় প্রতিবছর ভারত হঠাৎ গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট অসময়ে খুলে দেয়। তখন বাংলাদেশ অংশে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কখনও তার প্রতিবাদ জানায়নি বাংলাদেশ। ভারত এতটাই নির্মম যে, পানি ছাড়ার সময়ে বলার ন্যূনতম প্রয়োজন মনে করে না। ফলে ভারতের কাছে সহযোগিতা আশা করা কঠিন। ভারত যদি সহযোগিতা না করে তাহলে বাংলাদেশের তো বসে থাকার সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে চীনের কাছে একমাত্র সহযোগিতা নিতে হবে, এমনটাও মনে করার কারণ নেই। অন্তর্বর্তী সরকার যদি ভারত-চীন ভিন্ন অন্য কোথাও থেকে সমাধান খুঁজত, তাহলে বেশি ভালো হতো। ভারতের অসহযোগিতায় চীনকে একমাত্র ভরসা হিসেবে দেখলে তারও পরিণতি খারাপ হতে পারে।

সমকাল: তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে বহুপক্ষীয় সমাধানের কথা যে উঠছে, তা কতটা যুক্তিসংগত বলে আপনি মনে করেন?

তুহিন ওয়াদুদ: বহুপক্ষীয় সমাধানের যে ধারণা হাজির করা হয়েছে, তা সম্ভব হলে সবচেয়ে ভালো হতো। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যে ধরন, তাতে বহুপক্ষীয়দের মধ্যে সমন্বয় করাই কঠিন। সমন্বয়ের চিন্তার বাইরে চীন, ভারত উভয় দেশকে বাদ দিয়ে অন্য ব্যবস্থা করা গেলেও ভালো। বাংলাদেশ যদি নিজস্ব অর্থায়নে কাজ শুরু করে, সেটি উত্তম। তবে জানিয়ে রাখি, যেহেতু তিস্তা বাংলাদেশ-ভারত মিলে আন্তঃসীমান্ত নদী, তাই প্রধানত এ দু্ই দেশসহ বহুপক্ষীয় সমাধান করলে তা বেশি ফলপ্রসূ হবে।

সমকাল: আপনারা রিভারাইন পিপলের মাধ্যমে ২০১০ সাল থেকে তিস্তা সুরক্ষার যে আন্দোলন করছেন, আপনাদের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব আছে?

তুহিন ওয়াদুদ: ২০১০ সাল থেকে আমরা বলে আসছি, জীবনরেখা নামে পরিচিত উত্তরের আশীর্বাদ তিস্তা নদী বর্তমানে অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এ নদীকে আবারও আশীর্বাদে পরিণত করতে হবে। এ জন্য নিজ দেশীয় এবং দ্বিদেশীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নায্য হিস্যার ভিত্তিতে পানি পেতে হবে, আবার নিজ দেশীয় পরিচর্যাও অব্যাহত রাখতে হবে। তিস্তা নদী তথা কৃষি, কৃষক, জীববৈচিত্র্য সর্বোপরি পরিবেশ-প্রকৃতি সুরক্ষা সাপেক্ষে এর পরিচর্যা জরুরি। তিস্তার শাখা এবং উপনদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত খনন করতে হবে। আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশন অনুযায়ী উজানের দেশের কারণে ভাটির দেশে কোনো ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে সেই ক্ষতিপূরণ চাওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের উজানে যেসব জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোতেও আমাদের অধিকার আছে– এ কথাও ভারতকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। 
তিস্তা নদী ঘিরে যতদিন মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু না হবে ততদিন এর দুই পারে যেসব ভাঙনদুর্গত এলাকা রয়েছে, সেখানে ভাঙনরোধী কাজ করতে হবে। ২০১১ সালে যখন তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছিল, তখন আমরা তিস্তা ব্যারাজ-সংলগ্ন নদীতে নৌ মিছিল করেছিলাম। তখনও আমাদের দাবি ছিল তিস্তা নদীর জন্য প্রাকৃতিক প্রবাহ সচল রাখতে ২০ শতাংশ পানি রেখে বাংলাদেশ ৪০ শতাংশ এবং ভারত ৪০ শতাংশ পাবে। তিস্তা নিয়ে রিভারাইন পিপলের দাবি– বিজ্ঞানসম্মতভাবে নদীবান্ধব-জনবান্ধব-দেশবান্ধব পরিচর্যামূলক প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

সমকাল: তিস্তার ভাঙন প্রতিরোধে আপনাদের যে দাবি, মহাপরিকল্পনা ছাড়া অ্যাডহক ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে কি এর সমাধান সম্ভব?

