লাজুক, মায়াবী একটা মুখ। চোখ বন্ধ করে ইংলিশ লিগে খেলা ফুটবলার ভাবলে চোখের সামনে যে শক্তিমান এক চেহারা ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে হামজা চৌধুরীকে মেলানো যায় না। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুলের হামজার গালভরা হাসি। শিলংয়ে সেই হাসিমুখে পা দুটিকে ছুরি বানিয়ে অবলীলায় ধ্বংস করে দিলেন প্রতিপক্ষ ভারতীয় দলকে।

কোনো দেশের জার্সিতে নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ মানে নিজের টেকনিক্যাল জাত চেনাও, সতীর্থদের সঙ্গে ট্যাকটিকালি কতটা মানিয়ে নিতে পেরেছি, সেটি প্রয়োগ করে দেখাও, আর বাংলাদেশের জার্সিতে খেলার জন্য মানসিকভাবে কতটা তৈরি হয়ে এসেছি, তা প্রমাণ করার ব্যাপার তো আছেই। সব মিলিয়ে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশের জার্সিতে হামজার ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো কেমন গেল?

প্রথমার্ধে পুরোনো ৪-৪-২ ডায়মন্ড শেইপ ফরমেশন থেকে বের হয়ে ৪-২-৩-১ ফরমেশনে দলকে খেলিয়েছেন বাংলাদেশ কোচ হাভিয়ের ক্যাবরেরা। দলের নিয়মিত হোল্ডিং মিডফিল্ডার মোহাম্মদ হৃদয়ের সঙ্গে ডাবল পিভট হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেললেন হামজা। দ্বিতীয়ার্ধে পুরোনো ৪-৪-২ ডায়মন্ড শেইপ ফরমেশনে ফিরে যায় বাংলাদেশ। তবে হৃদয়কে একটু ওপরে উঠিয়ে সেন্টার মিডফিল্ডারের বাম প্রান্ত দিয়ে একমাত্র হোল্ডিং মিডফিল্ডারের ভূমিকায় থাকলেন হামজাই।

অনাকর্ষণীয়। হ্যাঁ। রক্ষণাত্মক? সেটিও সত্যি। ফুটবল এমন একটি খেলা, বিশেষ করে প্রতিপক্ষ দল যদি র‍্যাঙ্কিংয়ের ৫৯ ধাপ এগিয়ে থাকা কোনো দল হয়, সে দলের বিপক্ষে সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে খেলতে হয়। হাসিমুখে নিজের সর্বোচ্চটুকু ঢেলে দাও, আবার সতীর্থকে পিঠে হাত বুলিয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে আদায় করে নাও পুরোটুকু।

দায়িত্বের কথা বলবেন? কিক অফ বাঁশির ২০ মিনিটের মধ্যেই চোট নিয়ে মাঠছাড়া হলেন দলীয় অধিনায়ক ও অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার তপু বর্মণ। দলের বড় ভাই তপু (বয়সের বিচারে) মাঠ ছেড়ে যাওয়ায় সংসারের জোয়াল কাঁধে তুলে নিলেন হামজা। আগলে রাখলেন তরুণ ও অনভিজ্ঞ ডিফেন্ডার শাকিল হাসান তপুকে। পুরো ম্যাচ জুড়ে রক্ষণভাগকে বাড়তি ছায়া দিয়ে বুঝতে দিলেন না সংসারে অভাবের কষ্ট।

শিল্পী নন, তিনি শ্রমিক। এমন ভূমিকায় খেলার জন্য খুব বেশি প্রশংসা হয় না। কারণ সেটি বরাদ্দ আক্রমণাত্মক ফুটবলশিল্পীদের জন্য। গোল ঠেকানোর মধ্যে আর এমন কি মাহাত্ম্য! তবে হামজা না থাকলে স্কোর লাইন কী হতে পারত, তা তো অনুমান করে নেওয়াই যায়।

