Samakal:
2025-06-16@08:53:13 GMT

জাতীয় আয় বৃদ্ধি টেকসই হবে তো?

Published: 28th, February 2025 GMT

জাতীয় আয় বৃদ্ধি টেকসই হবে তো?

সংবাদটি খুব ছোট্ট করে এসেছে। কেউ হয়তো খেয়াল করেছেন, কেউ আমলেই নেননি। সংবাদটি হচ্ছে, আগামী বছর বাংলাদেশের জাতীয় আয় সম্ভবত ৫০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে যাবে। এই প্রথম দেশটির ইতিহাসে তার জাতীয় আয় ৫০০ বিলিয়ন ডলার পার হয়ে যাবে। বেশ কিছুদিন আগেই আমাদের জাতীয় আয় ৪০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কখনও তা ৫০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়নি। 

কোনো সন্দেহ নেই, এ অর্জন আমাদের জন্য বিপুল গর্বের এবং যখন আমরা ৫০০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে পৌঁছতে পারব, সেটা উদযাপিত হবে। কিন্তু এই অর্জনের সঙ্গে কিছু কথা থেকে যায়। বিশেষত বাংলাদেশ যখন একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে চায়, একটি কর্মচালিত প্রবৃদ্ধি চায় এবং একটি বজায়ক্ষম(টেকসই) উন্নয়ন পথযাত্রা চায়। সে পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক.

এই ৫০০ বিলিয়ন জাতীয় আয়ের বণ্টন কি সমতাবান্ধব হবে, নাকি তা অসমতাকে আরও বাড়িয়ে দেবে? দুই. জাতীয় আয়ের এ প্রবৃদ্ধি কি কর্মনিয়োজন বাড়াবে, নাকি এটি এক কর্মশূন্য প্রবৃদ্ধি হবে এবং তিন. জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি কি পরিবেশবান্ধব হবে, নাকি জাতীয় আয়ের এ প্রসারণ অর্জিত হবে পরিবেশকে নষ্ট করে? এর মানে, জাতীয় আয়ের পরিমাণগত বৃদ্ধির দিকে নজর দিলেই হবে না, সেই বৃদ্ধির গুণগত দিকও বিবেচনায় আনতে হবে।

এটা স্বীকৃত যে, বাংলাদেশে অনপেক্ষ দারিদ্র্য কমে এসেছে এবং বর্তমানে এ দেশের ১৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের দেশে চরম দারিদ্র্যও ৮ শতাংশের মতো। কিন্তু অনপেক্ষ দারিদ্র্য কমে এলেও এ দেশে আপেক্ষিক দারিদ্র্য বা অসমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনে আয় ও সম্পদের অসমতা সর্বজনবিদিত। সত্যিকার অর্থে এ অসমতা বোঝার জন্য উপাত্তের প্রয়োজন হয় না; ঢাকা শহরের পথঘাটে বের হলেই চোখে পড়ে। সেই সঙ্গে হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কিংবা অর্থ পাচারের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, অর্থ ও বিত্ত কয়েকটি মানুষ এবং পরিবারের কুক্ষিগত। মোটা দাগে উপাত্তের দিকে যদি তাকাই, তাহলে আয়ের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের মোট আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ যেখানে দেশের নিম্নতম ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর, সেখানে সমাজের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মানুষ ভোগ করে দেশজ আয়ের ৩৮ শতাংশ। ভোগের ক্ষেত্রে যেখানে নিম্নতম ১০ শতাংশ গৃহস্থালিতে মাসিক মাথাপিছু ব্যয় ২ হাজার ১২২ টাকা, সেখানে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ গৃহস্থালিতে সংখ্যাটি হচ্ছে ৯ হাজার ১৩৭ টাকা। 

মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকেও এমন বৈষম্য বিদ্যমান। অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেখানে প্রতি হাজারে ৪৯, সেখানে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা প্রতি হাজারে ২৫। তেমনিভাবে দেশের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ গৃহস্থালির ৮৫ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় প্রশিক্ষিত সেবিকার হাতে। অন্যদিকে নিম্নতম ২০ শতাংশ গৃহস্থালির মাত্র ৩২ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবিকা দ্বারা। আঞ্চলিক বৈষম্যের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখা যায়, বরিশালে সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৫ শতাংশ, সিলেটে তা ৬০ শতাংশ। তেমনিভাবে পরিবেশ-নাজুক জেলাগুলোতে বিভিন্ন পীড়ার প্রাদুর্ভাব অন্যান্য জেলার তুলনায় বেশি। এসব অঞ্চলে মোট গৃহস্থালির ৪৫ শতাংশই নানা পীড়ার শিকার। 

শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুযোগে বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট। শিক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি ধারা, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম, বিত্তবান ও বিত্তহীনদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি প্রবণতার মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগে বিশাল বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়েছে। দিনের পর দিন কোনো কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বজায় রেখে শিক্ষার সুযোগের ক্ষেত্রে অসমতা আরও বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এসবের প্রতিফলন ঘটেছে শিক্ষা অর্জনের ফলাফলে, তারপর কর্মনিয়োজনে। একইভাবে স্বাস্থ্য খাতে ত্রিধারা ব্যবস্থা বজায় রেখে স্বাস্থ্য সুযোগের ক্ষেত্রেও একটি বিশাল বৈষম্যের দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সেবার পরিমাণ যেমন অপ্রতুল, তেমনি মানও খুব নিম্ন। সাধারণ মানুষই সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যায় এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা ন্যূনতম স্বাস্থ্য সুবিধা পায় না। অন্যদিকে বিত্তবানরা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো মানবিক অধিকার এবং মৌলিক মানবিক চাহিদা বলয়ে এ জাতীয় বৈষম্য অগ্রহণযোগ্য।
তথ্যপ্রযুক্তি সেবায় সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ গৃহস্থালির তিন-চতুর্থাংশের যেখানে আন্তর্যোগ (ইন্টারনেট) সেবা পাচ্ছে, সেখানে নিম্নতম ২০ শতাংশ গৃহস্থালির ক্ষেত্রে তুলনামূলক সংখ্যাটি হচ্ছে মাত্র ৯ শতাংশ। শহরাঞ্চলের ৫৫ শতাংশ মানুষ আন্তর্যোগ ব্যবহার করে, গ্রামাঞ্চলে তেমন মানুষের অনুপাত হচ্ছে ৩৫ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলের মাত্র ৩ শতাংশ ঘরে কম্পিউটার আছে এবং ৭৮ শতাংশ গ্রামীণ মানুষ এ যন্ত্র ব্যবহার করতে জানে না। 

বাংলাদেশে নারী-পুরুষের মধ্যেও ফলাফল ও সুযোগের অসমতা রয়েছে। যেমন– উচ্চতম শিক্ষাস্তরে নারীর অন্তর্ভুক্তির হার যেখানে ১৭ শতাংশ, সেখানে পুরুষদের মধ্যে সংখ্যাটি হচ্ছে ২৪ শতাংশ। দেশের শ্রমশক্তিতে পুরুষের অংশগ্রহণের হার যেখানে ৮১ শতাংশ, নারীদের মাঝে তা হচ্ছে মাত্র ৩৬ শতাংশ। জ্যেষ্ঠ এবং মধ্যম স্তরের নির্বাহীদের মাঝে নারীর অনুপাত মাত্র ১২ শতাংশ।  বাংলাদেশে মুঠোফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুরুষ-নারীর মাঝে ফারাক হচ্ছে ২৯ শতাংশ। আন্তর্যোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশের ৩৩ শতাংশ পুরুষ আন্তর্যোগ ব্যবহার করেন; নারীদের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাটি হচ্ছে ১৭ শতাংশ।
বাংলাদেশের জাতীয় আয় ৫০০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেলে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক নিয়মে দারিদ্র্য কিছুটা কমে আসবে সত্য, কিন্তু সে বৃদ্ধি দেশের দারিদ্র্যের ওপরে উল্লেখযোগ্য প্রভাব তখনই ফেলবে, যখন জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি দরিদ্রবান্ধব হয়। অন্যদিকে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি কিন্তু অসমতা বাড়িয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি দারিদ্র্য কিছুটা কমিয়ে আনতে পারে, কিন্তু সেই সঙ্গে অসমতা বেড়ে যেতে পারে। 

