বিএনপি সরকার গঠন করবে, বিরোধী দলে এনসিপি: সারোয়ার তুষার
Published: 15th, March 2025 GMT
আগামী নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করবে আর জাতীয় নাগরিক পার্টি বিরোধী দল হিসেবে সরকারে থাকবে বলে মনে করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে তাদের দল ৩০-৩৫ শতাংশ ভোট টানতে পারে বলে মনে করছেন।
আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিডিবিএল ভবনে এক গোলটেবিল আলোচনা সভায় সারোয়ার তুষার এসব কথা বলেন। ‘পিপলস ইলেকশন পালস’ শীর্ষক এ আলোচনা সভায় একটি জরিপের ফলাফলও তুলে ধরা হয়। জরিপটি করেছে ইনোভিশন নামের একটি বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। আর এই কাজে সহযোগিতা করেছে ব্রেইন ও ভয়েস ফর রিফর্ম।
আলোচনা সভায় জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, এবারের নির্বাচন খুবই ইন্টারেস্টিং হতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘অবভিয়াসলি (স্পষ্টত), এখনো যা সিচুয়েশন (পরিস্থিতি), এক বছরের মধ্যে আমি মনে করি যে বিএনপি গভর্নমেন্ট ফরম করবে এবং আমাদের জন্য বিরোধী দল হওয়াটাই ভালো। বিরোধী দল আসলে ক্যারেক্টার তৈরি করে দলের। আমি দেখতে চাই, দলটা বিরোধী দলে যাক। বিএনপি সরকারে যাক, আমরা বিরোধী দলে যাই।’
সারোয়ার তুষার বলেন, জাতীয় নাগরিক পার্টির কিছু সদস্য সংসদে থাকুক, আর বাইরে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবেও তাঁরা থাকবেন। এটা তাঁর ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা।
সামনে রোমাঞ্চকর সময় আসছে উল্লেখ করে সারোয়ার তুষার বলেন, সেটা যেন রাজনৈতিক হানাহানির পর্যায়ে না যাই। প্রতিযোগিতাটা যেন একটা ডিসেন্ট (ভদ্রতার) পর্যায়ে থাকে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি আগামী নির্বাচনে ৩০–৩৫ শতাংশ ভোট টানতে পারে বলে মনে করেন সারোয়ার তুষার। তাঁর দাবি, জামায়াতে ইসলামীর চেয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির ভোট অবশ্যই বেশি হবে।
জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তা বাড়ছে, এটা ঠিক উল্লেখ করে সারোয়ার তুষার বলেন, দেশে যে ধরনের পরিস্থিতি আছে, ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে এ রকম পরিস্থিতিতে জামায়াতের জনপ্রিয়তা বেশি থাকে। কিন্তু যখনই ভোট আসবে, জামায়াতের যে ভোট আছে, তার চেয়ে কিছু বাড়বে। জাতীয় নাগরিক পার্টিতে বিএনপি ও জামায়াত—দুই দল থেকেই ভোট আসবে।
আওয়ামী লীগের ভোট এবার জাতীয় নাগরিক পার্টি, বিএনপি ও জামায়াত—তিন দিকেই যাবে বলে মনে করেন সারোয়ার তুষার। তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে যারা তরুণ আওয়ামী লীগার ছিল, ছাত্রলীগার টাইপের ছিল বা একটা ন্যারেটিভের ভিকটিম ছিল বা নিরুপায় হয়ে করেছে—এ রকম একটা বড় (অংশ) এই দিকে (জাতীয় নাগরিক পার্টি) আসার সম্ভাবনা আছে, যদি আমরা সেভাবে তাদেরকে…। কারণ, এটা বাংলাদেশের মানুষ এবং তাঁদেরকে তো আমরা ইয়া করতে পারব না। যাঁদের ক্রিমিনাল রেকর্ড নাই, তাদের সাথে ইয়া কি। তাদেরকে তো একটা জায়গা দিতে হবে এবং সকল দল করছে। বলে লাভ নাই, বিএনপি সারা দেশে আওয়ামী লীগকে শেলটার (আশ্রয়) দিচ্ছে, ক্রিমিনালদেরকে (সন্ত্রাসী) শেলটার দিচ্ছে। এটা আপনারা সবাই জানেন। সে ক্ষেত্রে যারা ভোটার, তাদেরকে তো আমাদের দিকে টানতে চাইব–ই, এটা খুবই ন্যাচারাল।’
এ সময় আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন, ভয়েস ফর রিফর্ম প্লাটফর্মের সহ-আহ্বায়ক ও বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর, ইনোভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রুবাইয়াত সারওয়ার, অর্থনীতিবিদ অনন্য রায়হান প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ব্রেইনের নির্বাহী সফিকুর রহমান।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স র য় র ত ষ র বল ন সরক র ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি
নিয়োগপত্র নেই। এ কারণে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। দেওয়া হয় না পরিচয়পত্র। নেই কর্ম ঘণ্টার হিসাব। তবে রয়েছে মজুরিবৈষম্য ও জীবনের ঝুঁকি। এ চিত্র খুলনার বরফকলে কর্মরত বরফ শ্রমিকদের।
অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত বরফকলের শ্রমিকেরা জানেন না মে দিবসের অর্থ। তারা শুধু এটুকু জানেন, কাজ থাকলে মজুরি পাবেন, অন্যথায় জুটবে না কিছু। খুলনার নতুন বাজার, রূপসা, শিপইয়ার্ড ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বরফ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ঝুঁকি ও বৈষম্যের এই চিত্র।
সরেজমিনে জানা গেছে, লবণ পানি এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংমিশ্রণে বরফের প্রতিটি ক্যান তৈরি হয়। এ কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যুসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এছাড়াও অধিকাংশ সময় হাত-পা ভিজে ঠান্ডা থাকায় ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। এর বাইরে বুকে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় ভোগেন এখানকার শ্রমিকেরা। পাতলা বরফে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। কিন্তু মালিক বা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের অ্যাপ্রোন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন না। তবে দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
আরো পড়ুন:
ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত
মহান মে দিবস: শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কারে জোর সরকারের
