জাতীয় নাগরিক পার্টির লক্ষ্য ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা
Published: 28th, February 2025 GMT
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ করা নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’র লক্ষ্য দেশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করা। এর জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নকে অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে তারা।
রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের নাম ঘোষণা করা হয়। দলের আহ্বায়ক পদে আসা মো.
জুলাইয়ে ছাত্র-জনতা বিপুল আত্মত্যাগের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটিয়েছে বলে উল্লেখ করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা কেবল একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্যই ঘটেনি। জনগণ বরং রাষ্ট্রের আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী-ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা থেকে এই অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিল, যেন জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠিত হয়।’
এই লক্ষ্য নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেন নাহিদ ইসলাম। তাঁর ঘোষণায়, এই দল হবে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল।
জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সূচনা করেছে বলে মন্তব্য করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য।’
সেকেন্ড রিপাবলিক কেমন হবে, তার রূপরেখাও লিখিত বক্তব্যে তুলে ধরেছেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা এবং সেগুলোর গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে তাঁদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়া যাবে বলে উল্লেখ করেন নাহিদ ইসলাম।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাহিদ বলেন, তাঁরা এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ চান, যেখানে সমাজে ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিভেদের বদলে ঐক্য, প্রতিশোধের বদলে ন্যায়বিচার এবং পরিবারতন্ত্রের বদলে মেধা ও যোগ্যতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁদের রাজনীতিতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কোনো স্থান হবে না।
সেকেন্ড রিপাবলিকে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে মূলধারায় তুলে আনা হবে বলে জানান নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের রিপাবলিকে সাধারণ মানুষ, একমাত্র সাধারণ মানুষই হবে ক্ষমতার সর্বময় উৎস। তাদের সব ধরনের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারের শক্তিশালী সুরক্ষাই হবে আমাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র। আমরা রাষ্ট্রে বিদ্যমান জাতিগত, সামাজিক, লিঙ্গীয়, ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও বৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে একটি বহুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ করতে চাই। আমাদের রিপাবলিক সব নাগরিককে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে শক্তিশালী সুরক্ষা প্রদান করবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর কোনো অংশকেই অপরায়ণ করা হবে না; বরং রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে সমান গুরুত্ব প্রদান ও সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তুলে ধরেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, তাঁরা কৃষি-সেবা-উৎপাদন খাতের যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে এমন একটি জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তুলতে চান, যেটা হবে স্বনির্ভর, আয়-বৈষম্যহীন ও প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল।
নাহিদ ইসলাম বলেন, অর্থনীতিতে সম্পদ একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে পুঞ্জীভূত হবে না; বরং সম্পদের সুষম পুনর্বণ্টন হবে তাঁদের অর্থনীতির মূলমন্ত্র। বেসরকারি খাতের সিন্ডিকেট ও গোষ্ঠীস্বার্থ নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ভোক্তা ও জনস্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করবেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। নাহিদ বলেন, ‘অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাধ্যমে এই অঞ্চলের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব নিশ্চিত করব এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তি খাতে জোর দিয়ে উদ্ভাবনী সংস্কৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি টেকসই, আধুনিক অর্থনীতি গড়ে তুলব।’
ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাঙ্ক্ষিত সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নাহিদ ইসলাম। ‘আমাদের দেশ, আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যৎ—আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক অধরা কোনো স্বপ্ন নয়, এটি আমাদের প্রতিজ্ঞা’ বলে বক্তব্য শেষ করেন তিনি।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ক ন ড র প বল ক ন ন হ দ ইসল ম গণত ন ত র ক আম দ র স র জন ত ক সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান
ইদানীং কিছু ভদ্রলোক ইনিয়ে-বিনিয়ে, এমনকি সুযোগ বুঝে সরাসরিও বলে ফেলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের চেয়ে শেখ হাসিনার শাসনেই দেশ ভালো চলছিল। দু–একজন এ-ও বলছেন, গত ৪০ বছরে এখনকার মতো খারাপ অবস্থা নাকি তাঁরা দেখেননি।
এই ‘মহামানবদের’ কথা মান্য করলে প্রশ্ন এসেই যায়, কী লাভ হলো গণ–অভ্যুত্থান করে, এত জীবন বিসর্জন দিয়ে, এত রক্ত ঝরিয়ে?
আওয়ামী লীগের শত্রুরা উত্তর দিক: সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে হাসিনা পতনের এক দফা দাবিতে রূপান্তরের কী প্রয়োজন ছিল? গণবিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেড় দশকে গড়ে ওঠা এক শক্তিশালী ব্যবস্থাকে ভেঙে খান খান করে ফেলার কী এমন প্রয়োজন ছিল?
হাসিনা-পরবর্তী এই ‘ভগ্ন হৃদয়ের’ যুগে ভারতীয় শিল্পী কবির সুমনের সে গানটি ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই...শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’ শুনি আর ভাবি, ২০২৪-এর ‘ডামি’ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাকে আজীবন ক্ষমতায় দেখতে চাওয়া অলিগার্কদের কী যে আকুতি ছিল!
মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে নেত্রীর পতন দেখে হয়তো সেদিন তাঁরা শুনেছেন কিংবা গেয়েছেন অন্য কোনো গান। হতে পারে আরেক ভারতীয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া সেই গান তাঁরা গেয়েছিলেন, ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...আমার বলার কিছু ছিল না।’
আক্ষেপ কেন, কমরেড, জীবন নিয়ে পালিয়ে তো তিনি নিরাপদেই আছেন দিল্লিতে!
তবু ‘সে কি ভোলা যায়, তুমি আমারই ছিলে’ হে বাংলাদেশ সাম্রাজ্য! সত্যিই তো তাঁর এবং তাঁদের একচেটিয়া অধিকার ছিল যেভাবে খুশি যত বেশি ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তি ভোগের।
একটি অভিজাত গোষ্ঠীকে (অলিগার্কি) হাসিনা-প্রদত্ত সেই লাভজনক স্থিতাবস্থা হারিয়ে কীভাবে চুপ করে বসে থাকবে এর ‘ভাগ্যবান’ সদস্যরা! নতুন রাজনৈতিক বিনিয়োগও কিছু দরকার হবে যদি ভবিষ্যৎ মুনাফার আশা করতে হয়।
টাকাওয়ালাদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বিনা ভোটে বা জালিয়াতির মাধ্যমে সংসদ সদস্য পদ বা মন্ত্রিত্ব উপহার, তাঁর চামচাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতি এবং দলীয় অনুগতদের মিডিয়ার লাইসেন্স প্রদানসহ কত ধরনের দান-দক্ষিণার ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ‘ষোলো কোটি মানুষকে খাওয়ানোর’ দাবিদার বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগপ্রধান হাসিনার সরকার।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতু থেকে গভীর সমুদ্রবন্দর, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল রোড, ডজন ডজন নতুন ব্যাংক থেকে শত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি—এ রকম বড় বড় ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণে তাঁর কোনো তুলনাই হয় না।
একটু–আধটু দুর্নীতি হলেও অন্তত মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন তো দেখাচ্ছিলেন তাঁর সভাসদরা। এই ধরুন, লাখো কোটি টাকার ব্যাংকঋণ জালিয়াতি, খেলাপি, দলীয় নেতা মাস্তানদের হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি ও সম্পদ লুণ্ঠন, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার ইত্যাদি বিষয় দেড় দশকের স্থিতিশীলতার তুলনায় এমনকি বাড়াবাড়ি!
যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?জনগণকে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন জনদরদি হাসিনা সরকার। ২০১৪ সালের ১৫৪ সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত, ২০১৮ সালে নৈশকালীন ভোট এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন করে হাসিনা তাঁর বাবা শেখ মুজিবের তৈরি একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার নতুন মডেল দাঁড় করান পৃথিবীর সামনে।
যাঁরা এই আওয়ামী শাসনের ‘স্থিতিশীলতা’ নস্যাৎ করতে চেয়েছে তাদের ‘ঠ্যাং ভেঙে’ দিতে একটুও দ্বিধা করেনি হাসিনা সরকার। সরকারের ধারাবাহিকতা নষ্টের চেষ্টাকারীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া হয়েছে গুম, খুন, সহিংসতা, জঙ্গিনাটক, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, প্রতিবাদ দমন ও বাক্স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে। সে জন্য আপনারা তাঁকে ফ্যাসিবাদী বলার সাহসও পাননি তখন।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে হাজারো তরুণ ও সাধারণ মানুষ নিহত (শহীদ) হওয়ার দায় নিতে চাননি হাসিনা। উল্টো তাঁর দাবি, ৫ আগস্ট তাঁকে মারতেই লক্ষ জনতা গণভবন অভিমুখে যাত্রা করেছিল।
আরও পড়ুন‘আমি কী অপরাধ করেছি’— সবাই জানেন শিরোনামটা...৩০ জুলাই ২০২৫আরও রক্তপাত এড়াতেই নাকি তাঁর নিজের লোকদের মায়া ছেড়ে ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্বন করে ভারতে পাড়ি জমান শেখ হাসিনা।
তাই আজ তাঁর ফেরার অপার ইচ্ছা যেন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি গানের মতোই, ‘তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথি হতে আজকের চেষ্টা আমার।’
যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?
