বাংলা ভাষার ইতিহাসকে আমরা প্রধানত বুঝে থাকি জাতীয়তাবাদী আবেগ ও অহমিকার ওপর দাঁড়িয়ে। এই অতীতমুখিনতার কারণে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎকে আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। একই সঙ্গে বুঝতে পারি না যে ঐতিহাসিক পাটাতন প্রস্তুত করতে আবেগের মূল্য থাকলেও বাস্তব দুনিয়ার দৈনন্দিন লড়াইয়ে আবেগ ও অহমিকার ভূমিকা খুবই কম। কেননা, একটি ভাষাকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে হয়, অন্য ভাষার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপদগুলোর সঙ্গে লড়াই করতে হয়।

একসময় বাংলা ভাষাকে ইংরেজির বালাই থেকে মুক্ত হতে হয়েছে, উর্দুর সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। আবার প্রয়োজন অনুযায়ী আরবি, ফারসি, ইংরেজি, উর্দু, হিন্দির সঙ্গে আপসও করতে হয়েছে। নয়তো বাংলা ভাষার কাঠামোই তৈরি হতো না।

প্রশ্ন হলো ভবিষ্যতের জন্য বাংলা ভাষা কতখানি প্রস্তুত? বাংলা শিখন ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ কেমন? প্রযুক্তি ও বাংলা ভাষার সম্পর্ক তৈরিতে সরকার পরিচালিত কাজের পরিসর কতটুকু এগিয়েছে? বাংলা ভাষার সামনে নতুন কোনো বিপদ আছে কি?

দেখতে পাই, নতুন বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইংরেজি ভাষার নব্য-আধিপত্য। বাংলা ভাষার ওপর ইংরেজির শক্তপোক্ত প্রভাব পড়েছে। নতুন প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের প্রধান ভাষা হয়ে উঠেছে ইংরেজি। নিউ মিডিয়া ও ইংরেজি ভাষা অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কে আবদ্ধ। সাংস্কৃতিক উপকরণ ও উপাদানগুলোর ভোক্তা হিসেবে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী এই ভাষাজগতের ভেতরে প্রবেশ করতে বাধ্য। ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রতিনিয়ত উৎপাদিত আধেয়র বিরাট অংশ ইংরেজিনির্ভর। এ কারণে অনুমান করাই যায়, শ্রোতার মনে তার একটি রেশ থেকে যাবে।

আর তাই ইংরেজি ভাষা দাপটের সঙ্গে বাংলা ভাষার ওপর খবরদারি করছে। প্রয়োজন ছাড়াই বাংলার বিকল্প হিসেবে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করার ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। লেখা ও বলায় এর প্রকোপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বাংলা বাক্যকাঠামোয় ঢুকে যাচ্ছে ইংরেজি শব্দ ও বাক্যাংশ। মিশ্রণের এই প্রবণতা বড় যে ক্ষতিটি করছে, তা হলো ইংরেজি ভাষার স্বাভাবিকীকরণ ঘটাচ্ছে; বিকল্প হিসেবে ইংরেজি গ্রহণের মানসিকতা তৈরি করে দিচ্ছে। এমন নয় যে প্রাসঙ্গিক বাংলা শব্দগুলো উদ্দিষ্ট ভাব বোঝাতে অক্ষম; বরং বাংলা শব্দ ব্যবহার না করার ফলেই শব্দের স্বাভাবিক প্রয়োগযোগ্যতা নষ্ট যাচ্ছে।

বাংলা ভাষা নতুন আরেক বিপদের মুখোমুখি; তা হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় বাংলা লিখন ও অনুবাদ। ইদানীং চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে অনেক শিক্ষার্থীকেই বাংলা লিখতে দেখছি; দ্রুততার সঙ্গে তঁারা তৈরি করে ফেলছেন প্রত্যাশিত লেখা। গুগল ট্রান্সলেটরের সহায়তায় ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করছেন কেউ কেউ। এমনকি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা হাতে তুলে নিচ্ছেন চ্যাটজিপিটি ও গুগল ট্রান্সলেটরকে।

এসব আধেয় ও অনুবাদ মূলত যন্ত্রপ্রসূত। শব্দগুলো বাংলা ভাষার, কিন্তু বাক্যরীতি ইংরেজির। অনেক ক্ষেত্রে বাক্যকাঠামো ঠিক থাকলেও শব্দের পরিপ্রেক্ষিত ঠিক নেই। লেখাগুলোয় থেকে যাচ্ছে প্রচুর বানানবিভ্রাট। এ ধরনের বাংলা লিখতেন উনিশ শতকের ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কিংবা শ্রীরামপুর মিশনের ইংরেজ পণ্ডিতেরা। দুর্বল ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করে বাংলাভাষী কেউ এমন বাংলা লিখুক, তা আমরা চাই না। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এমন বাংলার খোপে বন্দী হোক, তা–ও আমাদের কাছে প্রত্যাশিত নয়। যদি না চাই, তার মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি প্রয়োজন।

