প্রান্তিক মানুষের কাছে সেবা পৌঁছাতে চায় ঢাকা ব্যাংক
Published: 14th, March 2025 GMT
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে গত অক্টোবরে দায়িত্ব নিয়েছেন শেখ মোহাম্মদ মারুফ। এর আগে তিনি সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত এমডি ছিলেন। ঢাকা ব্যাংকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ ব্যাংক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহাদাৎ তনিম।
সমকাল: আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকে চাকরি শুরু করেছিলেন। সেখান থেকে ইস্টার্ন ব্যাংক, সিটি ব্যাংক হয়ে এখন আপনি ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। দীর্ঘ এই ব্যাংকিং ক্যারিয়ার নিয়ে জানতে চাই।
শেখ মোহাম্মদ মারুফ: আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করেছি। সাধারণত কমার্স বিভাগ থেকে যারা পড়াশোনা করেন তাদের স্বপ্ন থাকে ব্যাংকে কাজ করার। আমার বড় ভাই আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকে কাজ করতেন। মূলত তাঁকে দেখেই ব্যাংকে কাজের আগ্রহটা প্রবলভাবে আসে। ১০ বছর বিদেশি ব্যাংকে কাজ করার পর দেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো কীভাবে অপারেট হয় তা নিয়ে কাজ করার বিষয়ে আগ্রহী হই। ২০০৫ সালের শেষের দিকে আমি ইস্টার্ন ব্যাংকে যোগ দিই। অল্প কিছুদিন কাজ করার পর ২০০৭ সালের দিকে সিটি ব্যাংক থেকে অফার পাই। তবে আমার দীর্ঘ ২৭ বছরের চাকরি জীবনের বেস্ট অর্গানাইজেশন ছিল আমেরিকান এক্সপ্রেস।
সমকাল: দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি খাতে মোট ৬১টি ব্যাংক রয়েছে। এতো ব্যাংকের মধ্যে গ্রাহক আপনাদের আলাদা করবে কীভাবে?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ: ঢাকা ব্যাংকের নামে কখনও খারাপ সংবাদ পাবেন না। এটিই একটি শক্তশালী দিক এই ব্যাংকের। ঢাকা ব্যাংক হলো ধীরগতির ক্রমবর্ধমান ব্যাংক। আমাদের করপোরেট ব্যাংকিং অনেক শক্তিশালী। ঢাকা ব্যাংক সেকেন্ড জেনারেশনের প্রথম সারির ব্যাংক, যারা গত ৩০ বছর ধরে ক্রমবর্ধমানভাবে সেবা দিয়ে আসছে। অনলাইন ব্যাংকিং, ডিজিটাল লোন, ডিজিটাল ডিপোজিট স্কিম রয়েছে আমাদের। এছাড়া আমাদের ক্রেডিট কার্ড সেবার মান বাজারের সেরা।
সমকাল: ব্যাংক খাতে এখন তারল্য সংকট চলছে। এর মধ্যেও গত অক্টোবরে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংকে তহবিল সহায়তা দিয়েছে ঢাকা ব্যাংক। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এই শক্তি অর্জন কীভাবে সম্ভব হয়েছে?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ: প্রথমত, গ্রাহকের আস্থা রয়েছে আমাদের ওপর। দ্বিতীয়ত, আমাদের পরিচালনা পর্ষদ এবং ম্যানেজমেন্ট অনেক শক্তিশালী। তারা আমাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেন। বাংলাদেশের মতো ইকোনমিতে কোনো ব্যাংক ফেইল করা সামগ্রিক অর্থনীতিতে একবারেই ভালো কিছু না। আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী আমরা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করেছি। আমরা চাই আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক, গ্রাহকের আস্থা বাড়ুক।
সমকাল: ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে দেশে ডলার সংকট চলছে। আইএমএফের শর্ত মেনে ডলার দর নির্ধারণ পদ্ধতি কিছুটা বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। এরপরও কি ডলার সংকট পুরোপুরি সমাধান হয়েছে বলে মনে করেন?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ: ডলারের অবস্থা আগের থেকে অনেকটা উন্নতি হয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেক বেড়েছে। এটি সামনে আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। তবে দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে অবকাঠামো খাতের বিনিয়োগে কিছুটা স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক হওয়া উচিত। বিনিয়োগ বাড়লে আমদানি বাড়বে, ফলে ডলারের চাহিদা আবার বাড়বে।