যেন এত সব বিষয় নিয়ে জনমনে কোনো ক্ষোভই ছিল না হাসিনার আমলে। এটি সেই বিস্মৃত অতীত, যেটি নিয়ে কল্পিত সংগীত রচিত হয়: ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।
আরও পড়ুনশেখ হাসিনা স্বৈরশাসকদের টিকে থাকার দুটি মূলমন্ত্রেই ব্যর্থ২২ আগস্ট ২০২৪তার মানে, তাঁর শাসনকালই জাতির জন্য ছিল আদর্শ। এটা প্রমাণ করার এক অদৃশ্য প্রচেষ্টা রয়েছে আজ এখানে, আমাদের চারপাশে, আশপাশে।
সত্য, মিথ্যা মিশিয়ে এমন দাবি করেন কারা এবং কেন—সেটা আমাদের একটু বোঝা দরকার।
হাসিনার চামচা ও সুবিধাভোগী, তাঁর ঘরানার অসৎ বুদ্ধিজীবী, তাঁর হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতি নিয়ে নির্বিকার নেতা-কর্মী-সমর্থক, বর্তমান আমলে বিশেষ কিছু না পেয়ে প্রবলভাবে হতাশ কতিপয় সুশীল অথবা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বোধ ব্যক্তির পক্ষেই ফ্যাসিবাদী শাসনামলকে উত্তম বলা সম্ভব।
এতে হাসিনার লোকদের বড় লাভ হতে পারে দায় স্বীকার না করে বা ক্ষমা না চেয়েই তাঁদের হাত ও নামসমূহকে দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের রক্তের দাগ থেকে মুক্ত করা।
এ প্রচেষ্টা ঘটে যাওয়া সত্যকে অস্বীকার, শহীদদের আত্মত্যাগ অগ্রাহ্য, আহত ব্যক্তিদের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং মজলুমদের অনুভূতির সঙ্গে মশকরা ছাড়া আর কিছুই না।
এগুলোই আবার জুলাই বিপ্লবের পক্ষের শক্তির বয়ান তৈরিতে ব্যর্থতা প্রমাণ করে।
আরও পড়ুনহাসিনা শাসনের উন্নয়নের বানোয়াট গল্প০৩ অক্টোবর ২০২৪পরিবর্তনের পক্ষে জনগণের প্রবল আকাঙ্ক্ষার কোনো কমতি ছিল না এবং হত্যা-দুর্নীতিসহ ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের লক্ষ্যে কমবেশি সংস্কারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক চিন্তা, গণতান্ত্রিক ভাবনা, কিংবা আমলাতান্ত্রিক কর্মসূচিকে জনমত তৈরির জন্য সেভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একটা একটা করে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উত্তম বিকল্প জনগণের সামনে আনলে গণমানুষকে নতুন ধারণা ও আশাবাদ উপহার দেওয়া যেত।
কয়েকটি মডেল নির্বাচন দিয়ে, তরুণদের পরিবেশ রক্ষার মতো সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে, রাজনৈতিক দলসমূহকে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে অংশীদার বানিয়ে এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাক করে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে হাসিনার কুশাসনকে যথাযথভাবে চিত্রিত করা যেত।
ধারণা করি, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগে ঘাটতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগগুলো সম্পর্কে জনসম্পৃক্ততার অভাব হাসিনার উপকারভোগীদের নিজস্ব গান গাওয়ার পরিসর দিয়েছে।
ফ্যাসিবাদী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং ২০২৪-এর আন্দোলনে পুরোভাগে থাকা ছাত্র ও অন্য শক্তিগুলো পরস্পরের মধ্যে লজ্জাজনক কুতর্কে জড়িয়ে পড়ায় গণ–অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনের এজেন্ডা এবং উপযোগী বয়ান যথেষ্ট মার খেয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণও কিছুটা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়েছে।
বাংলাদেশিদের বর্তমান হতাশা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়াটাই কাম্য ছিল পরাজিত শক্তির। হাসিনা বিহনে আওয়ামী উপকারভোগী বা অন্ধ সমর্থকেরা গোপালগঞ্জ বা অন্য কোনো অঞ্চলে নিরালায় বসে যেন গুনগুন করে গাইছে গগন হরকরার গান, ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে...।’ তারা বুঝতে পারছে না জাতির জীবনে শেখ হাসিনা এমন এক জুলুমশাহি শাসকের নাম ও ফ্যাসিবাদের প্রতিমূর্তি; যার শাসন পুরো দেশকে বানিয়ে ফেলেছিল ‘জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ’।
নিজেদের বাইরে জনগণের অন্য যেকোনো গোষ্ঠীকে ক্ষমতার ভাগ দিতে না চাওয়া সেই ফ্যাসিবাদী ধারায় ছেদ টেনেছে জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার গঠন, যেটিও আশা করি বাংলাদেশের শেষ সরকার নয়।
বিদায় নেওয়া ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে যেকোনো দেশেই অনেকটা পুরোনো দিনের গান। এই গান অবশ্যই স্মৃতিজাগানিয়া কিন্তু চলমান বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। ভবিষ্যতে আবারও ফ্যাসিবাদকে সহ্য করবে, এমন প্রজন্ম এ দেশে সেকেলে এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তরুণেরা এবং অভিজ্ঞ বিবেকবানেরা এখন অজানা এক নতুন বাংলাদেশের অপেক্ষায়।
ফলে ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’ গান বাদ দিয়ে হাসিনার মানসপুত্রদের এখন নিরালা নিঝুম ও যথাযথ ভাবগম্ভীর পরিবেশে বসে মুদ্রিতনেত্রে মন্দ্রসপ্তক কণ্ঠে ভক্তিভরে গাওয়া উচিত, ‘মা, আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা... ।’
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক
*মতামত লেখকের নিজস্ব