‘হঠাৎ একের পর এক গুলির শব্দ। মুহূর্তের মধ্যে খেয়াল করলাম, আমাদের গাড়িকে লক্ষ্য রেখে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া হচ্ছে। তিন-চারটি বাইক (মোটরসাইকেল) থেকে এলোপাতাড়ি গুলি করা হচ্ছিল। তারা সাত–আটজনের মতো হবে। প্রাণে বাঁচতে আমাদের চালক গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়েও লাভ হয়নি। পেছন থেকে মোটরসাইকেল আরোহীরা ধাওয়া করতে থাকে। আর অনবরত গুলি চালাতে থাকে। একপর্যায়ে গাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে ওরা। এর পরেও কীভাবে প্রাণে রক্ষা পেয়েছি, তা আল্লাহ জানে।’

চট্টগ্রাম নগরের বাকলিয়া এক্সেস রোড এলাকায় প্রাইভেট কারে গুলি ছোড়ার ঘটনার এমন বর্ণনা দেন গাড়িতে থাকা মো.

রবিউল ইসলাম ওরফে রবিন (২৪)। গুলিতে গাড়িতে থাকা দুজন নিহত হয়েছেন। তাঁরা হলেন আবদুল্লাহ ও মোহাম্মদ মানিক। আর বাঁ পায়ে গুলি লেগে আহত হয়েছেন রবিউল। তিনি নিহত আবদুল্লাহর বন্ধু। পেশায় গাড়িচালক রবিউল। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রবিউলের সঙ্গে কথা হয় আজ রোববার দুপুরে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রুপালি রঙের একটি প্রাইভেট কার কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে বাকলিয়া এক্সেস রোডে আসতে থাকে। গাড়িটি এক্সেস রোডের মুখে প্রবেশের পর পেছন দিকে তিন–চারটি মোটরসাইকেল সেটিকে ধাওয়া করে। একপর্যায়ে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। প্রাইভেট কারের ভেতর থেকে মোটরসাইকেল আরোহীদের লক্ষ্য করে কয়েকটি গুলি ছোড়া হয়। পেছন ও পাশ থেকে গুলি করা হয় গাড়িতে। গুলিতে অনেকটা ঝাঁঝরা করে ফেলা হয় গাড়ি। এতে প্রাইভেট কারের দুই আরোহী মারা যান।

এ ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া গাড়ি থাকা রবিউল ইসলাম জানান, চান্দগাঁও এলাকার বাসিন্দা সারোয়ার হোসেনের ডাকে তাঁরা অক্সিজেন থেকে নতুন ব্রিজ বালুর টাল এলাকায় গিয়েছিলেন। সেখানে থেকে ফেরার পথে হামলার মুখে পড়েন। হামলাকারীদের চিনতে না পারলেও সম্প্রতি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেনের লোকজন এর সঙ্গে জড়িত বলে ধারণা করছেন রবিউল। তিনি বলেন, সাজ্জাদের সঙ্গে সারোয়ারের সম্ভবত আগে থেকে দ্বন্দ্ব ছিল। সম্প্রতি সাজ্জাদের গ্রেপ্তার এবং রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝামেলা বেড়েছে। তাই সাজ্জাদের লোকজন সারোয়ারকে খুন করতে এ হামলা চালাতে পারে।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সারোয়ার হোসেন। ৫ আগস্টের পর জামিনে মুক্তি পান তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে ১৬টি হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে।

রবিউলের বাসা নগরের অক্সিজেন এলাকায়। সেখানে পরিবার নিয়ে থাকেন। তিনি দাবি করেন, শনিবার রাত ৯টার দিকে আবদুল্লাহ (পরে গুলিতে নিহত) ফোন করে ঈদের কেনাকাটা করতে যেতে বলেন। এ জন্য আবদুল্লাহ একটি গাড়ি ভাড়া করেন। রাত সাড়ে ১০টায় তাঁকে বাসা থেকে গাড়িতে তুলে নেন। এ সময় গাড়িতে আবদুল্লাহ ছাড়া আরও দুই বন্ধু ছিলেন। এই দুজন হলেন মো. মানিক ও ইমন।

গাড়ি করে বিপণিবিতানের দিকে যাওয়ার সময় আবদুল্লাহর মুঠোফোনে একটি কল আসে বলে জানান রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, আবদুল্লাহকে ফোন করেন চান্দগাঁও এলাকার সারোয়ার। সারোয়ারের সঙ্গে আবদুল্লাহর আগে থেকে পরিচয় ছিল এবং তাঁর সঙ্গে রাজনীতি করতেন। সারোয়ার আবদুল্লাহকে ফোন করে নতুন ব্রিজ এলাকায় যেতে বলেন। তারপর তাঁরা বিপণিবিতানে না গিয়ে নতুন ব্রিজের বালুর টালে চলে যান। তখন রাত প্রায় ১২টা।

