ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা, নাকি আশীর্বাদ? তিনি দুটোই, তবে সমানভাবে নয়।

স্বল্প মেয়াদে ট্রাম্পের শুল্কনীতি চীনের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে বটে; কিন্তু মাত্র কয়েক সপ্তাহেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের যা ক্ষতি করেছেন, তা শীতল যুদ্ধের সময় পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ঐক্য দুর্বল করার সব প্রচেষ্টার চেয়ে বেশি। চীনের নেতারা এমন কিছু আশা করেননি।

ট্রাম্প ইতিমধ্যে বেশ কিছু কঠোর শুল্ক আরোপ করেছেন। এটি চীনের জন্য নতুন সংকেত দিচ্ছে। এবার তাঁর হুমকিগুলো শুধু কথার কথা নয়, বরং তিনি তা বাস্তবায়ন করতেও প্রস্তুত। চীনের অর্থনীতি এমনিতেই চাপে আছে, তাই আরও বড় বাণিজ্যযুদ্ধ বেইজিংয়ের জন্য বড় ধাক্কা হতে পারে, যদিও চীনের কূটনীতিকেরা আত্মবিশ্বাস দেখানোর চেষ্টা করছেন।

তবে এই শুল্ক কিংবা সম্ভাব্য বাণিজ্যযুদ্ধ চীনের জন্য কেবল স্বল্প বা মাঝারি সময়ের সমস্যা। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তাঁর দেশকে ধৈর্য ধরতে বলবেন এবং চীন তা করবে। এতে চীনকে বড় মূল্য দিতে হতে পারে; কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ট্রাম্প যা করছেন, তা সির জন্য বড় সুযোগ তৈরি করছে। বিশেষ করে ট্রাম্পের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত চীনের জন্য সুবিধাজনক হয়েছে, যা সি চিন পিং নিজেও আশা করেননি।

ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধের যে শান্তি পরিকল্পনা দিয়েছেন, তা মূলত রাশিয়ার শর্তেই তৈরি। পাশাপাশি তিনি কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড নিয়ে উচ্চাশা প্রকাশ করেছেন। এসব চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ট্রাম্প তাঁর নীতির মাধ্যমে উত্তর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মিত্রদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নষ্ট করছেন। একই সঙ্গে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউএসএআইডি, জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক প্রকল্পগুলো থেকে সরে আসবে।

চীন কেন এই পরিস্থিতিকে ইতিবাচকভাবে দেখছে? কারণ, চীন তার বৈশ্বিক কৌশল প্রেসিডেন্ট সির নীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুলেছে। এর মূল লক্ষ্য ২০৪৯ সালের মধ্যে, অর্থাৎ গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের শতবর্ষপূর্তিতে, ‘চায়না ড্রিম’ বাস্তবায়ন করা। ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত সির এই স্বপ্নকে আরও সহজ করে দিয়েছে।

সি তিনটি বিষয়ে বৈশ্বিক উদ্যোগ নিয়েছেন—উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও সভ্যতা। তাঁর আশা, এগুলো চীনকে বিশ্বনেতৃত্বের কেন্দ্রে নিয়ে আসবে। চীন কোনো নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়তে চায় না; বরং বর্তমান ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে এমন একটি কাঠামো তৈরি করতে চায়, যেখানে চীন কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে এবং গ্লোবাল সাউথ (বৈশ্বিক দক্ষিণের উন্নয়নশীল দেশগুলো) তার পাশে থাকবে। এর মানে চীন জাতিসংঘের নীতিগুলো
এমনভাবে বদলাতে চায়, যাতে পশ্চিমা দেশগুলোর বদলে গ্লোবাল সাউথের স্বার্থ অগ্রাধিকার পায় এবং চীন এর নেতা হয়ে ওঠে।

চীনের ভাষায়, এটিই ‘গণতন্ত্রীকরণ’, কারণ জাতিসংঘের বেশির ভাগ সদস্যরাষ্ট্র গ্লোবাল সাউথের অন্তর্ভুক্ত এবং পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ এখানেই বসবাস করে। যদিও এই ধারণা স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের কাছে জনপ্রিয়। তবে ধনী গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়।