খেলাটি যদি হয় সৌন্দর্যের অপরূপ ছবি, তাহলে হামজার নাম আসবে না। তবে খেলা যদি হয় যুদ্ধের ময়দান, ডার্টি ওয়ার্কের আড়ালে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সুরক্ষা রেখে ম্যাচের আসল নায়ক তো হামজা। কেউ কেউ তো নামের পাশে নতুন বিশেষণ যোগ করে দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের ডিফেন্স মিনিস্টার।’

ভারতীয় দলের প্রাণভোমরা সুনীল ছেত্রির কাছে আসা পাসিং লাইনগুলো বন্ধ করলেন। কখনও লাফিয়ে উঠে সুনীলের মাথা ছুঁয়ে বের হওয়া বল আর বাংলাদেশের গোলপোস্টের মাঝের দেয়াল হয়ে দাঁড়ালেন। ভারতের আক্রমণ দানা বাঁধার আগেই আলতো টোকাই ইন্টারসেফশন করে করে দিলেন ধ্বংস। দুই প্রান্ত থেকে ভয় ধরানো সব ক্রস ও কাটব্যাক যখন নিজেদের বক্সে আসে তখন তাঁর অনুমানক্ষমতা প্রখর। নিখুঁত ট্যাকলের সঙ্গে দুর্দান্ত কভারিং বলে দেয়, সে ইংলিশ লিগে খেলে আসা ফুটবলার।

ম্যাচের ৪৮ মিনিটের লিস্টন কোলাসো ও হামজা ব্যাটলের রিপ্লেটা মনের টেলিভিশনে চালিয়ে দিন আরেকবার। মাঝমাঠের ওপর থেকে বল নিয়ে গতি তুলে বাংলাদেশের রাইট ফুলব্যাক রহমত মিয়াকে ঘোল খাইয়ে বাম প্রান্তের উইং দিয়ে আক্রমণে উঠলেন কোলাসো। মাঝমাঠ থেকে অনেকটা দূরত্ব পাড়ি দিয়ে এসে কোনো প্রকার ফাউল না করে সে আক্রমণটি উপড়ে ফেললেন হামজা।

কোলাসো মাটিতে শুয়ে ফাউল দাবির ভঙ্গিতে হাত চাপড়ালেন, কিন্তু রেফারির তাতে বিন্দুমাত্র সায় নেই। কতবারই তো বুলডোজার ভঙ্গিতে প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিলেন হামজা, কিন্তু তাঁর করা ট্যাকলে একটি বারের জন্যও বাজেনি ফাউলের বাঁশি। এ ফুটবলীয় কৌশল আর শারীরিক সক্ষমতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

অন দ্য বলও যে একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন, তা বোঝা গেছে ভারতীয় ফরোয়ার্ড সুনীল আর ফারুখ চৌধুরীর দৌড়ঝাঁপ। বাংলাদেশের রক্ষণভাগের ওপর প্রেসিংয়ের সময় তারা হামজার লাইন ব্লক করে বলের জন্য দৌড়িয়েছেন। কারণ, তারা ভালো করেই জানতেন শুধু রক্ষণ সামলানো নয়, এ অঞ্চলের ফুটবলে অবলীলায় নিচ থেকে খেলাটা তৈরিও করতে পারবেন শেফিল্ড ইউনাইটেডের এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। স্বাভাবিকভাবে এতে আগের ম্যাচগুলোর মতো আক্রমণে পুরোপুরি মনোযোগী হতে পারেননি সুনীল। 

অন দ্য বল ও অফ দ্য বলের সঙ্গে ব্যক্তিগত নামের ইমেজ–এগুলো দিয়েই ৯০ মিনিট বাংলাদেশকে আগলে রাখলেন হামজা; আমাদের ভালোবাসার ঝাঁকড়া চুলের হামজা।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন য ফ টবল

এছাড়াও পড়ুন:

