লালমনিরহাটে ম্যুরাল ভাঙার প্রতিবাদ উদীচীর
Published: 31st, March 2025 GMT
লালমনিরহাটে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্মারক মঞ্চে স্থাপিত ম্যুরালের একাংশ জেলা প্রশাসনের নির্দেশে ভেঙে ফেলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।
সোমবার (৩১ মার্চ) এক বিবৃতিতে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ প্রতিবাদ জানান।
তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসের স্মারক ম্যুরালটি কোনো ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে ভাঙা হয়েছে তা তদন্ত করে বের করতে হবে এবং জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। একইসাথে কালবিলম্ব না করে ম্যুরালটি সংস্কার করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার দাবিও জানান তারা।
ঢাকা/মামুন//
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
কারিগরি শিক্ষা জনপ্রিয় করতে হলে
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা জনপ্রিয় করে তুলতে না পারলে দেশের ভেতর ও বাইরের ক্রমবর্ধমান শ্রমবাজারের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। আমাদের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি হচ্ছে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’; অর্থাৎ ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা। বর্তমানে বাংলাদেশে জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কর্মক্ষম। তাদের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলেই এই বিপুল জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করা সম্ভব।
ইউনেস্কোর সংজ্ঞা অনুসারে, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সাধারণ শিক্ষারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জনের অব্যবহিত পরই শিক্ষার্থীদের কর্মজগতের সঙ্গে পরিচিত করা এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে দক্ষ ও উৎপাদনমুখী জনশক্তি তৈরি করা। বাস্তবে এ দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে হেয় চোখে দেখার একটা প্রবণতা আছে। ফলে উন্নত দেশগুলোয় ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ৬৫ শতাংশ কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় যুক্ত হলেও বাংলাদেশে এই হার মাত্র ১৭ শতাংশের মতো। অনেকে মনে করেন, প্রকৃত হার আরও কম।
দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যুক্ত হয়। এর অর্ধেকই যায় বিদেশে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে। অর্থাৎ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যত শ্রমবাজারের চাহিদা মেটাতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকার ২০৩০ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় নিবন্ধনের হার মোট নিবন্ধিত ছাত্রসংখ্যার যথাক্রমে ৩০ ও ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে চায়। কিন্তু এ চাওয়াকে বাস্তবায়নে তেমন তোড়জোড় নেই।
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সর্বশেষ ২০২৩-২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ১২ হাজার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক (টিভিইটি) প্রতিষ্ঠানে মোট আসন সংখ্যা মাত্র ১৭-১৮ লাখ। অন্যদিকে এসএসসি পাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে পলিটেকনিকে যায় মাত্র ১.৪%। তার ওপর আছে শিক্ষক সংকট। ৮২ শতাংশের মতো পদ খালি। কমেছে বাজেট বরাদ্দ। এ প্রস্তুতি নিয়ে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়।
বর্তমানে টিভিইটি শিক্ষায় শিল্প-কারখানার চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা তৈরি করা যাচ্ছে না। সিপিডির সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, ৮১ শতাংশ টিভিইটি শিক্ষার্থী ১০ হাজার টাকার কম বেতনে চাকরিজীবন শুরু করতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরির নিচে কোনো দিনমজুরও পাওয়া যায় না। এর অর্থ, একজন টিভিইটি শিক্ষার্থী যা শিখছে, তাতে নিয়োগকর্তারা সন্তুষ্ট নন। তাই কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। দক্ষ শ্রমিকের বেতন বেশি; বিদেশে গেলে রেমিট্যান্স আসে অনেক। কোনো কোনো সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা ৫০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব হলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৩ গুণ পর্যন্ত হতে পারে।