তুহিন ওয়াদুদ: ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ নামে হোক কিংবা অন্য যে কোনো নামে; একটি সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা জরুরি। এ ছাড়া শুধু তিস্তার ভাঙন রোধে কাজ করতে হবে। এই ভাঙন রোধের কাজ সাময়িক সমাধান। সে জন্য স্থায়ী সমাধানে কাজ শুরু করতে হবে। কেবল অ্যাডহক ভিত্তিতে প্রকল্পে সমাধান হবে না।

সমকাল: ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’-এর ব্যানারে ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি দুই দিনব্যাপী বৃহৎ কর্মসূচির কথা আমরা জানি। এর মূল বার্তা কী?

তুহিন ওয়াদুদ: তিস্তা আন্দোলন নিয়ে অনেক সংগঠন গড়ে উঠেছে। সর্বশেষ ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’ কাজ করছে। বিএনপি নেতা আসাদুল হাবীব দুলু এ আন্দোলনের উদ্যোক্তা এবং প্রধান সমন্বয়ক। তাঁর এই আন্দোলনও নদীপারে বেশ সাড়া ফেলেছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রথম সারির সব নেতাই আসছেন। কেউ অনলাইনে বক্তব্য দিচ্ছেন। এর ভেতর দিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাও সৃষ্টি হচ্ছে। নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলনের নেতারাও আসছেন। এ আন্দোলনেরও উদ্দেশ্য তিস্তা সুরক্ষা তথা তিস্তাপারের মানুষের জীবনের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করা। একই সঙ্গে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করা। তিস্তা নদীর ভাঙন রোধে এবং পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে এটি অনন্য আন্দোলন হিসেবে থাকবে। 

তুহিন ওয়াদুদ: তিস্তাপারের মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের কেমন দুর্দশা দেখেছেন?

সমকাল: এ প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দেওয়ার মতো ভাষা আমার জানা নেই। তিস্তা নদীর ভাঙনে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়। অঢেল সম্পত্তির মালিক ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন। কয়েক দিন আগে এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হলো, যাঁর অনেক বড় বাড়ি ছিল। তিনি এখন অন্যের বাড়িতে আশ্রিত। একটি ঘরে ছেলে-ছেলেবউসহ থাকতে হচ্ছে। রাতে মাঝখানে একটি কাপড় আড়াআড়ি টেনে পার্টিশন দেওয়া। একটি ঘরেই রান্না এবং থাকা। একেকজনের বাড়ি ১৫ বার পর্যন্ত ভাঙার রেকর্ড আছে। এসব দেখলে, শুনলে মন যে পরিমাণ খারাপ হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এতটাই দুর্দশা ভাঙনকবলিত মানুষের। সম্প্রতি আমি বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটার নৌপথে সরেজমিন দেখে এসেছি। কয়েক দিনের মধ্যে ভাঙন বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এ বছরও হাজার হাজার বাড়ি নদীতে বিলীন হবে।

সমকাল: রংপুরের অন্যান্য নদী নিয়েও আপনার কাজ আছে। সেসব নদীর অবস্থা কেমন দেখছেন? সেগুলোর সংকট কি তিস্তা সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে?

তুহিন ওয়াদুদ: রংপুর অঞ্চলের একটি নদীও নেই, যাকে স্বাস্থ্যকর বলা যায়। এ অঞ্চলের সব নদী যে তিস্তার সংকট বাড়িয়ে তুলেছে, তা নয়। তবে প্রায় ১৫টি শাখা-প্রশাখা-উপশাখাকে তিস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তিস্তা নদীর সংকট বৃদ্ধি পেয়েছে। এই নদীগুলোর সঙ্গে তিস্তার সংযোগ আগের মতো করতে হবে।

সমকাল: অন্তর্বর্তী সরকারের তিস্তা মহাপরিকল্পনার ভবিষ্যৎ কী?

