স্বীকৃতিহীনতা এক অর্থে লাভজনক: রাসেল রায়হান
Published: 25th, February 2025 GMT
রাসেল রায়হান কবি ও কথাশিল্পী। কথাসাহিত্য ও কবিতা—দুই মাধ্যমেই সমানতালে লিখে চলেছেন। জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনারা রাসেল রায়হানের ভাব ও ভাষায় অনায়াসে প্রাণ প্রচুর্য পেয়ে যায়। তার লেখা পাঠকের হৃদয়ে বৃষ্টির মতো রিন রিন দুঃখের বুঁদবুঁদ তুলে দিতে সক্ষম। রাসেল রায়হান কবিতায় অর্জন করেছেন ‘জীবনানন্দ দাশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ১৪২২’ এবং ‘মাহবুবুল হক শাকিল পদক ২০১৭’। চলতি বইমেলায় রাসেল রায়হানের নতুন কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। নতুন বইয়ের প্রেক্ষাপটসহ বিভিন্ন বিষয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন রাসেল রায়হান। সাক্ষাৎকার গ্রহণে স্বরলিপি।
রাইজিংবিডি: কথাসাহিত্য এবং কবিতা—দুই মাধ্যমেই লিখছেন। সৃজনে কথাসাহিত্য কবিতায় কীভাবে প্রভাব ফেলে আর কবিতা কীভাবে কথাসাহিত্যে প্রভাব ফেলে? নাকি কোনো প্রভাব ফেলে না?
রাসেল রায়হান: প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কম-বেশি প্রভাব তো অবশ্যই ফেলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রভাবটা পড়ে ভাষায়। চিন্তাতেও পড়ে অনেকটা। আমি ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করি, কথাসাহিত্যে কবিতার প্রভাব এড়িয়ে যেতে। যদিও এমন কথাসাহিত্যিকও আছে, যাদের সাহিত্যের ভাষা কাব্যিক, ক্ষেত্রবিশেষে বেশি। তবে যেহেতু কবিতায় টানাগদ্য ফর্ম আছে, দীর্ঘ কবিতা হতে পারে, এবং সেগুলো নিয়ে কিছু কাজও আছে আমার, ফলে আমি ব্যক্তিগতভাবে কথাসাহিত্যে এটা পুরোপুরিই এড়াতে চাই। খুব সতর্ক থাকি। বিপরীতভাবে কথাসাহিত্যের প্রভাব কবিতায় পড়লে কবিতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
রাইজিংবিডি: চলতি বইমেলায় আপনার নতুন প্রকাশিত কবিতার বই ‘মূকাভিনেতার ডায়েরি’ সম্পর্কে জানতে চাই।
রাসেল রায়হান: নাম থেকেই কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন, এটা এমন একজনের লেখা কবিতা, যে স্বাভাবিকভাবে অন্য 'আমজনতার' মতো কথা বলতে পারেনি। তাকে কথা বলতে হয়েছে ইশারায়, অভিব্যক্তিতে। অনেকটা মূকাভিনেতার ভূমিকায় প্রকাশ করতে হয়েছে নিজের বক্তব্যগুলোকে, দীর্ঘদিন ধরে। দিনের পর দিন বহু কৌশল নিতে হয়েছে। ৫৭ ধারার ভয় তো ছিলই। ফলে তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে নিজের মতো একটি ভাষার। সেই ভাষায় নিজের আনন্দ আছে, বেদনা আছে, প্রেম-প্রতিবাদ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আছে; অন্যেরটাও আছে। সেসবেরই সংকলন এই কবিতার বই।
আরো পড়ুন:
প্রসঙ্গ: আত্মকথা ইতিকথা
বইমেলায় ঝুমকি বসুর তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ‘ছাতিম ফুলের গন্ধ’
রাইজিংবিডি: সম্প্রতি কোন কোন কবির কবিতা পড়েছেন, সমকালীন কাদের কবিতা ভালো লাগে?
রাসেল রায়হান: সম্প্রতি পড়েছি সিকদার আমিনুল হকের শ্রেষ্ঠ কবিতা, জব্বার আল নাঈমের কবিতার বই 'আত্মার আওয়াজ'। সমকালীন কবিদের আমি প্রায় অর্ধশত কবির কবিতা নিয়মিত পড়ি। ভালো লাগার তালিকা করলে অন্তত ৩০ জন কবির নাম বলতে হবে।
রাইজিংবিডি: কবিতা কখন গদ্যময়তা দাবি করে?