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার, নিউমার্কেট, শিপইয়ার্ড, রায়েরমহল এবং রূপসা উপজেলার পূর্ব রূপসা এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি বরফকল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাজার ও পূর্ব রূপসায় সর্বাধিক বরফকল রয়েছে। এসব কলে গড়ে দশ জন হিসেবে দেড় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।
রূপসার নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত ‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করেন মোহাম্মদ রাসেল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি হলেও পরিবার নিয়ে রূপসার জাবুসা এলাকায় বসবাস করেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই বরফকলে কাজ করছেন তিনি। রাসেল জানান, তাদের মাসিক বেতন নেই। নেই নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র। মূলত উৎপাদনের উপর প্রতি পিস বরফের ক্যান অনুযায়ী ১২ টাকা হারে মজুরি পান। নামমাত্র এ মজুরিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে সংসার ঠিকমতো চলে না।
‘‘তিন বছর আগে নির্ধারণ করা মজুরি এখনো চলছে। লোকসানের অজুহাতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে চান না। তাদের মতো শ্রমিকদের কোন বেতন-বোনাস নেই। নো ওয়ার্ক, নো পে অর্থাৎ কাজ থাকলে মজুরি আছে কাজ না থাকলে নেই। মালিকদের এ সিদ্ধান্ত না মানলে চাকরিও থাকে না।’’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন রাসেল হোসেন।
একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘গড়ে প্রতিমাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা মজুরি পাই। কিন্তু মাসিক খাবার খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া বাবদ ৩ হাজার টাকা চলে যায়।’’
তবে জাকির হোসেন ব্যাচেলর হওয়ায় কারখানার মধ্যেই থাকেন। বিয়ের পর এ কাজ করার ইচ্ছা নেই বলে জানান তিনি।
বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১-এ অপারেটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ সেলিম শেখ। তার জন্ম নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা হলেও কর্মসংস্থানের কারণে রুপসার বাগমারা গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি জানান, বর্তমান বয়স ৮৪। ২০ বছর বয়স থেকেই বরফ কারখানার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হেলপার হিসেবে ২৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অপারেটর হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে সবসময় উৎপাদন না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা কারখানায় থাকতে হয়। ছুটি পান না।
‘অ্যামোনিয়া গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। তবে তিনি কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি বলে জানান তিনি।
‘মায়ের দোয়া আইস এন্ড কোল্ড স্টোরেজে’র শ্রমিক জাকারিয়া হাওলাদার বলেন, ‘‘চার বছর বরফকলে কাজ করছি। চাকরির ভবিষ্যৎ নেই। শ্রম দিতে পারলে মজুরি হয়, না হলে হয় না। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেন না মালিকপক্ষ। বেতন বাড়ানোর কথা বললে তারা আমলে নেন না।’’
একই এলাকার ‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করছেন মোঃ মুন্না গাজী ও মোঃ হাসান শেখ। তারা নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তারা দুজনেই মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই।
‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’র ম্যানেজার আশিকুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদাসীন। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার মাঝেমধ্যেই লিক হয়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৩২টি আইস উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। ছয়জন শ্রমিক কাজ করে বলে জানান তিনি।
‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ- ২'র ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘বরফের মূল ক্রেতা চিংড়ি ও সাদা মাছের ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ ও দোকানে শরবত বিক্রেতারাও কারখানা থেকে বরফ কিনে নেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের ৬ মাস চাহিদা থাকে এবং কিছুটা লাভের মুখ দেখা যায়। তবে শীত মৌসুমের ছয় মাস বরফের চাহিদা কম থাকে। তখন কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি দিয়ে লোকসান গুণতে হয়।’’
জামাল উদ্দিন স্বীকার করেন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও তা এড়াতে কোন সরঞ্জাম নেই। তবে অপারেটরদের অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে মাক্স সরবরাহ করা হয়।
‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১'র মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রিয়াদ-উল-জান্নাত সৈকত বলেন, ‘‘ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। কখনো লাভ, কখনো লোকসান এভাবেই চলছে। গত বছর কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’’
তবে লাভ হলে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ বিষয়ে শ্রমিকদের সংগঠন রূপসা বেড়িবাঁধ হ্যান্ডলিং শ্রমজীবী ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রিপন শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি বরফকলের ৪০ জন শ্রমিক তাদের ইউনিয়নের সদস্য। বিগত দেড় বছর আগে মজুরির সমস্যা নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুই একজন শ্রমিক অভিযোগ করলে ইউনিয়নের মাধ্যমে সেটির সমাধান করে দেন তারা। কিন্তু বর্তমানে অভিযোগ নিয়ে কেউ আসে না।’’
বরফকলের শ্রমিকদের নিয়ে তারা মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তারা//