ডিসি–ইউএনও–এসি ল্যান্ডরা কি পারবে নদীর সুরক্ষা দিতে
Published: 14th, March 2025 GMT
বাংলাদেশে এমন একজন ডিসি পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ, যিনি তাঁর কর্মজেলার সব নদীর নাম বলতে পারবেন। একজন ডিসি তাঁর মেয়াদকালে সব কটি নদীর পাড়ে অন্তত একবার করে গেছেন, এমনটি শোনা যায়নি। ডিসিদের মধ্যে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যিনি নিজ কর্মজেলার সব নদীর সুনির্দিষ্ট সংকটের কথা বলতে পারবেন। তাঁরা প্রশাসনিক নিজ জেলার নদীগুলোর উৎসস্থল কিংবা পতিতস্থলও বলতে পারবেন না।
জেলার অভ্যন্তরে নদীর মোট কত অংশ কবুলিয়াত দেওয়া হয়েছে কিংবা বদ্ধ জলাশয় ঘোষণা করা হয়েছে কিংবা ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়া হয়েছে, সেই তথ্যও কোনো ডিসি জানেন না। এমন কোনো জেলা নেই, যে জেলায় নদী ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়া হয়নি, প্রবহমান নদীকে বদ্ধ জলাশয় দেখানো হয়নি। নদীর সর্বনাশের সঙ্গে জড়িত কোনো কর্মকর্তা নেই, এমন জেলা পাওয়া অসম্ভব। মোটের ওপর বলা যায়, যাঁদের ওপর নদীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁরা নদীর কোনো খবরই রাখেন না।
আমাদের দেশের নদীগুলো রক্ষায় নতুন ব্যবস্থাপনার কথা ভাবতে হবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনগতভাবে নদীর অভিভাবক ঘোষণা করা হলেও তার আইনি কাঠামো দুর্বল হওয়ার কারণে এখন এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বিদ্যমান অবস্থায় নদীর সুরক্ষা সম্ভব নয়। সে জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের আইন সংশোধন করতে হবে। আপাতত প্রতি বিভাগে এ কমিশনের কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনতা থেকে এ কমিশনকে স্বাধীনতা দিতে হবে। দখল-দূষণ থেকে নদী রক্ষায় এ কমিশনের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেসি প্রয়োগের ক্ষমতা থাকতে হবে।জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বছর দুয়েক আগে একবার নদীর সংখ্যা নিরূপণ করেছে। তখন ডিসি-ইউএনওদের মাধ্যমে নদীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। ডিসিরা তখন সব তথ্য দিতে পারেননি। যেটুকু দিয়েছেন, তা–ও ভুলে ভরা। ভাবতে অবাক লাগে, নদীর প্রকৃত দেখভালের দায়িত্ব যাঁদের ওপর ন্যস্ত, তাঁরা নদীর জন্য একটি ফাইল প্রস্তুত করেননি, যে ফাইল দেখে জেলার সব নদীর তথ্য দেওয়া যাবে। একটি প্রধান ফাইল প্রস্তুত করে নদীভিত্তিক আলাদা তথ্য সংগ্রহ করতে একটি জেলায় সাত দিনের বেশি লাগার কারণ নেই। সহজ এ কাজ কখনোই করা হয়নি। এর প্রধানতম কারণ নদীকে গুরুত্ব না দেওয়া।
রংপুর অঞ্চলের খটখটিয়া, শালমারা, ঘাঘট, কুমলাই, স্বরমঙ্গলা, বুড়াইলসহ অনেক নদীর অনেকাংশ ব্যক্তির নামে লিখিত হয়েছে। তিস্তা নদীর মূল প্রবাহ ব্যক্তির নামে সম্প্রতি লিখে দেওয়া হয়েছে। এসব লিখে দেওয়ার সঙ্গে ডিসি, ইউএনও, এসি ল্যান্ডরা জড়িত। এঁদের হাতেই নদী রক্ষার দায়িত্ব হওয়া সত্ত্বেও এঁরাই কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষভাবে নদীর ক্ষতিসাধনে জড়িত থাকেন। বর্তমানে যাঁরা এসব পদে আছেন, তাঁরা হয়তো জড়িত নন। জড়িত আগেকার কোনো কোনো কর্মকর্তা। কিন্তু বর্তমানে যাঁরা ডিসি, ইউএনও, এসি ল্যান্ড আছেন; তাঁরা এগুলো মুক্ত করবেন না বলেই ধরে নেওয়া যায়। এটাই অভিজ্ঞতা। এরকমটাই এতকাল ধরে দেখে আসছি।
আরও পড়ুননদী রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের যা করা প্রয়োজন০২ জানুয়ারি ২০২৫দেশের অসংখ্য নদী আছে, যেগুলো ব্যক্তির নামে কবুলিয়াত দেওয়া হয়েছে। নদী কবুলিয়াত দেওয়া বেআইনি। পূর্বেকার কোনো কর্মকর্তা কবুলিয়াত দিলেও পরবর্তী কোনো কর্মকর্তা এসে তা আর বাতিল করেন না। আমাদের অনেক নদীকে বদ্ধ জলাশয় দেখিয়ে অনেক ইউএনও, ডিসি লিজ দেন। একবার কেউ লিজ দিতে শুরু করলেও পরবর্তী আর কোনো কর্মকর্তা এসে তা ফেরানোর চেষ্টা করেন না।
ডিসিরা জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি এবং ইউএনওরা উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি। মাঠপর্যায়ে নদীর আন্দোলন করতে গিয়ে ডিসি এবং ইউএনওদের মাধ্যমে নদী উদ্ধারের চেষ্টা করেছি। তাঁরা তেমন সচেষ্ট থাকেন না। এসব কর্মকর্তার কাছে নদী একটি গৌণ বিষয়। নদী দখল হোক, নদী থেকে বালু উত্তোলন হোক, নদী কবুলিয়াত হোক, নদীকে বদ্ধ জলাশয় ঘোষণা করা হোক কিংবা নদী ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়া হোক, এতে তাঁদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। নদী ছাড়াও তাঁদের আরও অনেক কাজ আছে। সেসব নিয়ে তাঁরা ব্যস্ত থাকেন। অধিকাংশ সময়ে তাঁরা নদী ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়া কিংবা লিজ দেওয়ার কাজে যতটা সক্রিয় থাকেন, উদ্ধারের কাজে ততটা নয়।
আমি প্রায় অর্ধযুগ থেকে রংপুর জেলা নদী রক্ষা কমিটির সদস্য। প্রতি মাসে একটি করে সভা হয়। এসব সভার প্রায় প্রতিটিতেই ইউএনওদের প্রতি নদী রক্ষার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো সভায় পূর্ববর্তী সভার নির্দেশনা অনুযায়ী কী কাজ হলো, তা আর দেখা হয় না। ছয় বছর আগে নদী সুরক্ষায় যে দাবি উত্থাপন করেছি, এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, এমনটাও আছে। একজন নদীসংগঠক হিসেবে লেগে থেকেও নদী রক্ষায় ডিসিদের দিয়ে নদী মুক্ত করার কাজ সম্পূর্ণরূপে করা সম্ভব হয়নি। তাহলে যেসব জেলায় নদীর সংকট আলাদাভাবে তুলে ধরার কেউ নেই ,সেসব জেলার অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার কথা।
জেলা নদী রক্ষা কমিটিতে থেকে যে একবারেই কিছু হয়নি তা নয়, সভাগুলোতে বারবার বলার কারণে বুড়াইল নদীর ২৮টি বাঁধ অপসারণ করা হয়েছে, শালমারা এবং খটখটিয়া নদীর অবৈধ মালিকানা বাতিল করা হয়েছে। আরও ছোট ছোট অনেক কাজ করা সম্ভব হয়েছে। নতুন দখল রোধ করা গেছে। কখনো কখনো বালু উত্তোলন বন্ধ করা গেছে।
ডিসিদের যত কাজই থাকুক না কেন, নদী রক্ষা তাঁর অন্যতম কাজ। ১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যত ভূমি আইন আছে, সব কটিতেই নদী দেখভাল করার দায়িত্ব এসব কর্মকর্তার। অথচ ডিসি, ইউএনও, এসি ল্যান্ড দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমাদের নদীগুলো ধ্বংস করার প্রধানতম কর্মকর্তা বলা যায়।
গণহারে নদীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সব কর্মকর্তার কাঁধে দোষ দেওয়া সমীচীন হবে না। যদি এমন কোনো কর্মকর্তা থেকে থাকেন, যিনি নদী সুরক্ষায় সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করেছেন, তাহলে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। তবে এ রকম দুর্লভ দৃষ্টান্ত দিয়ে আমাদের নদীগুলো রক্ষা করা সম্ভব হবে না। ডিসিদের ব্যক্তিবিশেষে ব্যর্থতা নয়; সামষ্টিক বিবেচনায় ডিসি, ইউএনও কিংবা এসি ল্যান্ডরা ব্যর্থ।
আমাদের দেশের নদীগুলো রক্ষায় নতুন ব্যবস্থাপনার কথা ভাবতে হবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনগতভাবে নদীর অভিভাবক ঘোষণা করা হলেও তার আইনি কাঠামো দুর্বল হওয়ার কারণে এখন এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বিদ্যমান অবস্থায় নদীর সুরক্ষা সম্ভব নয়। সে জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের আইন সংশোধন করতে হবে। আপাতত প্রতি বিভাগে এ কমিশনের কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনতা থেকে এ কমিশনকে স্বাধীনতা দিতে হবে। দখল-দূষণ থেকে নদী রক্ষায় এ কমিশনের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেসি প্রয়োগের ক্ষমতা থাকতে হবে।
আর যদি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ডিসি, ইউএনও এবং এসি ল্যান্ডের ওপরই থাকে, তাহলে নদী যেভাবে ধ্বংস হচ্ছে, তা আরও ত্বরান্বিত হবে। যত দিন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে শক্তিশালী করা হবে না, তত দিন এসব কর্মকর্তাদের জবাবদিহি এবং নদীর ক্ষতি করলে তাঁদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদীরক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র নদ গ ল জ ত য় নদ নদ র স আম দ র হওয় র একব র র আইন