রাসেল রায়হান: বর্তমানে বেশির ভাগ কবিতাই গদ্যময়। এর বড় একটা কারণ হিসেবে বলতে পারি, বর্তমান সময়ের কবিরা কবিতার অন্যান্য কলকব্জার চেয়ে বোধে বেশি গুরুত্ব দেয়। গদ্যে সেই বোধের প্রকাশ তুলনামূলক সহজ। এবং স্মার্ট। পাঠ্যপুস্তক থেকে আমাদের সময়ে এসে কবিতা যোজন যোজন দূরে এগিয়ে গেছে। ফলে এই সময়ের কবিতা গদ্যময়তাই বেশি দাবি করে।
রাইজিংবিডি: বিব্রত ময়ূর-এর পাণ্ডুলিপির জন্য ‘জীবনানন্দ দাশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ১৪২২’ পেয়েছেন। একই গ্রন্থের জন্য পরবর্তীকালে পেয়েছেন ‘মাহবুবুল হক শাকিল পদক ২০১৭’। এরপরে আপনার আরও বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ হয়েছে। স্বীকৃতি এবং স্বীকৃতিহীনতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
রাসেল রায়হান: স্বীকৃতি ভালো লাগা তৈরি করে। সহজে অন্য পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করায় সহায়তা করে। এতটুকুই। এরপর পাঠক নিজেই বেছে নেন, পড়বেন কি পড়বেন না। অন্তত পাঠক পাতা উলটে দেখবেন, এটুকু প্ররোচনা দেয় স্বীকৃতি। স্বীকৃতিহীনতা এক অর্থে লাভজনক যে লেখকের সামনে অন্যের প্রত্যাশা থাকে না, ফলে লেখক অনেকটা চাপহীন থাকেন।
রাইজিংবিডি: প্রকাশনীগুলোর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
রাসেল রায়হান: আমার অভিজ্ঞতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভালো। তবে দেশের বেশির ভাগ প্রকাশনীকেই পেশাদার হতে হবে। বিশেষ কিছু প্রকাশনীকে 'আরও পেশাদার' হতে হবে। আর বাকিদের বন্ধ করে দেওয়াই উত্তম।
রাইজিংবিডি: একজন লেখকের বই প্রচার কৌশল কেমন হওয়া উচিত?
রাসেল রায়হান: প্রচারের মূল (হয়তো একমাত্র) দায়িত্ব নেওয়া উচিত প্রকাশনীর। লেখকের প্রচারের একমাত্র কৌশল তো হওয়া উচিত, নিজের টেক্সটে মনোযোগ দেওয়া। কেউ লিখতে এলো মানেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্বের তাবৎ মহান লেখককুল। এটুকু মাথায় নিয়েই লেখকের লেখা উচিত। প্রচার-প্রচারণার সমূহ ভার ছেড়ে দেওয়া উচিত সময়ের হাতে। যদিও বাস্তবতা ভিন্ন। সে-কথা আর না-ই বললাম। চর্বিত চর্বণ হয়ে যেতে পারে।
ঢাকা/লিপি
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলতে চান রিকশাচালক শফিকুল
বাঁশির সঙ্গে সখ্য সেই শৈশবে। গ্রামে যাত্রাপালায় গান করতেন আর বাঁশির সুরে ছড়াতেন মুগ্ধতা। জীবন-জীবিকার তাগিদে একসময় বেছে নেন রিকশাচালকের পেশা। গ্রাম ছেড়ে থিতু হন ব্যস্ত শহরে। তবে বাঁশের বাঁশিকে হাতছাড়া করেননি শফিকুল ইসলাম (৪৫)।
যানজটে গতি থামতেই রিকশার হ্যান্ডেল ছেড়ে শফিকুল কোমর থেকে হাতে নেন প্রিয় বাঁশি। হর্নের কর্কশ ধ্বনি এড়িয়ে তখন বাতাসে ভাসে সুরের মূর্ছনা। বেখেয়ালি যাত্রী আর পথচারীরা হঠাৎ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন বাঁশিওয়ালার দিকে।
দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাঁশির সঙ্গে মিতালি গড়েছেন শফিকুল। সেই বাঁশির সুরেই যেন তাঁর জীবন বাঁধা। অভাব, দুর্দশা আর দারিদ্র্যও এ বন্ধন থেকে তাঁকে আলাদা করতে পারেনি। রিকশার প্যাডেলের ছন্দে তাঁর ঠোঁটে বিমূর্ত হয়ে বাঁশির করুণ সুর। বগুড়া শহরের পথচারীদের কাছে তিনি ‘বাঁশিওয়ালা রিকশাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত।
শফিকুলের পৈতৃক ভিটা বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার শালিখা গ্রামে। তবে জীবিকার তাগিদে থাকেন বগুড়া শহরের মালতীনগর এলাকার একটি গ্যারেজে। গত রোববার বিকেলে তাঁর দেখা মেলে বগুড়া শহরের কোর্ট হাউস স্ট্রিটের ব্যস্ত সড়কে। শেষ বিকেলে যানজটে যখন পথচারীরা বিরক্ত, তখন বাতাসে ভেসে আসে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ ভাওয়াইয়া গানটির সুর।
দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাঁশির সঙ্গে মিতালি গড়েছেন শফিকুল। রিকশার প্যাডেলের ছন্দে তাঁর ঠোঁটে বিমূর্ত হয়ে বাঁশির করুণ সুর। বগুড়া শহরের পথচারীদের কাছে তিনি ‘বাঁশিওয়ালা রিকশাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত।এরই একফাঁকে আলাপ হয় শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি জানান, দারিদ্র্যের কারণে পঞ্চম শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই পড়ালেখা বন্ধ করতে হয়। এরপর জড়িয়ে পড়েন গ্রামের একটি যাত্রাপালার দলে। ‘কাজলরেখা’, ‘সাগরভাসা’, ‘গুনাইবিবি’, ‘রাখালবন্ধু’, ‘রূপবান’সহ নানা লোককাহিনিনির্ভর যাত্রাপালায় অভিনয় ও গান করেছেন। শুধু তা–ই নয়, গানের সুরে হারমোনিয়ামও বাজাতেন। এসবের ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক রিকশা চালাতেন তখন।
পরিবারের বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল বলেন, ২০০০ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রী মোর্শেদা গৃহিণী। তাঁদের তিন মেয়ে—শরীফা, শম্পা ও শাকিলা। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী ও দুই মেয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। মাসে দুবার তিনি বাড়িতে যান। শফিকুলের দাবি, বগুড়া শহরে রিকশা চালিয়ে দিনে পান ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। থাকা-খাওয়া ও রিকশার জমা খরচ ছাড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা থেকে যায়। সেই টাকায় চলে সংসার।
শুরুতে শহুরে জীবন শফিকুলের একদম ভালো লাগত না, মন পড়ে থাকত সেই গ্রামে। মন ভালো রাখতে রিকশা চালানোর সময় গুনগুন করে গাইতেন। এর মধ্যে শহরের রাস্তায় একদিন এক বাঁশিওয়ালার সঙ্গে তাঁর দেখা। তাঁর কাছ থেকে উপার্জনের ৮০ টাকা দিয়ে একটি বাঁশি কেনেন তিনি। এরপর রাতে গ্যারেজে শুয়ে সেই বাঁশিতে সুর তোলেন। এখন বাঁশি তাঁর নিত্যসঙ্গী।
বাঁশি বাজাতে বাজাতে রিকশা চালানো অভ্যাস হয়ে গেছে জানিয়ে শফিকুল বলেন, যানজটে আটকা পড়লে বাঁশিতে সুর তোলেন। যাত্রী না পেলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একমনে বাঁশি বাজান। সুর শুনে যাত্রীরা ১০-২০ টাকা বেশি ভাড়া দেন কখনো কখনো।
গরিব হওয়ার কারণে মেয়ের পরিবারের লোকজন প্রেমে বাধা হয়। বড়লোকের ছলের লগে বিয়ে হয় মেয়েটার। সেই থাকে গান আর সুর সঙ্গী।শফিকুল ইসলামস্মৃতি হাতড়ে শফিকুল বলেন, একবার ঢাকায় রিকশা চালাতে গিয়েছিলেন। দৈনিক বাংলার মোড়ে রিকশা থামিয়ে একমনে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি ২০ তলা ভবন থেকে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তির চিৎকার শুনতে পান। ওপরে তাকাতেই ৫০ টাকার একটা নোট নিচে ফেলে দেন ওই ব্যক্তি। প্রশংসা করেন বাঁশির সুরের।
আলাপচারিতা একসময় আনমনে হয়ে পড়েন শফিকুল। বলেন, ‘মন তো (মনে) না পাওয়ার কষ্ট আচে। ১৬ বছর বয়সে এলাকার এক মেয়ের প্রেমে পড়চিনু। ৬ মাস ভালোই চলিচ্চিল সেই প্রেম। গরিব হওয়ার কারণে মেয়ের পরিবারের লোকজন প্রেমে বাধা হয়। বড়লোকের ছলের লগে বিয়ে হয় মেয়েটার। সেই থাকে গান আর সুর সঙ্গী। আরও পরে সঙ্গী হয় বাঁশি। এহন বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলে থাকপার চেষ্টা করি।’