রেমিট্যান্স হলো আমাদের দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। দেশের অর্থনীতিকে পুষ্ট করতে হলে শ্রমবাজারে মেধাবীদের ব্যাপক হারে আকৃষ্ট করতে হবে। এ জন্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে কোণঠাসা অবস্থা থেকে বের করে এনে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোয় কারিগরি শিক্ষার ধারা চালু করতে না পারলে এ দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার দৈন্য কাটবে না। তাই সব অভিজাত প্রতিষ্ঠানে কারিগরি ধারা যুক্ত করতে হবে। এক সময় নামিদামি স্কুল-কলেজে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার পাশাপাশি শিল্পকলা নামে একটি আলাদা ধারা চালু ছিল। তাই গরিব মানুষের লেখাপড়ার বিষয় হিসেবে নয়, চ্যালেঞ্জিং ও মেধাবীদের পেশা হিসেবে ব্র্যান্ডিং করতে পারলে কারিগরি ধারা আবার চালু করতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
অনেকেই কারিগরি পেশাকে মিস্ত্রির পেশার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। ছাত্ররা কেরানি হওয়ার আশায় ঘুরে বেড়ায়; তবু মিস্ত্রির পেশায় যেতে চায় না। আসলে বর্তমান প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের যুগে দেশ-বিদেশের শ্রমবাজারে যে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রের উদ্ভব হয়েছে, সে সম্পর্কে তাদের ভালো ধারণা নেই। তাদের ধারণা নেই, বিদেশে আধুনিক প্রযুক্তির ভারী যন্ত্রপাতি অপারেটিং, ক্যাটারিং, আইটি, এইচভিএসি, স্বাস্থ্য, পর্যটন ইত্যাদি খাতে চ্যালেঞ্জিং কাজের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর দেশগুলোয় সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ক্লাউড কম্পিউটিং, ডেটা সায়েন্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার সিকিউরিটি, রোবটিক্স ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক দক্ষ জনশক্তির চাহিদা রয়েছে। এ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্যাদি সরকারিভাবে প্রচার করা হলে ছাত্ররা ক্যারিয়ার প্ল্যানিং করতে পারবে। তারপরও নেতিবাচক ধারণা থেকে রক্ষা করে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক ধারার লেখাপড়াকে জনপ্রিয় করার জন্য নতুন নামকরণ করা যেতে পারে। যেমন প্রি-ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রি-মেডিকেল ইত্যাদি।
কারিগরি শিক্ষায় ভাষার প্রশ্নটা বেশ প্রাসঙ্গিক। প্রযুক্তিবিষয়ক জ্ঞান যে গতিতে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে, আমাদের দেশে সে গতিতে উপযুক্ত পরিভাষা তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। তাই প্রযুক্তি শিক্ষাকে গতিশীল ও কার্যকর করার জন্য পাঠ্যপুস্তককে অপ্রয়োজনীয় ও দুর্বোধ্য পরিভাষা থেকে মুক্ত করতে হবে। উন্নত বিশ্বে অনেক দেশেই কারিগরি পেশার লোকজন কমপক্ষে দুটি বিদেশি ভাষায় যোগাযোগ করতে শেখে। আমাদের দেশেও শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী ইংরেজি, আরবি, চায়না, হিন্দি ভাষা শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। দেশে বিভিন্ন সংস্থার নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত কোর্সগুলোয় শিক্ষা শেষে প্রতিষ্ঠানভেদে ছাত্রদের অর্জিত দক্ষতায় বেশ তারতম্য দেখা যায়। এ অবস্থা দূর করতে হবে। শিক্ষার দক্ষতা পরিমাপ করার জন্য কারিগরি শিক্ষায় আউটকাম বেজ্ড এডুকেশন (ওবিই) বাস্তবায়ন
করে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন দক্ষতা তৈরির ব্যবস্থা নিতে হবে।
জার্মানিতে কারিগরি শিক্ষার্থীরা সপ্তাহের কয়েক দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়; বাকি ক’দিন কোনো কোম্পানি বা শিল্প-কারখানায় হাতেকলমে কাজের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে। এ প্রক্রিয়ায় বড় বড় কোম্পানি ও শিল্প গ্রুপকে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় সরাসরি যুক্ত করা হয়।
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় তরুণ শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করতে হলে কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে এর সংযোগ ভালোভাবে দৃশ্যমান, সেই সঙ্গে কারিগরি ও
বৃত্তিমূলক শিক্ষার ধারায় উচ্চশিক্ষার পথ আরও প্রশস্ত করতে হবে।
ড. মাহবুবুর রাজ্জাক: অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)