গত ৮০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কখনো কখনো মতবিরোধ হলেও (যেমন ১৯৫৬ সালের সুয়েজ সংকট বা ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ), পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পাশেই থেকেছে। এই ঐক্য শীতল যুদ্ধ জিততে সাহায্য করেছিল এবং পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা গঠনে ভূমিকা রেখেছিল। ট্রাম্প যখন ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার শর্ত অনুযায়ী শান্তি পরিকল্পনা দেন, তখন চীন ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে সরাতে চেয়েছিল, কিন্তু সফল হয়নি।

চীনের জন্য জাতিসংঘের কাঠামো বদলাতে হলে প্রমাণ করতে হবে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে এটিকে নতুনভাবে সাজানো প্রয়োজন। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পের মতো বিশাল বিনিয়োগ করেও চীন খুব বেশি সাফল্য পায়নি। তবে ট্রাম্পের কার্যকলাপের কারণে এই পরিকল্পনা অনেক এগিয়ে গেছে।

ট্রাম্প ইউক্রেনকে জোর করে শান্তি আলোচনায় বসতে বাধ্য করেছেন, ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন এবং রাশিয়ার শর্ত মেনে যুদ্ধ বন্ধের পরিকল্পনা করেছেন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে গেছে, যা চীন এত দিন কূটনৈতিকভাবে চেষ্টা করে অর্জন করতে পারেনি। অথচ ট্রাম্প নিজেই তা করে দিয়েছেন।

ট্রাম্প তাঁর নীতির মাধ্যমে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তারা আর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করতে পারবে না। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র কানাডার সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছেন এবং ন্যাটোর সদস্য ডেনমার্কের সার্বভৌম অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। একসময় বিশ্বের জন্য আশা ও উদাহরণের প্রতীক হিসেবে দেখা যুক্তরাষ্ট্র এখন সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে বৈশ্বিকভাবে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ট্রাম্প চীনের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভণ্ডামির অভিযোগ আনার সুযোগ দিয়েছেন। এখন বেইজিং দাবি করতে পারছে, যুক্তরাষ্ট্র শুধু নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক নিয়ম ব্যবহার করছে এবং বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা একুশ শতকের জন্য উপযুক্ত নয়, তাই এটির আমূল পরিবর্তন করা দরকার। এটি পুরোপুরি সি চিন পিংয়ের বৈশ্বিক কৌশলের সঙ্গে মিলে যায়।

চীন অনেক দিন ধরেই বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবর্তন দরকার। তবে এই প্রচেষ্টা ধীরগতিতে চলছিল। ট্রাম্পের কারণে এই প্রক্রিয়া এখন অনেক দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। গ্লোবাল সাউথের দরিদ্র দেশগুলো যখন যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক সহায়তা বন্ধের কারণে সংকটে পড়ছে, তখন চীনের ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গণতন্ত্রীকরণ’ ধারণা প্রতিদিন আরও সমর্থন পাচ্ছে। চীনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে ট্রাম্পের চেয়ে ভালো আর কেউ পারেনি।

ট্রাম্প ‘যুক্তরাষ্ট্র ফার্স্ট’ নীতির মাধ্যমে এমন কিছু করে ফেলেছেন, যা সি চিন পিং নিজেও এত সহজে করতে পারতেন না। সির ‘চায়না ড্রিম’ এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, কিন্তু ট্রাম্পের কারণে এটি অনেক এগিয়ে গেছে।


স্টিভ স্যাং লন্ডনের সোয়াস ইউনিভার্সিটির চায়না ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও দ্য পলিটিক্যাল থট অব সি চিন পিং বইয়ের সহলেখক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ ন র জন য ব যবস থ কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

ইউনূস-তারেক সফল বৈঠকে স্বপ্নভঙ্গ হলো যাদের

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের বৈঠক দেশের রাজনীতির মোড়  অনেকটাই  ঘুরিয়ে দিয়েছে। নানা অনিশ্চয়তা, শঙ্কা, গুজব রাজনীতিকে ঘিরে ধরেছিল। একধরনের অনাস্থার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। এ বৈঠক অনিশ্চয়তা, শঙ্কার কালো মেঘ সরিয়ে দিয়ে রাজনীতিতে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করবে বলে আশা করা যায়।