সমকাল: ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা উচ্চ খেলাপি ঋণ। এ সমস্যার সমাধানে কী করা উচিত?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ: প্রথমে আর্থিক খাতে সুশাসন আনতে হবে। ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপির কারণে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা স্বীকার করতে হবে। এ জাতীয় ঘটনা সামনে যেন আর না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কোথায় কোন ব্যাংক কীভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। কাজ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা আনতে হবে। সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব।
সমকাল: দুর্বল ব্যাংকগুলো নিয়ে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ: প্রথমেই খুঁজে বের করতে হবে এই দুর্বল ব্যাংকগুলোর ক্ষতটা কতটুকু গভীর। ক্ষত অনুযায়ী প্রতিকারমূলক পরিকল্পনা নেওয়া উচিত। আমাদের এমন কোনো কাজ করা উচিত হবে না, যেখানে ডিপজিটররা ক্ষতিগ্রস্ত হন। গ্রাহকদেরও সচেতন হতে হবে। মুনাফা দেখে নয়, ব্যাংকের মূল ভিত্তি, ম্যানেজমেন্ট দেখে টাকা রাখা উচিত। সঠিক পরিচালনা, কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও সরকারি তারল্যসহায়তার মাধ্যমে সামলানো সম্ভব।
সমকাল: ঢাকা ব্যাংকের আগামী দিনের পরিকল্পনা জানতে চাই
শেখ মোহাম্মদ মারুফ: ঢাকা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ খুবই দূরদর্শী। যার ফলে ব্যাংকটি ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। আমাদের
জনবল দক্ষ, অপ্রয়োজনীয় জনবল নেই। এখন পরবর্তী ধাপে যেতে হলে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রয়োজন, যা আমরা পেয়েছি। আমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছাতে চাই। দেশের ও গ্রাহকদের প্রয়োজন অনুযায়ী করপোরেট ঋণ আগের মতোই
থাকবে। এর পাশাপাশি খুচরা ঋণ, এসএমই, কৃষিঋণ ও ক্রেডিট কার্ড খাতে আরও মনোযোগ দেওয়া হবে। এসব ঋণের প্রবাহ ও বিতরণ যুগোপযোগী করা হবে। আমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে চাই, যাতে কম খরচে বেশি মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। আমরা শুধু মুনাফার দিকে তাকাচ্ছি না, মূলধন শক্তিশালী করার দিকেও নজর দিচ্ছি। আমরা দক্ষ জনবল নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে চাই, যা বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের আর্থিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ খ ম হ ম মদ ম র ফ দ র বল ব য ক জ কর র পর চ ল আম দ র সরক র সমক ল
এছাড়াও পড়ুন:
আউটসোর্সিং এবং শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন
আধুনিক শ্রমবাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তৃত খাত হলো আউটসোর্সিং। এ খাতের মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক প্রতিদিন সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। অথচ এই শ্রমিকদের অধিকাংশই শোভন কাজের মৌলিক মানদণ্ড থেকে বঞ্চিত। চাকরির স্থায়িত্ব নেই; সুরক্ষার নিশ্চয়তা নেই; নেই সংগঠনের অধিকার– এমন বাস্তবতায় শ্রমিকরা এক অনিশ্চিত ও অনুৎপাদনশীল পরিবেশে দিন কাটাচ্ছেন।
এ প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি শ্রম সংস্কার কমিশন সরকারের কাছে ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা: শ্রমিক-অধিকার, সুসমন্বিত শিল্প-সম্পর্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি সুপরিকল্পিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনের বিভিন্ন অধ্যায়ে কাজের স্বীকৃতি, অধিকার, নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব নিয়ে যেসব সুপারিশ রাখা হয়েছে, তার মধ্যে আউটসোর্সিং খাতে নিযুক্ত শ্রমিকদের নিয়ে তৎপরতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে সরকারের রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত ১২৫০টি ঠিকাদারি সংস্থা জনবল সরবরাহ করছে। এর বাইরেও অগণিত অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকরা কর্মঘণ্টা, মজুরি, ছুটি, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার।