তুহিন ওয়াদুদ: অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। আর যদি ছয় মাসও দায়িত্বে থাকে, এতেই তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু করা সম্ভব। সে জন্য জোর তাগিদ অনুভব করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এটি শুরু করে, তবে তা ঐতিহাসিক কাজ হবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সরকার যা পারেনি, অন্তর্বর্তী সরকার তা করে দেখাতে পারে। উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে মহাপরিকল্পনার কাজ চূড়ান্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো কাজ থাকতে পারে না। তিস্তার ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল দুই কোটি মানুষ তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছে তিস্তা সংকট দূর হওয়ার আশায়। তারা চায় তিস্তা নদীর স্থায়ী সমাধানের কার্যক্রম শুরু হোক।

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

তুহিন ওয়াদুদ: সমকালকেও ধন্যবাদ।
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: উপদ ষ ট প রকল প সরক র র ব যবস থ আর থ ক র জন য ক জ কর র করণ সমক ল হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

সাকিবের সঙ্গে দেখা হলে অবশ্যই বিষয়টি জানতে চাইব

জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালকে সম্প্রতি বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দেখা গেছে। অনেকে মনে করছেন, রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন বাঁহাতি এই ওপেনার। ক্রিকেটে নিজের সেকাল-একাল, রাজনীতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, বিসিবিতে যুক্ত হওয়ার গুঞ্জনসহ নানা বিষয়ে সমকালের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন তামিম ইকবাল। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সেকান্দার আলী। 

সমকাল : সম্প্রতি চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি তারুণ্য উৎসব মঞ্চে আপনাকে দেখা গেছে। এর পর অনেকে ভাবছেন, আপনি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। আসলে কী?

তামিম ইকবাল : আমার একদমই রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা নেই। তাই বলে আমি রাজনীতিকে খারাপভাবে দেখি না। একজন সংগঠক বা ক্রিকেটারকে যেমন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষ হতে হয়, তেমনি একজন রাজনীতিবিদকেও রাজনীতিতে প্রজ্ঞাবান হতে হয়। আমার রাজনীতিতে আসার সুযোগ ছিল, কিন্তু সম্পৃক্ত হওয়ার তাগিদ বোধ করিনি। আমার ওই রাজনৈতিক যোগ্যতা নেই। হ্যাঁ, চট্টগ্রামে বিএনপির তারুণ্য উৎসবে গিয়েছিলাম, তবে রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়। আমাকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে, চট্টগ্রামের স্পোর্টস নিয়ে কথা বলার জন্য। আমি বক্তব্য দেওয়ার শুরুতেই বলেছিলাম, আমি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না। আমার বক্তব্যের পুরোটা জুড়ে তাই ছিল খেলা। ২০ বছর পরে গিয়ে কী হবে, কেউ বলতে পারে না। তবে এ মুহূর্তে রাজনীতি নিয়ে ভাবছি না। 

সমকাল : বিএনপি ঘরানার ক্রীড়া সংগঠকদের অনুষ্ঠানেও আপনাকে দেখা গেছে।

তামিম : ওখানে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের চেয়ে খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সংগঠকরা বেশি ছিলেন। যে কমিটি হয়েছে, দেখবেন সেখানে আমার নাম নেই। ক্লাব ক্রিকেট নিয়ে একটা কমিটি হতে পারে, সেখানে আমি থাকতেও পারি, নাও পারি। 

সমকাল : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্রীড়া সংগঠক হতেও তো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকতে হয়। 

তামিম : আমি আশা করব, এমন একজন রাজনৈতিক নেতা আসবেন, যিনি দেশের স্পোর্টসের স্বার্থে ক্রীড়াবিদদের বেছে নেবেন। স্পোর্টসের উন্নয়নে সঠিক মানুষ খুঁজে বের করবেন। আমি বলব না, আমিই সেই সঠিক মানুষ। তারা যাঁকে সঠিক মনে করবেন, তাঁকে খুঁজে নেবেন। আমি ওটার জন্য অপেক্ষা করব। 

সমকাল : আপনি যে ধরনের নেতার কথা চিন্তা করছেন, অদূর ভবিষ্যতে কি তাঁকে দেখা যাবে?

তামিম : এটি বলা কঠিন। আমি যেহেতু রাজনীতি করি না, তাই সব দলের কথাই বলব। নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের কথা কখনোই বলব না। নির্বাচন হলে কে জিতবে জানি না; তবে ধারণা করতে পারি। আমার কাছে মনে হয়, যারাই আসুক, তারা স্পোর্টসের লোকদের দিয়ে স্পোর্টস পরিচালনা করবেন। 

সমকাল : এত আগে আন্তর্জাতিক খেলা ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার কারণ কী?

