রাজনৈতিক সরকারের প্রতিও আস্থা তৈরি হোক
Published: 3rd, March 2025 GMT
কয়েক সপ্তাহ আগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সভা বসেছিল। মূলত এটি ছিল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র আর তার আশপাশে বসবাসকারী মানুষদের জীবন–জীবিকা নিয়ে ‘খোলা দিলে’র আলোচনা। বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের বাইরে থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা ছিলেন সেখানে। তাঁদের কেউ অ্যাকটিভিস্ট, কেউ গবেষক, কেউ বই লেখেন ইংরেজিতে, কেউ বাংলায়। আশা করা যায়, সভার রেফারেন্স থাকবে তাঁদের আগামী লেখায়, বক্তব্যে।
আয়োজকেরা পছন্দ করেন—এমন কথাই বেশি হচ্ছিল, এর মাঝে মাঠ থেকে আসা একজন ভুক্তভোগী জানালেন, ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে নানা নয়ছয় হচ্ছে। তিনি এখনো টাকা পাননি। অনেকেই সব কিস্তি পাচ্ছেন না। প্রস্তাব দিতে গিয়ে বললেন, পার্টির সরকার এলে (নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার) আর টাকা পাওয়া যাবে না, জটিলতা আরও বাড়বে। তাঁদের ভয়, পদ্মা সেতুর ক্ষতিপূরণের টাকা যেমনভাবে রাজনৈতিক দলের চ্যালা–চামুণ্ডারা ভাগজোখ করে আত্মসাৎ করেছিল, তেমন ঘটনা এখানেও ঘটবে। সেখানে অনেক দেরিতে ঘটনা জানাজানি হলে দালালদের তালিকা প্রণয়ন ছাড়া তেমন কিছু হয়নি বলে রামপাল থেকে আসা একজন জানালেন।
মনে পড়ল সেই সময় ধরা খাওয়া এক ইউপি সদস্য (সুধাংশু মণ্ডল) প্রকাশ্যে বলেছিলেন ‘কোনো জমির মালিক আছে আবার কোনো জমির মালিক নেই, এসব ফাঁকফোকর তো কানুনগো ছাড়া আর কেউ জানে না। ডিসি অফিসের এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দালাল নাসিরের সঙ্গে যোগাযোগ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি হলে হিন্দুধর্মের লোক, জেলেদের জমি হলে জেলে সম্প্রদায়ের লোক সেট করে শুধু আইডি কার্ড নিয়ে বাকি জমির সব কাগজপত্র জাল দলিল তৈরি করে ওরা ক্ষতিপূরণের টাকা উত্তোলন করেছে।’ (দৈনিক সংবাদ, ১৮ আগস্ট ২০২৩)
ইউপি সদস্য আরও জানিয়েছিলেন, নাসির চক্র প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। নাসির কাজী নাকি এসব টাকা দিয়েই কক্সবাজারে ১০ তলা হোটেল আর গুলশানে ফ্ল্যাট কেনেন। বলা বাহুল্য, ‘নাসিরদের’ সঙ্গে ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদ আর আমলাদের লেনদেনের সম্পর্ক থাকে বলেই তারা এসব আকাম করে পার পেয়ে যায়।
নির্বাচিত সরকারের প্রতি আস্থা না থাকার আরেক আলামত হচ্ছে, নানা দাবিদাওয়া নিয়ে লোকজনের হুটহাট রাস্তাঘাট–রেল যাতায়াত বন্ধ করে বসে থাকা। কেউ এ ধরনের পরিস্থিতিকে রগড় করে নাম দিয়েছেন ‘দাবির বন্যা’, কেউ বলছেন ‘দাবির সুনামি’। আঙুল তুলছেন অন্তর্বর্তীদের দিকে। বলছেন, তাদের দুর্বলতার জন্যই এসব ঘটছে। একসময় মনে হয়েছিল পাবলিক বড়ই না–সবুর। কটা দিন সবুর করলে কী হয়! ভোট করে যে সরকার আসবে, তার কাছে দাবিদাওয়া পেশ করলেই হয়। অন্তর্বর্তীকে অন্তর দিয়ে চুনকাম সংস্কারের কাজ করতে দিলে আখেরে দেশেরই লাভ।
এসব দার্শনিক বয়ান প্রতারিত আর বঞ্চিত মানুষকে কোনো ভরসা দেয় না। বঞ্চিতদের ধারণা, রাজনৈতিক সরকার পর্যন্ত অপেক্ষা করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কথিত বঞ্চনার শিকার আমলারাও এই অপেক্ষা না করার দলে। বঞ্চিত করার মেশিন তৈরি আর সেটা চালু রাখার কাজটা আমলাদের হাত দিয়েই হয়, তাই ভেতরের কলকবজা কখন কে কীভাবে বসাবে আর নাড়াবে, তার অপেক্ষায় তাঁরাও থাকতে গররাজি। তাঁরাও মনেপ্রাণে বুঝে না–বুঝে ওমর খৈয়ামের দর্শনে পরম বিশ্বাসী ‘…দূরের বাদ্য কাজ কী শুনে মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।…’
