জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেছেন, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল ক্রমবর্ধমানভাবে যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ব্যবহার করছে। তারা মাতৃত্বকালীন ও প্রজননস্বাস্থ্যসেবার কেন্দ্রগুলো পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে ‘জাতিহত্যামূলক কর্মকাণ্ড’ চালাচ্ছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ গঠিত একটি তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এসব অভিযোগ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলাকে কেন্দ্র করে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর উপত্যকাটির পাশাপাশি অধিকৃত পশ্চিম তীরে ধর্ষণসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, গাজায় বিভিন্ন প্রসূতি ওয়ার্ড ধ্বংস করা হয়েছে। একটি প্রজননস্বাস্থ্যসেবার কেন্দ্রে ভ্রূণ ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছে। এগুলো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্ম রোধ করার কৌশল নির্দেশ করতে পারে। আর আইনগত সংজ্ঞায় এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে জাতিহত্যা বলে।

ইসরায়েল এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে তা নাকচ করেছে।

প্রতিবেদনটির বিষয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদকে একটি ইহুদিবিদ্বেষী, পচা, সন্ত্রাসবাদের সমর্থক ও অপ্রাসঙ্গিক সংস্থা হিসেবে অভিহিত করেছেন।

নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাস সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের দিকে নজর না দিয়ে জাতিসংঘের সংস্থাটি ‘মিথ্যা অভিযোগে’ ইসরায়েলকে আক্রমণ করছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ২০২১ সালে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড বিষয়ে স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য ছিল, আন্তর্জাতিক মানবিক ও মানবাধিকার আইনের সব ধরনের লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করা। কমিশনের সদস্যসংখ্যা তিন।

কমিশন বলেছে, যৌন ও প্রজননসংক্রান্ত সহিংসতার শিকার মানুষ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে তাদের নতুন প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে জেনেভায় অনুষ্ঠিত দুই দিনের গণশুনানিতে কথা বলেছেন। এ ছাড়া যাচাই–বাছাই করা ছবি-ভিডিও ফুটেজ, নাগরিকসমাজ ও নারী অধিকারবিষয়ক সংস্থাগুলোর তথ্যের আলোকে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

জাতিসংঘের সাবেক মানবাধিকারপ্রধান নাভি পিল্লাই কমিশনের নেতৃত্ব দেন। তিনি বলেন, যে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ হয়েছে, তাতে দেখা গেছে, যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঘটনা শোচনীয়ভাবে বেড়েছে।

নাভি পিল্লাইয়ের মতে, ফিলিস্তিনিদের ভয় দেখাতে, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ক্ষুণ্ন করতে ইসরায়েল এসব কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।

প্রতিবেদনে যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ধরনগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো জোরপূর্বক জনসমক্ষে পোশাক খুলে ফেলা, নগ্নতা, ধর্ষণের হুমকিসহ যৌন হয়রানি। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী এসব পদ্ধতি ব্যবহার করে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ধর্ষণসহ অন্যান্য যৌন সহিংসতা ইসরায়েলের শীর্ষ বেসামরিক ও সামরিক নেতৃত্বের স্পষ্ট আদেশে অথবা পরোক্ষ উৎসাহে সংঘটিত হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় ১৭ মাসের যুদ্ধে সেখানকার যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য–সংক্রান্ত সেবাকেন্দ্রগুলো পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। যথাযথ সেবা না পাওয়ার কারণে গর্ভাবস্থায় বা সন্তান প্রসবের সময় বিভিন্ন জটিলতায় ফিলিস্তিনি নারীরা মারা যাচ্ছেন। এগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধের সমতুল্য বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েলে হামলা চালায়। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ নিহত হন। ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচারে হামলা শুরু করে ইসরায়েল।

হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, ইসরায়েলের হামলায় ৪৮ হাজার ৫২০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার বাসিন্দাদের বেশির ভাগকেই বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। সেখানকার প্রায় ৭০ শতাংশ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যসেবা, পানি, পয়োনিষ্কাশনসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ ও আশ্রয়ের সংকট তৈরি হয়েছে। গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। প্রথম ধাপের এই যুদ্ধবিরতি ১ মার্চ শেষ হয়। দ্বিতীয় ধাপের বিষয়ে আলোচনা চলছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা

রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।

এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”

আরো পড়ুন:

ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত

ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত

উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”

সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”

এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।

বিবৃতিতে  বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে। 

ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।

ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।

ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।

এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