তামিম : ২০২৩ সালে আমি যখন অবসরের ঘোষণা দিই তখন অনেক মিডিয়ার ধারণা ছিল, আবেগে ছেড়েছি। আসলে আমি ছয় থেকে আট মাস ধরে সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাকে কোনোরকম সহযোগিতা করা হচ্ছিল না। সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় অবসরের ঘোষণা দিই। হ্যাঁ, যেদিন ঘোষণা দিয়েছি, সেদিন আবেগাপ্লুত ছিলাম। পরিবারের সঙ্গে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। 

সমকাল : তাহলে দলে কি আপনি একা হয়ে গিয়েছিলেন? 

তামিম : আমি সব সময় সবাইকে নিয়ে গল্প করতে পছন্দ করি। আড্ডা দিতে ভালোবাসি। এসব থেকে আমাকে একা করে দেওয়া হলে ভেঙে পড়া স্বাভাবিক। এর থেকে বেশি কিছু বলতে চাই না। 

সমকাল : ২০২৩ সালের বিশ্বকাপের আগে সাকিবের একটি সাক্ষাৎকারে আপনার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ তোলা হয়। সে বিষয়ে কিছু বলবেন?

তামিম : যা কিছু হয়েছে বা বলেছে, তা বলা কতটা উচিত ছিল, তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমার কাছে মনে হয়, জিনিসটা কেউই ভালোভাবে নেয়নি। ওই সময়ে যা কিছু হয়েছে, তা না হলে এখন আমরা আরও ভালো জায়গায় থাকতাম। 

সমকাল : সাকিবের মন্তব্যে কষ্ট পেয়েছিলেন?

তামিম : কষ্ট পাওয়ার চেয়ে বিস্মিত হয়েছিলাম বেশি। সে তার মতামত দিয়েছে। কিছু ভুল তথ্য দিয়েছে। ওখানে সাকিব একটা কথা বলেছে– আমি বেছে বেছে ম্যাচ খেলতে চেয়েছি। এটা সে কোথায় পেয়েছে? ফিজিও বলেননি, নির্বাচকরা বলেননি, আমিও বলিনি। কোনো দিন সাকিবের সঙ্গে দেখা হলে, আমরা আড্ডায় বসলে অবশ্যই বিষয়টি জানতে চাইব তাঁর কাছে। 

সমকাল : গত ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে নিউজ হয়েছে, আপনি সাবেক সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনকে গালি দিয়েছিলেন। এটা কি সত্য?

তামিম : না, না। একদম মিথ্যা কথা। তাঁর সঙ্গে খুবই ক্রুদ্ধ আচরণ করেছি। আমি বেশি আক্রমণাত্মক ছিলাম। তাঁর দিক থেকে কোনো খারাপ কথা বা খারাপ জবাব আসেনি। আমি শতভাগ নিশ্চিত করতে চাই– কোনো বাজে শব্দ বা গালাগাল যাকে বলা হয়, ও রকম কিছু হয়নি। হ্যাঁ, অনেক শক্ত কথা বলেছি। যেভাবে বলেছি, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। হয়তো আরও ভালোভাবে বলতে পারতাম। তবে যা বলেছি, তার জন্য আমি দুঃখিত না। যেভাবে বলেছি, ওটার জন্য দুঃখিত হতে পারি। 

সমকাল : সাকিব-তামিমের সম্পর্কে বিভেদ তৈরি করে রাখা হয়েছিল। বিষয়টা কি এমন?

তামিম : যে মানুষগুলো এখন তাদের পদে নেই, তাদের নিয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না। কোনো দিন মুখোমুখি হলে অবশ্যই বলব। তবে সাকিব আর আমার ঝামেলার কথা মিডিয়া অনেক আগে থেকে জানত। খেলায় প্রভাব না পড়ায় মিডিয়া কিছু লিখেনি। বিসিবি সভাপতি (নাজমুল হাসান পাপন) প্রকাশ্যে বলে দেওয়ার পর থেকে মিডিয়া লেখা শুরু করে। ২০২৩ সালে কেন বিষয়টি সামনে এনে বিভেদ তৈরি করতে হলো? এ প্রশ্নের উত্তর তারা (পাপন) ভালো দিতে পারবেন। 

সমকাল : আপনাদের সম্পর্কের অবনতির কারণ কী ছিল? তারকা খ্যাতি?