রাজনৈতিক সরকার কি সব সময় ফাঁকি দেয়অঙ্গীকার বা নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করার পরও ক্ষমতায় গিয়ে ফাঁকি দেওয়ার নজির এ দেশে কম নেই। ব্রিটিশদের হাত ধরে এ দেশে আসা কচুরিপানা ১৯২০ সালের মধ্যে প্রায় প্রতিটি নদ-নদী, খাল-বিল ছেয়ে যায়, যা সে সময় কৃষি খাতে দুর্দশা ডেকে আনে। এতে বড় ধাক্কা লাগে তৎকালীন পূর্ব বাংলার অর্থনীতিতে। ব্রিটিশ ভারতে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বাংলায় নির্বাচনে সব কটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাকে কচুরিপানামুক্ত করার অঙ্গীকার ছিল।
নির্বাচনে বিজয়ের পর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক তাঁর সরকার গঠন করেন এবং প্রথমেই ‘কচুরিপানা উৎখাত কর্মসূচি’ হাতে নেন। কুচকাওয়াজ আর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ‘কচুরিপানা সপ্তাহ’ পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যায় কচুরিপানামুক্ত করার অঙ্গীকার। এ রকম অনেক নজির দিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যায়।
দেশের মানুষ সবচেয়ে প্রতারিত হয়েছে ভূমি সংস্কার নিয়ে। পাকিস্তান আন্দোলনে এ দেশের কৃষকদের মাতার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল ভূমিস্বত্ব ফেরত পাওয়ার ওয়াদা। বলা হয়েছিল, জমিদার থাকবে না। চাষিরা তাঁদের জমি ফেরত পাবেন। অনেক গড়িমসি করে ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমিদারিপ্রথার বিলুপ্তি হয়। প্রথমে ঠিক হয়, কেউ ১০০ বিঘার বেশি জমি রাখতে পারবে না। অতিরিক্ত জমি চাষিদের মধ্যে বিলিবণ্টন হবে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের চাপে তৎকালীন সরকার নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এটিকে বাড়িয়ে ৩৭৫ বিঘা করে। একাত্তরে দেশ স্বাধীন হলে সেটি পরিবর্তন করে আবার ১০০ বিঘা করা হয়। অনেকের মনে থাকবে, ১৯৭২ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জমির সর্বোচ্চ সীমারেখার আদেশে স্বাক্ষরদানে দেরি করেছিলেন।
নিজের শত শত একর জমি নামে–বেনামে রেজিস্ট্রি হয়ে যাওয়ার পরই তিনি আদেশে সম্মতি দেন। তবে সেটিও শেষ পর্যন্ত কার্যকর করা হয়নি। এ বিষয়ে কোনো সমীক্ষাও হয়নি। ভূমি উদ্ধারও করেনি কেউ। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৪ সালে ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ করে সিলিং ৬০ বিঘা করা হয়। সেটিও কার্যকর করা হয়নি। সবশেষ ২০২৩ সালে এটি পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তন বলতে, কিছু শব্দের পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু বিষয়বস্তুর দিক থেকে কোনো ব্যাপক পরিবর্তন আসেনি। ফলে যাঁরা চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের হাতে জমি থাকছে না। অথচ দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশের বেশি নিয়োজিত আছে কৃষি খাতে। কৃষিকাজে নিয়োজিতদের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ। তাঁদের বেশির ভাগ কৃষকের জমি নেই, আগে তাঁরা জমি বর্গা নিয়ে আবাদ করতেন। এখন আগাম টাকা দিয়ে মাত্র এক বছর চাষবাসের অনুমতি পান। রাজনৈতিক দলগুলো মুখে বলে কৃষক জাতির মেরুদণ্ড আর কাজের সময় অষ্টরম্ভা।
