অনেক কানাডাবাসীর জন্য প্রচণ্ড উত্তেজনাপূর্ণ হকি ম্যাচটি (আইস হকি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল ম্যাচ, যেখানে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়েছিল) ছিল কঠিন ঠান্ডার মধ্যে এক আরামদায়ক উষ্ণতার ছোঁয়া। আদতে কানাডাবাসীর জন্য এই জয় নিছক খেলার জয় ছিল না। কানাডার কোচ জন কুপার যখন বললেন, ‘আমাদের এই জয় খুব দরকার ছিল’, তখন তাঁকে আর তেমন কিছু ভেঙে বলতে হয়নি। তার দরকারও ছিল না।

কানাডাবাসীর উল্লাসের প্রধান কারণ কয়েক সপ্তাহ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডাকে ব্যঙ্গ করে বলছিলেন, দেশটি আমেরিকার ৫১তম অঙ্গরাজ্য হতে চলেছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে ‘গভর্নর’ বলেও খোঁচা মেরে আসছিলেন। ট্রাম্পের এসব শ্লেষাত্মক মন্তব্য ও হুমকি কানাডার জনগণের মধ্যে দেশপ্রেমের অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছে; একই সঙ্গে তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

কানাডার প্রধান মিত্র ও নিকটতম প্রতিবেশীর এই টিটকারি দেওয়া বক্তব্য প্রমাণ করেছে, বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ ও করপোরেট স্বার্থ রক্ষাকারী বুদ্ধিজীবীর দূরদর্শিতা খুবই সীমিত। অন্ধ মানুষ এবং কুঁজো কার্টুন চরিত্ররা যেমন ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না, তেমনি মুক্তবাণিজ্যের ভক্ত কিছু রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষক বিংশ শতাব্দীতে যে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল, তা দেখতে পাননি। তখন বলা হয়েছিল, একবিংশ শতাব্দীতে কানাডাকে যদি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সঙ্গে আরও বেশি জুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে তা কানাডার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে আমি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করছিলাম। সে সময়ই আমি বুঝতে শুরু করি, কানাডার ভবিষ্যৎ নিয়ে যেসব আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল, তা একদিন বাস্তবে পরিণত হতে পারে। ওই সময়ে আমার একজন অধ্যাপক ছিলেন। তিনি হলেন বিখ্যাত কানাডীয় রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ স্টিফেন ক্লার্কসন। তিনি এখন প্রয়াত। তিনি কানাডার অতীত, বর্তমান এবং সেই সময়ে দেশটি যেসব কঠিন পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, সেগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন ও লিখতেন।

আমি সেই ভাগ্যবানদের একজন ছিলাম, যাঁরা ক্লার্কসনের গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তখন তিনি অটোয়া ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে একটি বই লিখছিলেন। সেই চুক্তিকে সমর্থন দিচ্ছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান। ক্লার্কসন বলেছিলেন, চুক্তিটি কানাডার সার্বভৌমত্বের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত সেই বইয়ের নাম ছিল কানাডা অ্যান্ড দ্য রিগ্যান চ্যালেঞ্জ। এটি একদিকে ছিল কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও বেশি সংযুক্ত করার পক্ষের সমর্থকদের যুক্তির বিরুদ্ধে একটি সুসংগঠিত প্রতিবাদ, আবার অন্যদিকে ছিল এক সতর্কবার্তা যে দেশটি ধীরে ধীরে দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার স্বাধীনতা হারাচ্ছে।

ক্লার্কসন ছিলেন জাতীয়তাবাদী, তবে একই সঙ্গে তিনি একজন বাস্তববাদীও ছিলেন। তিনি জানতেন, ভৌগোলিক অবস্থান ও ঐতিহাসিক সম্পর্কের কারণে কানাডা ও আমেরিকা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। তবু তিনি বুঝতেন, কানাডার জন্য জরুরি হলো শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর না করে বিশ্ববাজারে নিজেদের বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা। কিন্তু ক্লার্কসনের এই সুদূরপ্রসারী সতর্কবার্তাকে অবজ্ঞা করেছিলেন মুক্তবাণিজ্যের উগ্র সমর্থকেরা। তাঁরা তাঁর বক্তব্যকে স্রেফ একটি সময়োত্তীর্ণ, আমেরিকাবিরোধী মনোভাব বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, তিনি একাডেমিক জগতে বন্দী একজন ‘উটপাখি’, যিনি সমৃদ্ধির বিরোধিতা করছেন।

ফলে ১৯৮৮ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী ব্রায়ান মালরনি প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সঙ্গে একটি ব্যাপক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করলেন, তখন পার্লামেন্ট ও গণমাধ্যম এটিকে কানাডার অর্থনৈতিক সাফল্য হিসেবে উদ্‌যাপন করল এবং কানাডার স্বনির্ভরতার ধারণাকে সেকেলে ও অপ্রাসঙ্গিক বলে উপস্থাপন করল। ১৯৮৮ সালের ফেডারেল নির্বাচন মূলত মালরনি-রিগ্যান মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে লড়াই হয়েছিল। একটি টেলিভিশন বিতর্কে তৎকালীন লিবারেল পার্টির নেতা জন টার্নার প্রকাশ্যে ব্রায়ান মালরনিকে চ্যালেঞ্জ করেন। মালরনি দাবি করেছিলেন, এই চুক্তি যেকোনো সময় বাতিল করা সম্ভব।

কিন্তু লিবারেল পার্টির প্রধানমন্ত্রীদের এই চুক্তির প্রশংসায় মেতে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি। তাঁরা শুধু এটিকে স্বাগত জানানোতেই থেমে থাকেননি, বরং মহাদেশজুড়ে মুক্তবাণিজ্যের বিস্তারের জন্য মেক্সিকোকেও এতে যুক্ত করার উদ্যোগ নেন। এখন ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেখা যাচ্ছে, অধ্যাপক ক্লার্কসনের চার দশক আগের সতর্কবার্তাগুলো বাস্তব হয়ে উঠেছে।