বাংলাদেশের জাতীয় আয় ৫০০ বিলিয়নে বৃদ্ধি দারিদ্র্য এবং অসমতা দুটোই কমিয়ে আনতে পারে, যদি জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি দারিদ্র্য এবং অসমতা হ্রাস অভিমুখীন হয়। এমন দরিদ্রবান্ধব ও সমতাবান্ধব প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে জাতীয় আয় বৃদ্ধির কিছু বৈশিষ্ট্য অপরিহার্য। যেমন– আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্র হিসেবে সেগুলোকে বেছে নিতে হবে, যেখানে দরিদ্র মানুষ বাস করে; উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পুঁজিঘন নয়, বরং শ্রমঘন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে বিশেষত মৌলিক এবং স্বাস্থ্য কাঠামোতে; উৎপাদন সম্পদ যেমন– ভূমি, উৎপাদন উপকরণ, ঋণ সুবিধা দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের কাছে লভ্য করে দিতে হবে। সেই সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার। 
জাতীয় আয়ের বৃদ্ধিকে কর্মনিয়োজনের নিরিখেও দেখা দরকার। কারণ, সেই মূল্যায়নও জাতীয় আয়ের গুণগত দিকের জন্য মূল্যবান। বাংলাদেশে শ্রমশক্তি হচ্ছে সাত কোটির মতো। তার প্রায় আড়াই কোটিই কর্মহীন। 

তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ১৮ শতাংশ। শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে কর্মহীনতার হার ২০১০ সাল থেকে হয়েছে আড়াই গুণ। গত বছর প্রায় ১ লাখ তরুণ চাকরির বাজারে যোগ দিয়েছে কাজ খোঁজার উদ্দেশ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম সনদ নিয়েও ৯ লাখ তরুণ চাকরি খুঁজছে। দেশে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে শ্রম জোগান, যা অর্থনীতি আত্মস্থ করতে পারছে না। সুতরাং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে বড়াই আমরা করেছি, তা যে ছিল এক কর্মহীন প্রবৃদ্ধি, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
এ ক্ষেত্রে তাহলে করণীয় কী? জাতীয় আয় বৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হচ্ছে, তাকে অবশ্যই কর্মবান্ধব হতে হবে। কর্মনিয়োজন বৃদ্ধি এবং গুণগত কর্ম সৃষ্টি নিশ্চিত করতে চাহিদা এবং জোগান দুই দিকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চাহিদার দিক থেকে প্রবৃদ্ধিচালিত কর্ম সৃষ্টির বদলে কর্মচালিত প্রবৃদ্ধি সৃষ্টির জন্য নীতি কৌশল গ্রহণ করতে হবে। কর্মসৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। বেসরকারি খাতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার দ্বারা সে খাতে কর্মনিয়োজনের চাহিদা বাড়ানো যেতে পারে। বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৪৪ শতাংশ এখনও কৃষি খাতে নিয়োজিত। কৃষির আধুনিকীকরণ এবং সেই সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অ-কৃষি খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে শ্রম চাহিদা সৃষ্টি সম্ভব।

দেশের বাইরে কোথায় এবং কোন খাতে তরুণদের কর্মনিয়োজনের সুযোগ আছে, সেটা নিরীক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বাংলাদেশের তরুণরা বৈশ্বিক বলয়ে প্রতিযোগিতা করবে। 
জোগানের ক্ষেত্রে শিক্ষা পাঠক্রমকে শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণের উপযোগী করে সাজানো দরকার। শুধু বর্তমান শ্রম চাহিদা নয়, ভবিষ্যৎ শ্রম চাহিদাও সেই পুনর্বিন্যাসের অংশ হওয়া প্রয়োজন। শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, বৈশ্বিকভাবেও যাতে বাংলাদেশ শ্রমের জোগান নিশ্চিত করতে পারে, তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এ জন্য দরকার হবে প্রয়োজনীয় মানব সম্পদ সৃষ্টি। যথাযথ শিক্ষা সে ব্যাপারে বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। শ্রমশক্তির পরিমাণগত বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, তাদের গুণগত দক্ষতা না বাড়াতে পারলে আজকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে তারা টিকে থাকতে পারবে না। 

