মার্চ ১৯৭১ : পথ খুঁজে খুঁজে দুই দিন
Published: 18th, March 2025 GMT
১৯৭১-এর ১ মার্চ থেকে ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সঙ্গে আমাকে আমার দুই কোম্পানি নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা (আইএস ডিউটি) রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। ৪ মার্চ ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার, পিএসসি, উপ-আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসক, ইস্টার্ন কমান্ডার সাহেবজাদা ইয়াকুবের টেলিফোনে দেওয়া অনুমোদনক্রমে চট্টগ্রাম শহরের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেন। ক্যাপ্টেন মহসিন সার্কিট হাউসের স্টাফ অফিসারের দায়িত্ব পান। আমাকে আমার দায়িত্বের অতিরিক্ত (আমার অফিস তখন নিয়াজ স্টেডিয়ামে, বর্তমানে এম এ আজিজ স্টেডিয়াম) উপ-আঞ্চলিক প্রশাসকের অফিস পালাক্রমে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমাদের দায়িত্ব আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলাম।
২৪ ও ২৫ মার্চরাজনীতিতে যেমন, তেমনি সেনাবাহিনীতে আমরা যাঁরা বাঙালি ছিলাম আমাদের মধ্যেও, মার্চের শুরু থেকেই দিনগুলো ছিল খুবই ঘটনাবহুল। আমি এখানে ২৪ ও ২৫ মার্চের কথাই বলব।
২৪ মার্চ ১৯৭১ সালে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বানানো হবে। দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্রুপসকে শান্ত করার লক্ষ্যে জয়দেবপুর রাজবাড়িতে দরবার নেওয়ার জন্য ঢাকায় নিয়ে যেতে দু-দুটি হেলিকপ্টারে করে ১৭ জন সিনিয়র অফিসার সকাল ৯টায় চট্টগ্রামে উপস্থিত হয়। কনফারেন্সের নামে তারা ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ঘিরে রাখল। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার বাথরুমে যাওয়ার নাম করে বাইরে এসে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘আমাকে তারা ঢাকায় নিয়ে যেতে এসেছে—যদি হুকুম তামিল না করি, তাহলে তা হবে রিভোল্ট। বঙ্গবন্ধুকে নিজে আমাকে হুকুম দিতে হবে—তাড়াতাড়ি যাও শহরে গিয়ে টেলিফোনে যোগাযোগ করো।’ বলে উনি বাথরুমে চলে গেলেন। ইস্টার্ন হেডকোয়ার্টার থেকে কর্নেল তাজ (জি-১ আই) টেলিফোনে বললেন, ক্যাপ্টেন আমীন যেন ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে ঢাকায় আসেন। তাঁকে আর্মি এভিয়েশনে সিলেক্ট করা হয়েছে এবং করাচিতে পাঠানো হবে।
এদিকে মেজর বেগ নাকি হুকুম জারি করেছেন গাড়ির চাবিগুলো তাঁর কাছে জমা করতে হবে। ধমক দেওয়ায় সিভিল ড্রাইভার সিভিল জিপ গাড়িটি নিয়ে এল। তাঁকে নিয়ে দ্রুত রেলওয়ে কলোনিতে ডিএস মুকবুল আহমেদের বাসায় গেলাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এম আর সিদ্দিকী ঢাকায় আছেন। টেলিফোনে কর্নেল ওসমানীকে না পেয়ে মেসেজ রেখে (হুকুম তামিল করে ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ঢাকায় যাবেন কি যাবেন না) দ্রুত সেনানিবাসে ফিরে এলাম। মুকবুল ভাবি বললেন, ‘কেন যাচ্ছেন?’ বললাম, “ঠিক জানি না। এখন অনেক তাড়া, তাই আর বসতে পারছি না। যদি মেসেজ আসে আমাকে টেলিফোনে শুধু ‘এসেছে’ বলবেন। আমি মেসেজ সংগ্রহ করিয়ে নেব। আম্মা পারলে বাবাকে খবরটা পাঠাবেন যে আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে।” রুহ আফজার শরবত খেয়ে চলে এলাম।
ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিকের কাছেও মেসেজ পাঠালাম—আমাদের ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অষ্টম বেঙ্গলে মেজর জিয়াকে খবর দিলাম, তিনি যেন হোল্ডিং কোম্পানিতে এসে আমাকে খবর দেন। বিষয়টি জরুরি। তিনি এসেছিলেন এবং ক্যাপ্টেন এনামের মাধ্যমে খবর দিয়েছিলেন। এনাম লাঞ্চের পর বলল, আমীন, মেজর জিয়া বেলা ১১টায় হোল্ডিং কোম্পানিতে তোমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গেছেন। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। সকালবেলায় শহরে যাওয়ার আগে দৌড়ে সিএমএইচে অসুস্থ কর্নেল এম আর চৌধুরীর কাছে গিয়ে বললাম, ‘স্যার, ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ও আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে। আপনি অসুস্থ, তবু তাড়াতাড়ি ইউনিফর্ম পরে থাকুন।’ তিনি বললেন, ‘দুই কোম্পানি তৈরি করে রাখো, প্রয়োজনে রেইড করে হলেও ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে তাদের খপ্পর থেকে বের করে আনতে হবে।’ পোর্টে তখন জেনারেল মিঠঠা ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে (সঙ্গে ক্যাপ্টেন মহসীন) সামনে বসিয়ে টেবিল থাবড়িয়ে বলছেন, ‘আনলোড সোয়াত।’
আমীন আহম্মদ চৌধুরী.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
শেখ হাসিনা যে অপরাধ করেছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও তা করে নাই: আসিফ নজরুল
শেখ হাসিনা ও তার দোসররা যে অপরাধ বাংলাদেশে করেছে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও মনে হয় এত জঘন্য অপরাধ করে নাই বলে মন্তব্য করেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) ঢাকায় বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। জুলাই গণহত্যার বিচার আলোচনা ও তথ্যচিত্র প্রদর্শনের এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
তিনি বলেন, “মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা, আহতদের গুলি করে মেরে ফেলা, নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলা... আপনারা বলতে পারেন, ২৫ মার্চ কালরাতে হয়েছে। অবশ্যই হয়েছে, ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ওটা তো অন্য দেশের বাহিনী।”
“১৯৭১ সালে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলেছে, এরকম কোনো ফুটেজ আমি দেখি নাই। ১৯৭১ সালে একজন গুলি খেয়েছে, তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তার বন্ধু, সে অবস্থায় তাকে গুলি করেছে। কোনো মুক্তিযোদ্ধার এমন কোনো বর্ণনা আমি পড়ি নাই বা ফুটেজ দেখি নাই। অন্যরকম নৃশংসতা থাকতে পারে, কিন্তু এরকম নৃশংসতা করে নাই” বলে দাবি করেন তিনি।
এত বড় গণহত্যা চালিয়েও আওয়ামী লীগের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, “একটা দল ১৫ বছর শুধু মিথ্যা আর নির্যাতন করে চালিয়েছে। এখনো তাদের মিথ্যাচার বিন্দুমাত্র থামেনি। এখনো নির্যাতনের ইচ্ছা বিন্দুমাত্র থামেনি। আপনারা যখন মহাখুনি শেখ হাসিনার অডিওগুলো শুনতে পান, দেখবেন এখনো তার নির্যাতন করার ইচ্ছা আছে। এরা কি বিচারে কোনো রকম গাফিলতি থাকে সেটা উন্মোচন করার চেষ্টা করবে না? আমার তো অনেক দায়িত্ব। এই বিচারকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “এই বিচারে আপনাদের (শহীদ পরিবার) হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমি বিশ্বাস করি, যেই প্রক্রিয়ায় বিচার এগোচ্ছে, ইনশাআল্লাহ আমাদের সরকারের আমলেই আপনারা কাঙ্ক্ষিত মামলাগুলোর রায় পাবেন। এমনভাবে বিচারের অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণ আমরা রেখে যাব, কোনো সরকার চাইলেও বিচার থেকে সরতে পারবে না।”
আইন উপদেষ্টা বলেন, “আর আমি বিশ্বাস করি না, ভবিষ্যতে বিএনপি-জামায়াত যারাই ক্ষমতায় আসুক, তারা বিচারে শৈথিল্য বা গাফেলতি দেখাবে। তারা সবাই নির্যাতিত মানুষ।”
পরে হতাহতদের স্মরণে দোয়া ও মোনাজাত করেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের যুগ্ম সচিব (বাজেট ও উন্নয়ন) রুহুল আমীন। এরপর জুলাই আন্দোলন নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/ইভা