তামিম : না। একদমই না। অনেকে বলে, কে কার চেয়ে সেরা। কার এনডোর্সমেন্ট বেশি। এগুলো কিছুই আমাদের সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারেনি। আমি সব সময় বলেছি, বাংলাদেশের স্পোর্টসে সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব। আমি নিজেই যখন এটা বলি, তখন তারকা খ্যাতি সম্পর্কের অবনতির কারণ হতে পারে না। আমার মনে হয় না, সাকিবও কখনও এভাবে চিন্তা করেছে। বন্ধুত্বের মধ্যে দূরত্ব অনেক কারণেই হতে পারে। তবে আমাদের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব ঘোচাতে বিসিবি থেকে কেউ চেষ্টা করেননি। তারা আলাদাভাবে কথা বলেছেন, দু’জনকে একসঙ্গে বসিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেননি।

সমকাল : আপনি নিজে উদ্যোগ নিয়েছেন?

তামিম : অধিনায়ক হিসেবে আমি সম্পর্ক উন্নয়নে চেষ্টা করেছি। কয়েকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু হয়নি। তবে ভবিষ্যতে হবে না, তা মনে করি না। 

সমকাল : আপনার অসুস্থতার সময়ে সাকিব তাঁর ফেসবুক পেজে সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। তাঁর বাবা-মা আপনাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছেন। 

তামিম : আমরা দু’জনই পরিণত। আমাদের দু’জনের প্রতি দু’জনের কিছু রাগ-ক্ষোভ থাকতে পারে। তবে আমরা কখনও সামনাসামনি হলে এবং নিজেরা কথা বলা শুরু করলে সম্পর্কের উন্নতি হতে পারে। 

সমকাল : ভারতে শেষ টেস্ট খেলেছেন সাকিব। ওই সিরিজে আপনি ছিলেন ধারাভাষ্যকার। তখন কি কথা হয়েছে?

তামিম : ওই সফরে ওর শেষ ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল। তবে আমরা নিশ্চিত ছিলাম না, ওটাই ওর শেষ ম্যাচ কিনা। ওটা শেষ ম্যাচ হলে আমি বক্তব্য দিতাম সাকিবের ক্যারিয়ার নিয়ে। আমি ম্যানেজারকে সেভাবে বলে রেখেছিলাম। ওকে যতটা কাছ থেকে আমি দেখেছি বা সে আমাকে যতটা দেখেছে, তা অনেকে দেখেনি। আমার মনে হয়, সবাই ‘ডিজার্ভ’ করে, সাকিব বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য কী করেছে– সেটা আমার মুখ থেকে শোনার। আমি খেলোয়াড় সাকিবকে নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলছি। আমার অন্য কোনো মতামত দেওয়ারও প্রয়োজন নেই, নেওয়ারও প্রয়োজন নেই। খেলোয়াড় সাকিব আমার কাছে অনেক বড়। 

সমকাল : বিদেশে সাকিবের সঙ্গে দেখা হলে কী করবেন?

তামিম : আমি জিজ্ঞেস করব, তুমি কেমন আছ। সব ঠিকঠাক আছে তো (হাসি)। আমি নিশ্চিত ও আমাকে জিজ্ঞেস করবে, কেমন আছি। পরিবার ভালো আছে কিনা। আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি– ও আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেবে না, আমি তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেব না। এটা সম্ভব না। 

সমকাল : তাহলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেগুলো দেখা যায়?

তামিম : যেগুলো দেখেন, সেগুলো নোংরামি। তার সঙ্গে বিমানবন্দর, প্লেন বা কোনো জায়গায় দেখা হলে অবশ্যই আমরা কুশল বিনিময় করব। ওই আত্মসম্মান বোধটুকু আমাদের আছে। 

সমকাল : মাশরাফির সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে বা হয়?

তামিম : মাশরাফি ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে এবং যোগাযোগ আছে। আমি হাসপাতালে থাকার সময় তিনি ফোন করেছিলেন। আমার জন্য দুশ্চিন্তায় ছিলেন। দোয়া করেছেন। ক্রিকেটার হিসেবে একটা সম্পর্ক তো থাকেই। এই সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার নয়। 

সমকাল : মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ এখনও ক্রিকেটে আছেন। আপনার পরিকল্পনা কী?