একজন শক্তিশালী মার্কিন প্রেসিডেন্ট এখন অর্থনৈতিক চাপ দিয়ে কানাডাকে কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য বানাতে চাইছেন। গত কয়েক দশকে একের পর এক লিবারেল ও কনজারভেটিভ সরকার কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রায় বাধাহীনভাবে একীভূত করার নীতি অনুসরণ করেছে এবং তোষামোদকারী সম্পাদকীয় লেখকেরাও তা সমর্থন করেছেন। ফলে ট্রাম্পের হাতে কানাডাকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার এখন পর্যাপ্ত উপায় ও ক্ষমতা আছে।

হঠাৎ করেই ক্লার্কসনের সেই সমালোচকেরা (যাঁরা এত দিন তাঁকে উপহাস করেছিলেন) এখন তাঁরই কথাগুলো গ্রহণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সংবাদপত্রের পাতায়, রাজনৈতিক কেন্দ্রগুলোয় তাঁরা সবাই কানাডার হারিয়ে যেতে বসা সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছেন। সবাই এখন ‘কানাডার রক্ষক’ হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কিন্তু তাঁদের এই বোধোদয় আসতে ৪০ বছর দেরি হয়ে গেছে। অথচ তাঁদেরই সচেতন নীতির ফলে কানাডা অনেক আগেই স্বেচ্ছায় নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত’ এক আজ্ঞাবহ অনুগামীতে পরিণত করেছে।

অ্যান্ড্রু মিত্রোভিকা একজন কানাডিয়ান সাংবাদিক, লেখক ও বিশ্লেষক

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম র ক র জন য হয় ছ ল র জন ত

এছাড়াও পড়ুন:

সংগীতশিল্পী দীপ মারা গেছেন

র‍াস্টফ ব্যান্ডের ভোকাল আহরার মাসুদ মারা গেছেন। সেমাবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ভক্তদের কাছে দীপ নামে পরিচিত ছিলেন আহরার মাসুদ। 

মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টায় ব্যান্ডের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এ তথ্য জানানো হয়। তবে এ শিল্পীর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। 

আরো পড়ুন:

৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে

সিজেএফবি পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড ঘোষণা

রাস্টফ ব্যান্ডের ফেসবুক পেজে দীপের মৃত্যুর খবর জানিয়ে লেখা হয়, “এমন এক বেদনাদায়ক মুহূর্তে সঠিক শব্দ খুঁজে পাওয়া বা কোনো শব্দ খুঁজে পাওয়া—প্রায় অসম্ভব। প্রিয় ভোকালিস্ট, বন্ধু ও সহযাত্রী আহারার ‘দীপ’ মাসুদের মৃত্যুসংবাদ আমাদের স্তম্ভিত করেছে। আমরা শোকে ভেঙে পড়েছি, এখনো অবিশ্বাসের ভেতর ডুবে আছি। গত রাতেই তিনি আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন।” 

দীপের শূন্যতা ব্যাখ্যা করে লেখা হয়, “তার পরিবার, বন্ধু ও প্রিয়জনদের প্রতি আমাদের অন্তরের সমবেদনা ও প্রার্থনা। আপনাদের মতো আমরাও এই অপূরণীয় ক্ষতি বোঝার চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি দীপের অসাধারণ প্রতিভাকে সম্মান জানাতে এবং তার চেয়েও বড় কথা—মানুষ হিসেবে তিনি আমাদের কাছে যে অমূল্য ছিলেন, তাকে স্মরণ করতে। এই কঠিন সময়ে সবার কাছে অনুরোধ, দয়া করে পরিবার ও কাছের মানুষদের ব্যক্তিগত পরিসরকে সম্মান করুন এবং তার আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করুন। শান্তিতে ঘুমাও, দীপ। তোমার শূন্যতা চিরকাল বেদনাময় হয়ে থাকবে।” 

তরুণদের কাছে জনপ্রিয় আরেকটি ব্যান্ড পাওয়ারসার্চও দীপের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে। ব্যান্ডের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে লেখা হয়েছে, “স্মরণ করছি আহরার মাসুদ দীপকে। কিছুক্ষণ আগে আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রিয় ভাই, ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং এক সত্যিকারের শিল্পীকে। এক্লিপস, কার্ল, ক্যালিপসো ও সবশেষ রাস্টফ ব্যান্ডের অবিস্মরণীয় কণ্ঠ আহরার মাসুদ দীপ আমাদের মাঝে আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।” 

পাওয়ারসার্চ আরো লেখেন, “আহরার মাসুদ দীপ শুধু একজন ভোকালিস্টই ছিলেন না, তিনি ছিলেন শক্তি, সৃজনশীলতা আর আবেগের প্রতীক, যিনি তার চারপাশের সবাইকে অনুপ্রাণিত করেছেন; একই সাথে তার অত্যন্ত নমনীয় ব্যবহার, যা সবাইকে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীই করে ফেলত! শান্তিতে থাকো ভাই, তুমি সব সময় আমাদের গল্পের অংশ হয়ে থাকবে।”

ঢাকা/শান্ত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভোররাতে রণক্ষেত্র: নরসিংদীতে নিহত ১, গুলিবিদ্ধ ৫
  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • আপনার এত সাহস হয় কী করে, সাংবাদিককে নায়িকা
  • দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
  • মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে
  • কুবিতে নতুন ১৮ বিভাগ ও ৪ ইনস্টিটিউট চালুর সুপারিশ
  • সংগীতশিল্পী দীপ মারা গেছেন