আমাদের জাতীয় আয় ৫০০ বিলিয়ন বেড়ে যাবে, তা বাংলাদেশের জন্য একটি আনন্দের সংবাদ। কিন্তু নিশ্চিত করতে হবে সেই বৃদ্ধি যেন পরিবেশ-সংবেদনশীল ও পরিবেশবান্ধব হয়। আমাদের উৎপাদন কাঠামো ও উৎপাদন ব্যবস্থা প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে কুণ্ঠাহীন, নানা রকমের দূষণ সৃষ্টির ব্যাপারে বেপরোয়া এবং শিল্পবর্জ্য আমাদের নদী ও জলাশয়ে ফেলে দিতে লজ্জাহীন। সেই সঙ্গে বৃক্ষনিধন, জলাশয় ভরাট আমাদের নির্মাণ খাত ও নগরায়ণের এক বিরাট মাত্রিকতা। 

জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার জন্য একটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন কৃষির ওপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা কৃষকের আয়, জীবনযাত্রার মান এবং কুশলতাকে ক্ষুণ্ন করছে। সেই সঙ্গে লবণাক্ততা, ভূমির ক্ষয়, ভূমিশুষ্কতাও কৃষির উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিচ্ছে। জাতীয় আয় বাড়ল, কিন্তু সে বৃদ্ধি যদি উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সংবেদনশীল না হয়, তাহলে আমরা একটি অবজায়ক্ষম (অটেকসই) প্রবৃদ্ধিতে উপনীত হবো। 
এ ক্ষেত্রে যা প্রথমেই করতে হবে তা হচ্ছে, পরিবেশগত সমস্যাকে উন্নয়ন সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে এবং পরিবেশ ও উন্নয়নকে সম্পৃক্ত করতে হবে। পরিবেশের উন্নয়নগত সমস্যা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারলেই এই সম্পৃক্তকরণ সম্ভব। অর্থনৈতিক উপাত্তে পরিবেশগত তথ্যের অন্তর্ভুক্তি এর জন্য বড় প্রয়োজন। সামষ্টিক পর্যায়ে উন্নয়ন কৌশল প্রণয়নের সময়ে পরিবেশ বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। 

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের আয় এবং প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করবে, তা সুচিহ্নিত করা দরকার। সেই সঙ্গে মূল্যায়িত হতে হবে জলবায়ুর প্রভাব বাংলাদেশের কৃষি, শিল্পোৎপাদন, সেবা খাত; যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে। উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করা দরকার। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে বর্ধিত জাতীয় আয়কে পরিবেশবান্ধব করা সম্ভব।
শেষের কথা বলি। জাতীয় আয় বৃদ্ধির গুণগত দিকটি তার পরিমাণগত দিকের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। সেই গুণগত মাত্রিকতায় রয়েছে সমতা, বর্ধিত কর্মনিয়োজন এবং পরিবেশ-বন্ধুত্ব। তাই ২০২৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জাতীয় আয় ৫০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে, তাতে আমরা গর্বিত। কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা সন্তুষ্ট হবো যখন সেই বৃদ্ধি সমতাসম্পন্ন, কর্মনিয়োজনমুখী ও পরিবেশবান্ধব হয়।

সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন
কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জ ত য় আয় র ব দ ধ ল দ শ র জ ত য় আয় জ ত য় আয় ব দ ধ ন শ চ ত করত ব যবহ র কর আয় ব দ ধ র ব যবহ র ক য ব যবস থ র গ ণগত দ র পর ম ণ র জন য ব ন ম নতম ণগত দ ক দর দ র আম দ র পর ব শ জলব য় গ রহণ সরক র দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।

সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।

জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’

ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।

জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।

জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