এসব নানা বঞ্চনা আর প্রতারণার কারণে মানুষের মনে রাজনৈতিক সরকারের প্রতি এক অপরিসীম অনাস্থা দানা বেঁধে উঠেছে। রাজনীতির প্রতি, রাজনৈতিক সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। মানুষকে মার্কার গোলাম ভাবার কোনো কারণ নেই। এটা রাজনীতিবিদেরা যত তাড়াতাড়ি ঠাহর করতে পারবেন, ততই তাঁদের মঙ্গল, দেশের শান্তি।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
কাশ্মীর ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘নয়া মানুষ’
নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রান্তিক চরের মানুষের জীবনযাপন, মানবিকতা ও ধর্মীয় সহাবস্থানের চিত্র নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘নয়া মানুষ’। প্রশংসিত এই চলচ্চিত্র জায়গা করে নিয়েছে ‘কাশ্মীর ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এর পঞ্চম আসরে। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগরে আজ থেকে শুরু হওয়া এই উৎসবে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশের এই আলোচিত চলচ্চিত্রটি।
৭ দিনব্যাপী এ উৎসবে মিসর, জার্মানি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান ও ভারতের নির্বাচিত চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রদর্শিত হবে ‘নয়া মানুষ’, যা বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিচ্ছে উৎসবে।
আরো পড়ুন:
দুই গায়িকার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, দ্বন্দ্ব চরমে
সমালোচনা নিয়ে মুখ খুললেন ভাবনা
২০২৪ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়া ‘নয়া মানুষ’ দর্শক ও সমালোচকদের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়ায়। আ. মা. ম. হাসানুজ্জমানের লেখা ‘বেদনার বালুচরে’ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রটির সংলাপ ও চিত্রনাট্য লিখেন মাসুম রেজা।
চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছেন রওনক হাসান, মৌসুমী হামিদ, আশীষ খন্দকার, ঝুনা চৌধুরী, শিখা কর্মকার, নিলুফার ওয়াহিদ, বদরুদ্দোজা, মাহিন রহমান, নাজমুল হোসেন, স্মরণ সাহা, সানজানা মেহরান ও শিশুশিল্পী ঊষশী।
উৎসবে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে গল্পকার ও অভিনেতা আ. মা. ম. হাসানুজ্জমান বলেন, “আমি যখন গল্পটি লিখি, তখন এত কিছু ভাবিনি। কিন্তু চলচ্চিত্রটি দর্শক দেখার পর যে ভালোবাসা পাচ্ছি, তা সত্যিই অকল্পনীয়। ‘নয়া মানুষ’ ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করছে, শান্তির বার্তা দিচ্ছে, ধর্মের প্রকৃত দর্শন তুলে ধরছে—এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।”
চলচ্চিত্রটির নির্মাতা সোহেল রানা বয়াতি বলেন, “আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘নয়া মানুষ’ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশ নিচ্ছে—এটা আমার জন্য গর্বের বিষয়। কাশ্মীর ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ‘নয়া মানুষ’ অংশ নিচ্ছে, যা দেশের চলচ্চিত্রের জন্যও একটি বড় সাফল্য।”
চাঁদপুরের দুর্গম কানুদীর চরে চিত্রগ্রহণ করা হয়েছে চলচ্চিত্রটির। চিত্রগ্রহণ পরিচালনা করেছেন কমল চন্দ্র দাস। সিনেমাটির সংগীতে কণ্ঠ দিয়েছেন বাউল শফি মণ্ডল, চন্দনা মজুমদার, বেলাল খান, অনিমেষ রয়, মাসা ইসলাম ও খাইরুল ওয়াসী। সংগীত পরিচালনা করেছেন ইমন চৌধুরী, মুশফিক লিটু ও শোভন রয়।
মানবতার বার্তা, ধর্মীয় সহনশীলতা ও জীবনবোধের অনন্য মেলবন্ধন নিয়ে ‘নয়া মানুষ’ এবার বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছে দিচ্ছে শান্তি ও সহমর্মিতার বার্তা।
ঢাকা/রাহাত/শান্ত