এছাড়াও পড়ুন:
আ.লীগ নেতাকে নিয়ে মানববন্ধন করে ইউএনওকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যা
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকে নিয়ে মানববন্ধন করা হয়েছে।
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় উপজেলার তাহেরপুর পৌরসভার হরিতলা মোড়ে আয়োজিত মানববন্ধন থেকে ইউএনওর অপসারণের দাবি জানানো হয়।
এলাকার সচেতন নাগরিক, ব্যবসায়ী মহল, অভিভাবক, ছাত্রছাত্রী, কর্মচারী-শিক্ষকমণ্ডলীর ব্যানারে এ মানববন্ধন করা হয়। এতে এলাকাবাসী ছাড়া তাহেরপুর কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। মানববন্ধন থেকে কলেজের সম্পত্তি অন্যত্র ইজারা দেওয়ার চেষ্টার প্রতিবাদ জানানো হয়।
তাহেরপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে মানববন্ধন করা হয়। পৌরসভার নির্মিত দোকানঘর থেকে তাহেরপুর কলেজ কর্তৃপক্ষের ভাড়া আদায় বন্ধ করে দেওয়ায় এ কর্মসূচি পালন করা হয় বলে অভিযোগ। আওয়ামী লীগের নেতার দাবি, তিনি দলীয় পরিচয়ে নয়, কলেজশিক্ষক হিসেবে মানববন্ধনে যোগ দিয়েছেন। তবে ব্যানারে ফ্যাসিবাদ শব্দটি প্রথমে দেখেননি। পরে দেখেছেন।
মানববন্ধনে তাহেরপুর কলেজের শিক্ষক রইচ আহমেদ, সুরাইয়া আক্তার, তাহেরপুর পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ইসমাইল হোসেন প্রমুখ বক্তব্য দেন। বক্তারা বাগমারার ইউএনওকে ফ্যাসিবাদের দোসর ও চব্বিশের চেতনাবিরোধী অভিযোগ তুলে তাঁদের ভাড়া আদায় বন্ধ করে দেওয়ার নিন্দা জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাহেরপুর কলেজ–সংলগ্ন স্থানে পৌর কর্তৃপক্ষ দোকানঘর নির্মাণ করেছে। পৌরসভার পক্ষে নিয়মিত ভাড়া আদায় করা হয় ওই প্রতিষ্ঠান থেকে। ৫ আগস্টের পর থেকে কলেজের পক্ষ থেকে ৪১টি দোকানঘর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেগুলো থেকে ভাড়া আদায় করা হয়।
পৌরসভার প্রশাসক হিসেবে বাগমারার ইউএনও দোকানঘর থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষের ভাড়া আদায় বন্ধ করে দেন। দোকানঘরগুলো পৌরসভার হওয়ায় তারাই সেখান থেকে ভাড়া আদায় করবে বলে জানানো হয়। সেখান থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষ আর ভাডা আদায় করবে না জানিয়ে ২২ এপ্রিল পৌরসভার প্রশাসককে লিখিতভাবে জানান কলেজের অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম। এর পর থেকে কর্তৃপক্ষ ইউএনওর ওপর ক্ষুব্ধ হয়।
তাহেরপুর কলেজের সহকারী অধ্যাপক সুরাইয়া আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, কলেজের জায়গায় তাহেরপুর পৌরসভার সাবেক মেয়ব ও সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ দোকানঘর নির্মাণ করে মোটা অঙ্কের টাকায় ভাড়া দেন। ৫ আগস্টের পর তাঁরা (কলেজ কর্তৃপক্ষ) সেগুলো নিয়ন্ত্রণে নেন। তবে ২২ এপ্রিল ইউএনও সাদা কাগজে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কাছ থেকে ভাড়া আদায় বিষয়ে একটি লিখিত নিয়েছেন। এর প্রতিবাদে মূলত তাঁদের এই কর্মসূচি।
পৌরসভার দোকানঘর থেকে কেন পৌরসভা ভাড়া আদায় করবে না জানতে চাইলে সুরাইয়া আক্তার বলেন, ‘জায়গাগুলো কলেজের ছিল।’ ব্যানারে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখা হলেও কেন আওয়ামী লীগের নেতাকে নিয়ে মানববন্ধন করলেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কলেজের স্বার্থে আমরা এক।’
জানতে চাইলে ইউএনও মাহাবুবুল ইসলাম বলেন, দোকানগুলো তাহেরপুর পৌরসভার। সেগুলো থেকে ভাড়া আদায় করে পৌরসভার কোষাগারে জমা করা হয়। তিনি প্রশাসক হিসেবে ভাড়া আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছেন। কলেজের অধ্যক্ষ নিজেই জানিয়েছেন, এখন থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষ ভাড়া আদায় করবে না।