অধিকাংশ আউটসোর্সিং শ্রমিক ন্যূনতম মজুরি পান না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার নির্ধারিত মজুরি না দিয়ে বেতন থেকে অবৈধভাবে টাকা কেটে রাখে; উৎসব ভাতা দেয় না; ওভারটাইমের ভাতা দেয় না। সাম্প্রতিক ২০২৫ সালের আউটসোর্সিং নীতিমালায় উৎসব ভাতা ও বৈশাখী ভাতা অন্তর্ভুক্তিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলা যায়, তবে বাস্তবায়ন ও নজরদারি এখনও দুর্বল।
নীতিমালায় নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি সংক্রান্ত কোনো অর্থনৈতিক সুরক্ষা না থাকায় তারা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে অন্তঃসত্ত্বা হলেই চাকরিচ্যুতির শঙ্কা থাকে। বেসরকারি খাতে এ অবস্থা আরও ভয়াবহ। নতুন নীতিমালায় ৪৫ দিনের প্রসূতিকালীন ছুটি সংযুক্ত করা হয়েছে, যা বিদ্যমান শ্রম আইনের ১১২ দিনের বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আউটসোর্সিং শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার পথ রুদ্ধ। তারা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন না। করলে চাকরিচ্যুতির শিকার হন। ফলে শ্রমিকস্বার্থে কোনো সামাজিক সংলাপ বা দরকষাকষির সুযোগ থাকে না।
বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্য, ওয়াসা, নিরাপত্তা খাতে কর্মরত হাজার হাজার আউটসোর্সিং শ্রমিক পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। করোনা মহামারিতে তারা সম্মুখ সারিতে থেকেও কোনো রকম ক্ষতিপূরণ পাননি। শ্রম বিধিমালার ১৬(৩) অনুযায়ী মালিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ দুর্বল।
সে জন্য শ্রম সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে আউটসোর্সিং শ্রমিকদের জন্য যেসব সুপারিশ করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে এ খাতে শোভন কাজের নিশ্চয়তা আসবে। আউটসোর্সিং খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের শোভন কাজ, মৌলিক অধিকার এবং কর্মস্থলে সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
আমি মনে করি, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, করপোরেশন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ করতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থায়ী জনবল কাঠামো হালনাগাদ করে আইনের ধারা ও বিধি অনুসরণপূর্বক প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা দরকার। ঠিকাদারের মাধ্যমে সার্ভিস চার্জ বা কমিশনের ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সরাসরি নিয়োগ প্রদান নিশ্চিত করা দরকার। যারা ৫-১০ বছর বা তদূর্ধ্ব সময় ধরে কর্মরত থেকে দক্ষতা অর্জন করেছেন, তাদের শ্রম আইন অনুযায়ী অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মূল মালিককে দায়বদ্ধ করা দরকার।
শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত কাজ করতে রাজি না হলে তাদের চাকরিচ্যুত বা ভয়ভীতি প্রদর্শন করা যাবে না। এ বিষয়ে শ্রম পরিদর্শন দপ্তর কঠোর নজরদারি করবে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, দপ্তর ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আউটসোর্সিং বন্ধ করতে হবে। যেসব দপ্তর ও সেবা খাতে ইতোমধ্যে আউটসোর্সিং করা হয়েছে, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে স্থায়ী নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যাশা একটাই– শোভন কাজের বাস্তবায়ন। এ খাতের বৈষম্য কমাতে হলে সরকারের নীতিগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপ দরকার। একই সঙ্গে সমাজকেও সচেতন হতে হবে, যাতে মানুষ সস্তা সেবার পেছনে শ্রমের শোষণকে গুরুত্ব দিতে শেখে।
মো. মাছুম বিল্লাহ: আইন কর্মকর্তা, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর