বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বিশ্বে সর্বোচ্চ। চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এই বাড়তি হার লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে ২৯ মার্চ) মৃত্যুহার আগের যেকোনো সময়ের মধ্যে বেশি।

বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, দেশে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য নিয়ে স্পষ্টতা না থাকায় মৃত্যুহার অনেক বেশি দেখানো হয়। দেশে কেবল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদেরই তথ্য পাওয়া যায়। এর বিপরীতে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়ে ঘরে চিকিৎসা নেন, তাঁদের হিসাব করা হয় না। এর ফলেই মৃত্যুহার বেশি মনে হয়।

জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ডা.

মুশতাক হোসেন বলেন, তথ্যগত সমস্যা থাকলেও রোগটি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য পরিষেবা এখনো যথাযথ নয়। ডেঙ্গু রোগে রাজধানী এবং এর বাইরের সুযোগ-সুবিধার বিস্তর ব্যবধান আছে। আমরা মশা নিয়ন্ত্রণে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে যেমন পারিনি, তেমনি প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবায় ডেঙ্গুকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। এর ধারাবাহিকতা চলছেই।

বাংলাদেশে দুই দশকের বেশি সময় ধরে ডেঙ্গুতে ধারাবাহিকভাবে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৯-এর পর থেকে এর প্রাদুর্ভাবের পরিমাণ অনেক বেশি। অর্থাৎ রোগটি আমাদের দেশে পুরোনো নয়। এরই মধ্যে এ রোগকে ঘিরে একটি সবল স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে ওঠার কথা ছিল। যার ফলে মৃত্যু কম হতে পারে; কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার ছিল সর্বোচ্চ, শূন্য দশমিক ৫২। বাংলাদেশের পর আছে আফ্রিকার দেশে বুরকিনা ফাসো, মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ২৫৫।

বাংলাদেশে মৃত্যুহার মোটামুটি প্রায় এক দশক ধরে একই রকম ছিল বলে জানান যুক্তরাজ্যের কেইল ইউনিভার্সিটির প্রভাষক ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানী নাজমুল হায়দার। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্যগুলো ধরে একটি বিশ্লেষণী গবেষণায় যুক্ত আছেন।

বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে এই গড় হারের চেয়ে গত তিন মাসে হার বেড়ে গেছে। এখন এ হার শূন্য দশমিক ৬২৫। গত তিন মাসে ডেঙ্গুতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আবার চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে যত আক্রান্ত হয়েছে, তা দেশে আর কোনো সময় হয়নি।

মোট মৃত্যুর সংখ্যার সঙ্গে মোট রোগীর সংখ্যা ভাগ দিয়ে মৃত্যুহার বের করা হয়। বাংলাদেশে এই মৃত্যুহারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কমিউনিটিভিত্তিক তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশে শুধু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের তথ্যই পাওয়া যায়। এর মধ্যে আবার সরকারি হাসপাতালই প্রধান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিশেষজ্ঞ বলেন, অন্তত ৭৫ শতাংশ ব্যক্তি আক্রান্ত হয়ে ঘরে চিকিৎসা নেন। তাই বিভ্রান্তির একটি ফাঁক আছে। সে জন্যই দেশের মৃত্যুহার এত বেশি দেখায়।

তবে গবেষক নাজমুল হায়দার বলেন, শুধু ব্রাজিল বাদ দিয়ে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে বাংলাদেশের ধরনেই ডেঙ্গু রোগীদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেখানে কিছু রকমফের থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুহার বেশি কেন, সে বিষয়টি অবশ্যই আমলে নিতে হবে এবং এর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।

মৃত্যুহারের সম্ভাব্য কয়েক কারণ

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লিনিক্যাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফজলে রাব্বী চৌধুরী ডেঙ্গু রোগীদের পরিচর্যায় কাজ করছেন দীর্ঘ সময় ধরে। তিনি চলতি মার্চ মাসেই ডব্লিউএইচওর ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় ওষুধ বা নিরাময় নির্ধারণের একটি কমিটির সদস্য হয়েছেন। বিশ্বের ১৮ জন চিকিৎসকের একজন হিসেবে এ সম্মান পেয়েছেন তিনি।

ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে বলছিলেন, প্রাথমিক বা উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে শকে চলে যাওয়া রোগীদের পরিচর্যা না করে জেলা বা রাজধানীর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া একটা বড় সমস্যা। এর ফলে শকে চলে যাওয়ার পর যে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা ‘গোল্ডেন টাইম’ পাওয়া যায়, তা রাস্তাতেই নষ্ট হয়। রোগীর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হয়।

এই যে উপজেলা পর্যায় থেকে মুমূর্ষু রোগীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, এর পেছনে একাধিক কারণ আছে। যেমন রোগীর পরিজনেরা আস্থা পান না। দ্বিতীয়ত, কোনো সমস্যা হলে চিকিৎসকদের ওপর হামলার মতো ঘটনাও ঘটে। এসব সমস্যা থেকেই চিকিৎসকেরা এসব রোগীকে বাইরে পাঠিয়ে দেন বা দিতে বাধ্য হন।

অধ্যাপক রাব্বী বলেন, অথচ রোগীকে যে ফ্লুইড দেওয়া হয়, সেটা একই রকম। তা উপজেলা স্তরেই দেওয়া সম্ভব।

হাসপাতালে জটিলতার নিরিখে রোগীর চিকিৎসা না হওয়া আরেকটি কারণ বলে মনে করা হয়। যেমন জটিল ডেঙ্গু রোগীর লক্ষণ থাকে। সেগুলো অনেক সময় বিবেচনায় না নিয়ে সাধারণ রোগীর মতো তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া একটা সমস্যা।

সাম্প্রতিক সময়ে এক্সপ্যান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমে (কোনো একটি অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া) আক্রান্ত রোগী বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে রোগীর কার্ডিয়াক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এটিও মৃত্যু বৃদ্ধির একটি কারণ বলে মনে করেন ফজলে রাব্বী চৌধুরী।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে: হামাস

স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়ার প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে হামাস। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া এক ঘোষণাপত্রের অস্ত্র ত্যাগের আহ্বানের জবাবে সংগঠনটি এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

বৃহস্পতিবার হামাসের সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দখলদারির অবসান এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ও সম্পূর্ণ সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ থামবে না তারা।

মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘গাজায় যুদ্ধ বন্ধে হামাসকে (এই উপত্যকায়) তার শাসনের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। সার্বভৌম ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ।’

সৌদি আরব, কাতার, ফ্রান্স ও মিসরসহ ১৭টি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ ঘোষণাপত্রটি সমর্থন করেছে। এটি ‘দ্য নিউইয়র্ক’ ঘোষণাপত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

বৃহস্পতিবার আলাদা এক বিবৃতিতে প্রতি শুক্রবার, শনিবার ও রোববার বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের মিত্র দেশগুলোর দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ করার আহ্বান জানিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা।

অনাহারে মৃত্যু ১৫৪

গাজায় কর্মরত চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, উপত্যকাটিতে অনাহারে আরও দুই শিশু এবং এক তরুণ মারা গেছে। এ নিয়ে সেখানে অনাহারে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫৪ জনে। তাদের মধ্যে শিশু ৮৯টি।

গাজায় প্রায় ২১ লাখ মানুষের বসবাস। উপত্যকাটিতে গত মার্চ থেকে নতুন করে অবরোধ শুরু করে ইসরায়েল। ফলে সেখানে ত্রাণবাহী কোনো ট্রাক প্রবেশ করতে পারছিল না। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্প্রতি কিছুদিন ধরে গাজায় সীমিত পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে ইসরায়েল। এই ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।

ত্রাণ নিতে প্রাণহানি ১৩৭৩

জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, গাজায় গত মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণ আনতে গিয়ে মোট ১ হাজার ৩৭৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫৯ জন মারা গেছেন বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। গত মে মাসের শেষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটি ইসরায়েলি সেনাদের সহায়তায় গাজার কয়েকটি স্থানে ত্রাণ দিচ্ছে।

বাকি ৫১৪ জন মারা গেছেন ত্রাণবাহী ট্রাকের আশপাশে। তাঁরা ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অধিকাংশই ইসরায়েলের সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার সকালে গাজায় অন্তত আরও ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ত্রাণ আনতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন। এই নিয়ে প্রায় ২২ মাসের সংঘাতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হামলা নিহত হয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার ৩৩২ জন।

গাজায় স্টিভ উইটকফ

শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ গাজা সফর করেছেন। তিনি উপত্যকাটির রাফা এলাকায় জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রও ঘুরে দেখেন। এ সময় ইসরায়েলে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হুকাবি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাজায় ছিলেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে উইটকফ নিজেই এই কথা জানিয়েছেন। আগের দিন তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উইটকফ বলেছেন, ‘মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে ও তথ্য সংগ্রহ করতে আমরা গাজায় গিয়েছিলাম। গাজার মানবিক পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট ধারণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য, যাতে করে গাজাবাসীর জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছাতে পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করা যায়।’

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষ দূত ও আবাসন খাতের সাবেক আইনজীবী উইটকফের আন্তর্জাতিক নীতি ও মানবিক সহায়তা-সংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তা সত্ত্বেও তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধেও কূটনীতি চালাচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