তামিম : আগামী মাসে সিঙ্গাপুরে আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা আছে। ৪ জুলাই ওখানে যাব। ৫ ও ৬ জুলাই টেস্টগুলো হবে। রিপোর্ট ভালো হলে আশা করছি, চিকিৎসক খেলার অনুমতি দেবেন। যেহেতু একটি বড় ঘটনা ঘটে গেছে, তাই বুঝেশুনে কাজকর্ম করতে হবে আমাকে। আল্লাহ সুস্থ রাখলে বিপিএল খেলার ইচ্ছা আছে। প্রিমিয়ার লিগের ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত নিইনি। সবকিছুই নির্ভর করছে সিঙ্গাপুরের রিপোর্টের ওপর। 

সমকাল : আলোচনা আছে, আপনার ফোকাস এখন ক্রিকেট বোর্ড। আপনি কি বিসিবিতে যুক্ত হতে চান? 

তামিম : আমি যেভাবে চিন্তা করছি, সেটা একটু ভিন্ন। আমরা বোর্ডে গেলে ক্রিকেটের ভালো করার জন্যই যাওয়া উচিত। এখন যেভাবে বিসিবি চলছে, ওইভাবে যেতে হলে না যাওয়াই ভালো। এ ব্যাপারে আমি খুবই পরিষ্কার। অনেকে প্রতিশ্রুতি দেন এই করবেন, ওই করবেন। আমার কাছে মনে হয়, কেউ বলে পরিবর্তন করতে পারে না, চেষ্টা করতে পারে। আমিও তাই বলব, আমি গেলে ভালো করার চেষ্টা করব। তবে শুধু শুধু বোর্ডের পরিচালক হওয়া বা কোনো পদ নেওয়ার শখ আমার নেই। কারণ আল্লাহ খেলার মাধ্যমে আমাকে অনেক দিয়েছে। 

সমকাল : বড় পরিবর্তন আনতে হলে তো বিসিবির নির্বাচিত সভাপতি হতে হবে। সেটা কি সহজ?

তামিম : একদম সত্যি কথাই বলেছেন। নির্বাচনটা কীভাবে হয়, তা আমরা জানি। আমি যে সুন্দর একটা বোর্ডের চিন্তা করছি, বাস্তবে সে সুযোগ কম। পরিবর্তন করা না গেলে আমাদের মতো লোকজনের দরকার কী? যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলুক। 

সমকাল : কাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে কি নির্বাচিত পরিচালক হবেন?

তামিম : অবশ্যই চিন্তা করব। বলেছিলেন ভালো কাজ করতে হলে বোর্ডের শীর্ষ কর্তা হতে হবে। বিসিবিতে ২৫ জন পরিচালক থাকে। সবার সঙ্গে সবার সম্পর্ক ভালো থাকবে না। সবার সঙ্গে সবার বোঝাপড়া ভালো থাকবে না। তবে সবাইকে একটি দল হিসেবে কাজ করতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা। ২৫ জনের ১০ জনের উদ্দেশ্য ব্যক্তিস্বার্থ দেখা হলে তা আমার কাজে বাধা সৃষ্টি করবে। ওই রকম পরিবেশে কাজ করা কঠিন। 

সমকাল : দেশের ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থাকে কীভাবে দেখছেন?

তামিম : বর্তমানে জাতীয় দলের তিন সংস্করণে তিনজন অধিনায়ক। আমার কাছে জিনিসটা কার্যকর মনে হয় না। আমরা এমনিতেই ধুঁকছি। সেখানে যেভাবে শান্তকে সরানো হলো, তা দুঃখজনক। বিসিবি যে কাউকে অধিনায়ক করতে পারে। মিরাজ খুবই ভালো প্রার্থী। কিন্তু শান্তকে সম্মান দিয়ে সরাতে পারত। উচিত ছিল আগে শান্তর সঙ্গে কথা বলা, পরে নতুন অধিনায়কের সঙ্গে। সবকিছু চূড়ান্ত করে মিডিয়ায় জানাতে পারত। হয়েছে উল্টোটা।

সমকাল : পঞ্চপাণ্ডবের শূন্যতা পূরণে বিসিবির কী করা উচিত?