শুদ্ধ বাংলা শেখার জন্য মানসম্মত অ্যাপস ও গেমসের কথা আমরা ভাবতে পারি। ভাবা যেতে পারে বাংলা ব্যাকরণের অনলাইন সংস্করণের কথা, যার সহায়তা নিয়ে স্থানীয়-অস্থানীয় যেকেউ চাইলেই প্রয়োজনমাফিক ব্যাকরণিক জ্ঞান গ্রহণ করতে পারবে এবং নিজের লেখার শুদ্ধ্যশুদ্ধির সমস্যা দূর করতে পারবে। প্রশ্ন দাঁড়ায়, কাজগুলো করবে কে? আমাদের ভাষা–পরিকল্পনা আছে কি? এসব প্রশ্নের জবাবও নেতিবাচক।

সম্প্রতি লোকগল্প–বিষয়ক একটি অনুবাদগ্রন্থ পড়ে স্তম্ভিত হলাম। কারণ, দুর্বল যন্ত্রানুবাদের কারণে ভাষার অভ্যন্তর কাঠামোয় রয়ে গেছে ইংরেজির গভীরতর ছাপ। একইভাবে বিস্মিত হয়েছি একটি দৈনিকে প্রকাশিত ফিচার পড়তে গিয়ে। সংশ্লিষ্ট লেখকও যন্ত্রানুবাদের সহায়তা নিয়েছেন। অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থী বা লেখকের অনুধাবন ও লিখনপ্রক্রিয়ায়। প্রযুক্তিনির্ভরতার কারণে ব্যাহত হচ্ছে লেখক–শিক্ষার্থীর কল্পনাপ্রসূত বাংলা লিখন। প্রারম্ভিক কল্পনার সুযোগ না নিয়েই একজন লেখক বা শিক্ষার্থী চ্যাটজিপিটির দ্বারস্থ হচ্ছেন। এতে ওই ব্যক্তির স্মৃতিতে সঞ্চিত হচ্ছে না প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় শব্দ, গড়ে উঠছে না নিজস্ব শব্দভান্ডার। বিঘ্নিত হচ্ছে কপিরাইট বা লেখকস্বত্বের ধারণা।

তাই বলে প্রাযুক্তিক বাস্তবতাকে আমরা উপেক্ষা করতে পারব? সম্ভবত না। নতুন প্রযুক্তিকে মেনে নিয়েই উদ্ভূত সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। বাংলা ভাষাকে নিয়ে আসতে হবে প্রযুক্তির কাছাকাছি। বাংলা ভাষার অভিধান, বানানরীতি ও ব্যাকরণকে সহজলভ্য করে তুলতে হবে। এই বাস্তবতায় কোনো অভিধানের পিডিএফ সংস্করণের চেয়ে প্রভাবশালী হতে পারে অভিধানের ওয়েবসাইট। যেখান থেকে সহজেই পছন্দসই শব্দটি নির্বাচন করে নেওয়া যাবে, থাকবে সমার্থক শব্দ, শব্দের ব্যুৎপত্তিগত ইতিহাস, প্রাচীন ও সাম্প্রতিক প্রয়োগের দৃষ্টান্ত।

প্রযুক্তিকে ব্যবহার করেই বাংলা ভাষা শিখনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা জরুরি। প্রযুক্তির ক্রম–উত্থান দেখে অনুমান করাই যায়, পৃথিবীর ভাষাগুলো পরস্পরের কাছাকাছি এসে দাঁড়াবে। প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে যে ভাষা যত বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে, সে ভাষা তত বেশি তার সক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে। যেমন ভাষাশিক্ষা প্রযুক্তির প্রতিষ্ঠান ডুয়োলিঙ্গোর দেওয়া তথ্যমতে, কোভিড পরিস্থিতিতে স্প্যানিশ হয়ে উঠেছে দ্বিতীয় অধ্যয়নের ভাষা। এর পেছনে রয়েছে প্রযুক্তির ইতিবাচক অবদান।