পারস্পরিক যে কাদা ছোড়াছুড়ি, দুর্নাম করার রাজনীতি, সেখান থেকে বেরিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ তৈরিতে সহায়তা করবে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক। নির্বাচন নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির কিছুদিন ধরে টানাপোড়েন চললেও বৈঠকটি অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে হয়েছে। এটা আমাদের রাজনীতিতে উদাহরণ হয়ে থাকবে।

বৈঠকটি সারা দেশের মানুষের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার করেছে। এখন মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। মানুষের ধারণাকে বাস্তবে রূপদান করার দায়িত্ব সরকারের।

বিএনপি এর আগে ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইলেও কিছুটা সরে এসে ফেব্রুয়ারির সময়সীমাকে মেনে নিয়েছে। সরকারও এপ্রিল থেকে সরে এসে নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হতে পারে বলে মন্তব্য করেছে। উভয় পক্ষেরই কিছুটা সরে আসা, কিছুটা ছাড় দেওয়া—এটাই আমাদের রাজনীতি থেকে একদম হারিয়ে গিয়েছিল।

রাজনীতি মানেই প্রতিপক্ষের সঙ্গে শত্রুতা করতে হবে, এমন পরিস্থিতিতে আমাদের রাজনীতি পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু শুধু কথায় কথায় উদার হলে হবে না। কাজে-কর্মেও উদারতা দেখাতে হবে। লন্ডনের বৈঠকে সেই উদারতার কিছু নমুনা আমরা দেখতে পেলাম।

আরও পড়ুনলন্ডনে ইউনূস-তারেকের আলোচনায় বিএনপিরই কি জিত১৩ জুন ২০২৫

বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে আলোচনার ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। তা নিয়ে আপাতত আলোচনার কিছু নেই। আমরা বরং রাজনীতিতে এ বৈঠকের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করি। প্রথমত, এ বৈঠক সারা দেশের মানুষকে আশান্বিত করলেও রাজনীতির কোনো কোনো পক্ষ বা ব্যক্তি হতাশ হয়েছেন।

এসব গোষ্ঠীর মূল কাজ যেন বিএনপিকে যে কোনোভাবে ঠেকানো। ব্যক্তি পর্যায়ে যারা হতাশ হয়েছেন তাদের মধ্যে  রাজনীতিবিদ ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা আছেন। তাঁদের মূল লক্ষ্যই ছিল, যেকোনো প্রকারে বিএনপির রাজনীতিকে প্রতিহত করা। এ অংশ চাইছে না বিএনপির রাজনীতি সামনের দিকে এগিয়ে যাক। বিএনপির নেতৃত্বে নতুন করে বাংলাদেশের বিনির্মাণ হোক।

কেউ যদি সহজ রাজনীতির পথ পরিহার করে অহেতুক কুটিল ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে, তবে তারা নিজেরাই রাজনীতি থেকে হারিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ ও জাসদ আমাদের সামনে রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

বিএনপি যে শত ভাগ শুদ্ধ ও সঠিক রাজনীতি করছে, এটা বলা যাবে না। ভুল-ত্রুটি বিএনপিরও আছে। স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখল, হত্যাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। বিএনপি নিজ দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এই পর্যন্ত চার হাজারের মতো নেতা-কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে এসব কর্মকাণ্ডের জন্য। দেশের ইতিহাসে কোনো দল নিজেদের এতসংখ্যক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করেনি। এ ধরনের অপরাধ শুধু বিএনপির নেতা-কর্মীরাই করছেন না। বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরাও এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এটা আমাদের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।

এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা লাগবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে। এটা সময়সাপেক্ষ বিষয়। বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের রাজনীতি এই অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাই রাজনৈতিক সরকার লাগবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। কারণ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

এ ধরনের পরিস্থিতি শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এর সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তিরও প্রয়োজন হয়। বিকল্প অর্থনৈতিক কর্মসূচিও লাগে। এ জন্যই বিএনপি বারবার নির্বাচনের কথা বলে আসছে। আমরা মনে করি, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সার্বিক অবস্থান উন্নতি ঘটবে। বিএনপির বিকল্প অর্থনৈতিক পরিকল্পনা আছে।

বৈঠক শেষে যৌথ ঘোষণা

সম্পর্কিত নিবন্ধ