বালুর টালে যাওয়ার পর সারোয়ারের সঙ্গে তাঁদের দেখা হয় বলে জানান রবিউল ইসলাম। এ সময় সারোয়ারের সঙ্গে আরও ১০-১২ জন ছিলেন। রবিউল বলেন, সারোয়ারের সঙ্গে আবদুল্লাহ আলাপ করতে থাকেন। খিদে লাগলে তিনি ও ইমন মইজ্জ্যারটেক এলাকায় যান। সেখানে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক ছিলেন। মইজ্জ্যারটেক থেকে ফিরে আসার পর তখনো বালুর টালে সারোয়ারের সঙ্গে আবদুল্লাহকে আলাপ করতে দেখেন। বেশ কিছুক্ষণ পর সারোয়ার গাড়ি বের করতে বলেন। সারোয়ারের সঙ্গে থাকা অন্যরা মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যান। আর সারোয়ার ও আরেকজন তাঁদের গাড়িতে ওঠেন।

ছয়জনকে নিয়ে গাড়ি নতুন ব্রিজ থেকে বহদ্দারহাটের দিকে রওনা দেন বলে জানান রবিউল। চালকের আসনে ছিলেন মানিক। নতুন ব্রিজ থেকে রওনা দেওয়ার দু-তিন মিনিটের মাথায় হঠাৎ গুলির শব্দ শুনতে পান। তিনি বলেন, তাঁদের গাড়ি ধাওয়া করতে করতে একের পর এক গুলি ছুড়তে থাকে। ৩-৪টি মোটরসাইকেলে ৮-১০ জন লোক এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। টানা ৩০ থেকে ৪০ মিনিট গুলি ছুড়েছে। তারা সবাই হেলমেট পরা অবস্থায় ছিল। এ জন্য কাউকে চিনতে পারেননি।

চারপাশ থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে বলে জানান রবিউল। তিনি বলেন, কীভাবে যে গুলি করেছে, তার বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। গুলি করতে করতে গাড়ি ঘিরে ফেলে। একটানা গুলি চলতে থাকে। এর মধ্যে গাড়ির পেছন থেকে ছুটে আসা একটি গুলি লাগে আবদুল্লাহর পিঠে। মানিকের গুলি লাগে বগলের নিচে।

এলোপাতাড়ি গুলি থেকে বাঁচার জন্য সবাই মিলে আর্তচিৎকার করতে থাকেন রবিউল ইসলামরা। এর মধ্যে কোনো রকম গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন রবিউল। তিনি বলেন, বাকলিয়া সংযোগ সড়কের মুখে এলে তাঁদের গাড়ি থেমে যায়। সেখানে প্রশাসনের (পুলিশ) গাড়ি দেখতে পান। পুলিশের সামনেই গুলি ছুড়তে থাকে ওরা। তবে মাত্রা কমে আসে। এর মধ্যে তাঁরা যে যেভাবে পেরেছেন গাড়ি থেকে কোনো রকম বের হয়ে আসেন। কে কোনো দিকে বের হয়ে গেছেন, তা খেয়াল করতে পারেননি। তবে গাড়ি থাকা সারোয়ারের গায়ে কোনো গুলি লাগেনি। আর তিনি (রবিউল) বের হয়ে পাশের একটি রেস্তোরাঁর সামনে গিয়ে পড়ে যান। বাঁ পায়ে গুলি লাগায় হাঁটতেও পারছিলেন না। রেস্তোরাঁর লোকজন টেনে তাঁকে ভেতরে নিয়ে যান। সেখানে একটি টেবিলের ওপর শুইয়ে দেন।

রেস্তোরাঁর শাটার বন্ধ করে দিলেও সেটিকে লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তরা গুলি ছুড়তে থাকে বলে জানান রবিউল আলম। তবে দু-তিন মিনিট পর গুলির শব্দ থেমে যায়। এরপর তাঁকে বের করে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অটোরিকশায় তোলেন। সেখানে ছিলেন গুলিতে আহত মানিকও। গুরুতর আহত মানিক কান্নাজড়িত কণ্ঠে রবিউলকে বলেন, ‘বন্ধু আমি আর বাঁচব না।’

পরে হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে চিকিৎসক মানিককে মৃত ঘোষণা করেন। আর রবিউলকে ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। তবে গাড়ির ভেতর থেকে গুলি করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন আহত রবিউল ইসলাম। তিনি দাবি করেন, তাঁদের গাড়িতে কোনো অস্ত্র ছিল না।

একটি সূত্র জানায়, ১৫ মার্চ ‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়ায় আকরাম নামের এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে প্রাইভেট কারে গুলি করা হয়। আকরামের ব্যবহৃত গাড়ি ও এই গাড়ির রং একই। সাজ্জাদকে ধরিয়ে দেওয়ার পর হুমকির ঘটনায় আকরামের স্ত্রী রুমা আক্তার বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন। এতে সাজ্জাদের স্ত্রী, হাসানসহ কয়েকজনকে আসামি করা হয়।

জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) শাকিলা সুলতানা আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, গুলিতে দুজন নিহত হয়েছেন। কী কারণে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তদন্ত করা হচ্ছে। সাজ্জাদকে ধরিয়ে দেওয়া কিংবা জায়গা দখল নিয়ে বিরোধ আছে কি না, সব বিষয় সামনে রেখে তদন্ত করা হচ্ছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: নত ন ব র জ আবদ ল ল হ এল প ত ড় এল ক য়

এছাড়াও পড়ুন:

রাজশাহীতে বইমেলায় বিক্রি কম, এখনো আশায় আছেন প্রকাশকেরা

রাজশাহী বিভাগীয় বইমেলার প্রথম তিন দিনে লোকজনের ভিড় থাকলেও বেচাকেনা তেমন হয়নি। এতে অনেক প্রকাশকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তবে আগামী কয়েক দিনে বেচাকেনা বাড়বে বলে আশা করছেন প্রকাশকেরা ও আয়োজক কর্তৃপক্ষ।

গত শুক্রবার রাজশাহী জেলা কালেক্টরেট মাঠে ৯ দিনব্যাপী এই বইমেলার উদ্বোধন করা হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায়, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে এবং রাজশাহী বিভাগীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত এ মেলা চলবে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত। মেলায় ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ৭০টি বেসরকারি প্রকাশনাসহ মোট ৮১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে মেলা চলছে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। আর ছুটির দিনে মেলা শুরু হয় বেলা ১১টায়।

উদ্বোধনের আগের দিন বৃষ্টিতে মেলার মাঠ কাদাপানিতে একাকার হয়ে যায়। সেই কর্দমাক্ত পরিবেশেই মেলার উদ্বোধন হয়। দর্শনার্থীদের ভোগান্তি কমাতে পরে প্রতিটি স্টলের সামনে ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও বিক্রির খরা কাটেনি বলে জানালেন বিক্রেতারা।

গতকাল রোববার সন্ধ্যায় মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের বিভিন্ন অংশে তখনো পানি জমে আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত মঞ্চের সামনের প্যান্ডেলেও কাদা। সেখানেই কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা চলছিল, তবে দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিল নগণ্য। স্টলের সামনে ইটের সলিংয়ের তৈরি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন অনেকে। অনেকে বই দেখছেন।

সূর্যোদয় প্রকাশনীর বিক্রেতা রিপন আলী বলেন, প্রথম দিন তো কাদাপানির মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তখনো মানুষ ছিলেন। এখন ইট বিছানোর পর আরও বেশি মানুষ আসছেন, ভিড়ও করছেন, কিন্তু বই কিনছেন খুব কম।

ঐতিহ্য প্রকাশনীর স্টলে কাদার ওপর চেয়ার পেতে বসে থাকতে দেখা গেল বিক্রয়কর্মী ও চিত্রশিল্পী অর্ণব পাল সন্তুকে। তিনি বলেন, মানুষ আসছেন, ঘুরে দেখছেন, কিন্তু বিক্রি নেই বললেই চলে। মেলার ব্যবস্থাপনা আরও ভালো হতে পারত। আরেক বিক্রেতা আবদুল্লাহ হীল বাকি জানালেন, এমনও স্টল আছে, যেখানে সারা দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বইও বিক্রি হচ্ছে না।

তবে হতাশার ভিড়ে আশার কথাও শোনালেন কেউ কেউ। চট্টগ্রাম থেকে আসা নন্দন বইঘর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী সুব্রত কান্তি চৌধুরী বলেন, বেচাবিক্রি আজ না হোক কাল হবে। মানুষ যে মেলায় এসে বই হাতে নিয়ে দেখছেন, এটাই বড় পাওয়া। এতে তাঁদের মধ্যে বই কেনার আগ্রহ তৈরি হবে।

মেলায় আসা পাঠকদের মধ্যে অবশ্য ভিন্ন চিত্র। দুই সন্তানের জন্য শিশুতোষ বই কিনে এক অভিভাবক বলেন, বাচ্চাদের হাতে বই তুলে দেওয়ার আনন্দটাই অন্য রকম।
মেলা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপ্যাধ্যায়ের বই কিনেছেন মনির হোসেন। তিনি বলেন, মেলায় একসঙ্গে অনেক বই পাওয়া যায়, যা বই কেনার জন্য দারুণ সুযোগ।

রাজশাহী কালেক্টরেট মাঠে বইমেলা উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে আলোচনা সভা। গতকাল রোববার সন্ধ্যায়

সম্পর্কিত নিবন্ধ