শুদ্ধ বাংলা শেখার জন্য মানসম্মত অ্যাপস ও গেমসের কথা আমরা ভাবতে পারি। ভাবা যেতে পারে বাংলা ব্যাকরণের অনলাইন সংস্করণের কথা, যার সহায়তা নিয়ে স্থানীয়-অস্থানীয় যেকেউ চাইলেই প্রয়োজনমাফিক ব্যাকরণিক জ্ঞান গ্রহণ করতে পারবে এবং নিজের লেখার শুদ্ধ্যশুদ্ধির সমস্যা দূর করতে পারবে। প্রশ্ন দাঁড়ায়, কাজগুলো করবে কে? আমাদের ভাষা–পরিকল্পনা আছে কি? এসব প্রশ্নের জবাবও নেতিবাচক।

অবশ্য জাতীয় শিক্ষানীতিতে ভাষাবিষয়ক কিছু ধারা-উপধারা আছে। ২০২৪ সালে প্রণীত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক নীতিমালার খসড়া। এখানে এআইয়ের সহায়তায় ভাষার বাধা ঘুচে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো ভাষানীতি নেই। অথচ ভাষা–পরিকল্পনা ও নীতি ছাড়া ভাষার বিস্তার সম্ভব নয়। দমন করা সম্ভব নয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রসূত চিন্তার কুম্ভিলকবৃত্তি। সামগ্রিক বাস্তবতায় বলা চলে, বাংলা ভাষা ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত নয়।

প্রকৃতপক্ষে আমাদের একটি ভাষা কমিশন দরকার। ভাষাবিজ্ঞানী, ভাষা–গবেষক, শিক্ষক, ভাষাপ্রযুক্তিবিদ এবং সরকারি প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত ভাষা কমিশনের কাজ হবে দেশে বিদ্যমান ভাষা-পরিস্থিতিকে আমলে নিয়ে ভাষানীতি প্রণয়ন করা। এই নীতি কাজ করবে বাংলাদেশে বিদ্যমান ভাষার প্রয়োগ-পরিসর নিয়ে। সেখানে প্রধানত গুরুত্ব পাবে ভবিষ্যতের উপযোগী বাংলা ভাষা।

 সুমন সাজ্জাদ অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক ত র ম ব দ ধ মত ত ব যবহ র ব য করণ আম দ র অন ব দ করণ র

এছাড়াও পড়ুন:

রূপগঞ্জে টেক্সটাইল কারখানায় গ্যাসের মিটার বিস্ফোরণে চারজন দগ্ধ

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে একটি টেক্সটাইল কারখানায় গ্যাসের মিটার বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডে চার নিরাপত্তা প্রহরী দগ্ধ হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজনের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার রূপসী কাজীপাড়া এলাকার জৈনপুরী আশরাফিয়া টেক্সটাইল কারখানায় (মঞ্জু টেক্সটাইল) এ ঘটনা ঘটে।

নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, মে দিবসের কারণে কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ। এ জন্য লাইনে গ্যাসের উচ্চ চাপ সৃষ্টি হয়ে মিটারে বিস্ফোরণ হয়। সেখান থেকে আগুন ধরে চারজন নিরাপত্তা প্রহরী দগ্ধ হয়েছেন। ফায়ার সার্ভিস পৌঁছানোর আগেই কারখানার লোকজন ও স্থানীয় লোকজন মিলে আগুন নিভিয়ে ফেলেন।

এ ঘটনায় দগ্ধ আবদুল হান্নান (৫০), কবির হোসেন (৪৫) ও সাইফুল ইসলামকে (২৫) রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। দগ্ধ অন্যজনের নাম জানা যায়নি। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

হাসপাতালের আবাসিক সার্জন শাওন বিন রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ চারজনকে হাসপাতালে আনা হয়। আঘাত গুরুতর না হওয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে একজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি তিনজনের শরীরের ৩৪ থেকে ৫৩ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাঁদের শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় অবস্থা আশঙ্কাজনক।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বলেন, রাতের ডিউটি (দায়িত্ব) শেষে সকাল আটটার দিকে শ্রমিকেরা কারখানা ছেড়ে চলে যান। এর কিছুক্ষণ পর তিতাস গ্যাস সংযোগের আরএমএস কক্ষে বিকট শব্দে একটি দেয়াল ধসে পড়ে এবং আগুন ধরে যায়। তখনই চারজন দগ্ধ হন। পরে কারখানার লোকজন ও স্থানীয় লোকজন মিলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।

ঘটনাটি ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ দাবি করে কারখানার মালিক মঞ্জুরুল হক ভূঁইয়া বলেন, ঘটনার পর আপাতত কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। শ্রমিকদের সব চিকিৎসার ব্যয় কারখানা থেকে বহন করা হবে। তাঁদের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লিয়াকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেছে। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