সাকিবের পথে হাঁটছেন মিরাজ

সাকিব আল হাসানের সঙ্গে নিজের তুলনাকে মেহেদী হাসান মিরাজ হয়তো উপভোগই করেন। কারণ, তাঁর স্বপ্ন সাকিবের মতো বিশ্বনন্দিত অলরাউন্ডার হয়ে ওঠা। সেই পথে বোধ হয় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে টেস্টে দেশে-বিদেশে সম্প্রতি ভালো করছেন। পাকিস্তানে দারুণ প্রশংসিত ছিলেন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুই টেস্টের হোম সিরিজে উভয় টেস্টে নিজেকে ছাপিয়ে গেলেন। সিলেটের হারের ম্যাচেও ১০ উইকেট ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট নিয়ে সাকিব ও সোহাগ গাজীর কাতারে নাম লেখালেন। মূলত মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ইনিংস ব্যবধানে টেস্ট জেতা সম্ভব হয়। 

গতকাল শতকের ঘরে যেতে কম কসরত করতে হয়নি তাঁর। নব্বইয়ের ঘরে গিয়ে তো অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছিলেন হাসানের আউটের শঙ্কায়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় দ্বিতীয় শতকের দেখা পান তিনি। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি ছিল মিরাজের। গতকালের পারফরম্যান্স নিয়ে টাইগার এ অলরাউন্ডার বলেন, ‘ব্যাটিংয়ের সময় চেষ্টা করেছিলাম ২ রান নিয়ে ১০০ রানে যেতে। সেভাবে দৌড় দিয়েছিলাম। কিন্তু ফিল্ডারের হাতে বল চলে গিয়েছিল (হাসি)। তার পর তো আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। হাসান অনেক ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। তানজিমও ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। তাইজুল ভাইও। এই তিনজনকেই অনেক অনেক ধন্যবাদ। কারণ, ওদের জন্যই আমি ১০০ রান করতে পেরেছি।’ 

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করা সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট প্রাপ্তিকে নিজের সেরা পারফরম্যান্স দাবি মিরাজের, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ১০০ করেছিলাম, ৩ উইকেট নিয়েছিলাম। অল্পের জন্য ৫ উইকেট হয়নি। হলে ভালো লাগত। ওই ম্যাচ হেরেছিলাম এই মাঠে। সে জিনিসটা মাথায় ছিল। ভালো লাগছে ম্যাচটি জিতেছি।’ মিরাজ ১৬২ বলে ১১টি চার ও একটি ছয় মেরে ১০৪ রান করেন। ২১ ওভারে ৩২ রান দিয়ে নেন পাঁচ উইকেট।

টেস্টে এ রকম অলরাউন্ড পারফরম্যান্স বাংলাদেশে আর দু’জনের আছে। সাকিব আল হাসান দু’বার ম্যাচে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট পেয়েছেন ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মিরপুরে আর ২০১৪ সালে খুলনায়। সোহাগ গাজী নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার করেন চট্টগ্রামে। সেই মাইলফলক ছোঁয়া মিরাজকে সম্প্রতি অলরাউন্ডার ক্যাটেগরিতে ফেলা হয়। সাকিবের বিকল্প ভাবা হয় তাঁকে এখন। 

এ ব্যাপারে মিরাজের অভিমত, ‘দেখেন একটা জিনিস, যখন সাকিব ভাই ছিলেন, ভিন্ন রোল ছিল। এখন ভিন্ন রোল। যেহেতু টিম ম্যানেজমেন্ট, সবাই ব্যাটিংয়ে আস্থা রাখে। আমিও ভেবেছি আমার ব্যাটিংটা গুরুত্বপূর্ণ। এখন হয়তো আমি লিডিং রোল প্লে করছি, আগে সাকিব ভাই করত। এখন আমাদের দায়িত্ব আরও বেশি।’ 

সিলেটে দুই ইনিংসে পাঁচ উইকেট করে নিয়েও দলকে জেতাতে পারেননি মিরাজ। চট্টগ্রামে সাদমান, তাইজুলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ম্যাচ জয়ের নায়ক হন। এই সাফল্য নিয়ে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, প্রথম ম্যাচ হারার পর যেভাবে কামব্যাক করেছি, এটা খুবই দরকার ছিল। আমাদের সবাই ভেবেছিল, আমরা ভালো করব।’ মিরাজ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন কোচিং স্টাফ ও সতীর্থের কাছে। আর তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা পুরো দলের।

সম্পর্কিত নিবন্ধ