তামিম : পাঁচজন অভিজ্ঞ খেলোয়াড় সরে গেছে, যাদের ১৫ থেকে ১৭ বছরের অভিজ্ঞতা। তারা হাজারের মতো ম্যাচ খেলেছে। তারা শীর্ষ পারফরমার ছিল। এই মানের ক্রিকেটার সরে গেলে যে কোনো দলে শূন্যতা তৈরি হবেই। কথা হচ্ছে বিসিবি কি ক্রান্তিকালের জন্য প্রস্তুত ছিল? বোর্ড সচেতন থাকলে এত সমস্যা হতো না। এখন যারা আছে, তাদের বেশির ভাগই ৭ থেকে ১০ বছর ধরে খেলছে। আমি বলব, জাতীয় দলকে সব সুবিধা দেন, সিরিজ বা টুর্নামেন্ট খেলতে থাক। কিন্তু ফোকাস দেন এইচপি, টাইগার্স এবং ‘এ’ দলে। এই জায়গাগুলোতে বেশি বিনিয়োগ না করলে, ভালো খেলোয়াড় তৈরি করা সম্ভব না হলে জাতীয় দল সব সময় ধুঁকতে থাকবে।

সমকাল : আগামী বছর টি২০ বিশ্বকাপ, ২০২৭ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। এই দুই টুর্নামেন্ট নিয়ে বিসিবির পরিকল্পনা কেমন হলে ভালো হয়?

তামিম : আমার কাছে মনে হয় ক্রিকেটারদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বেশি। দল হিসেবে ভালো করতে পারছে না। বোর্ডের ভেতরে অস্থিরতা। অধিনায়ক পরিবর্তন হলো। জিনিসগুলো খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলেছে হয়তো। বিসিবির জন্য এ মুহূর্তে করণীয় হলো– দলের ভেতরে আস্থা ফিরিয় আনা। খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস দেওয়া যে– যা কিছুই ঘটুকু বোর্ড তোমাদের সঙ্গে আছে। এই খেলোয়াড়রাই কিন্তু ২০২৬ ও ২০২৭ সালের বিশ্বকাপে খেলবে।

সমকাল : তাহলে কি ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ ঠিকভাবে চলছে না?

তামিম : আমার কাছে মনে হয়, ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যানের সিলেকশন মিটিংয়ে বসা উচিত না। একাদশ নিয়ে নাক গলানো উচিত না। তাঁর অধীনে তিনজন নির্বাচক আছেন; কোচ, সহকারী কোচ আছেন। সবাইকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। এর পর দল ফেল করলে জবাবদিহি চাইবেন। নিজেই সবকিছুতে জড়িয়ে গেলে নির্বাচক, কোচিং স্টাফকে প্রশ্ন করবে কে?

সমকাল : আপনি ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যান হলে কী করবেন?

তামিম : আমি চেষ্টা করব খেলোয়াড়দের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে। নির্বাচক প্যানেল, কোচিং স্টাফকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে তাদের কাছ থেকে পারফরম্যান্স আদায় করতে। অফ সিজনে এক-দু’জন ক্রিকেটারকে হলেও কাউন্টিতে খেলার সুযোগ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া। কাউন্টি দলের সঙ্গে নিজেদের টাকায় হলেও দু’জন কোচকে প্রতিবছর জুড়ে দেওয়া, যাতে তারা উন্নত কোচিংটা শিখতে পারেন। তারা শিখলে তাদের কাছ থেকে দেশের অনেক কোচ শিখতে পারবেন।

সমকাল : আপনার চোখে দেশের ভবিষ্যৎ তারকা কে বা কারা? 

তামিম : বর্তমান দলের বেশির ভাগ ক্রিকেটারই আমাদের সঙ্গে খেলেছে। অনেকের ভালো পারফরম্যান্স আছে। পেস বোলিং বিভাগে তাসকিন আহমেদ আছে, নতুন এসেছে নাহিদ রানা। বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল খুবই ভালো একজন বোলার। তাওহীদ হৃদয়, জাকের আলীরা ভালো করছে। তাদের ভেতর থেকেই কেউ কেউ বড় তারকা হয়ে উঠতে পারে।

সমকাল : শেষ প্রশ্ন– বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

তামিম : আমি খুবই আশাবাদী। আমরা হয়তো সাময়িকভাবে ভালো করছি না। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলে ফল দেখতে পাব। আমরা আসলে তিন সংস্করণে একসঙ্গে কখনোই ভালো খেলিনি। এই দলটাকেও এক বছর সময় দিলে ঘুরে দাঁড়াবে। আমি চাইব, বিসিবি ক্রিকেটারদের সর্বাত্মক সাপোর্ট দেবে, তারা যেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলতে পারে।

সমকাল : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

তামিম : সমকালকেও ধন্যবাদ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