বাংলাদেশে বৈষম্য বলতে আমরা সাধারণত আয়, সুযোগ বা সামাজিক মর্যাদার পার্থক্য বুঝি। কিন্তু এই বৈষম্যের সবচেয়ে গভীর ও নীরব রূপটি লুকিয়ে আছে আমাদের চিন্তায়, সংস্কৃতিতে ও দৈনন্দিন আচরণে। এটিকে বলা যায় অন্তর্নিহিত বা মানসিক বৈষম্য।

চাকরিপ্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা হয়ে গেছে। প্রায় ১০০ জনের মধ্য থেকে মাত্র ৫ জনকে ডাকা হয়েছে মৌখিক পরীক্ষার জন্য। তাঁদের একজন নারী। লিখিত পরীক্ষায় তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন। শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকেও তিনি এগিয়ে।

ইন্টারভিউ বোর্ডে আমি ছাড়া সবাই নারী। তাঁদের প্রায় সবাই উপমহাদেশের প্রখ্যাত জেন্ডারবিশেষজ্ঞ প্রয়াত কমলা ভাসিনের দীক্ষাপ্রাপ্ত। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, চারজন পুরুষ প্রার্থীকে যেসব প্রশ্ন করা হয়নি, নারী প্রার্থীকে সেসব প্রশ্ন করা হচ্ছে।

প্রার্থীকে সক্ষমতা যাচাইমূলক প্রশ্নের বদলে তাঁর পারিবারিক দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন করার প্রতিযোগিতায় সবাই মেতে উঠলেন। তাঁর বিয়ের পরিকল্পনা, বিয়ের প্রথম বছরে সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা–অনিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন করা হলো। মা-বাবা মফস্​সলে থাকেন, তাঁরা ঢাকায় এসে মেয়ের সঙ্গে থাকতে চাইবেন কি না; ভবিষ্যৎ স্বামীর যদি বদলির চাকরি হয়, তাহলে তিনি এই চাকরির হ্যাপা সামলাতে পারবেন কি না, তা–ও বাদ গেল না। এ রকম ঘটনা এক–দুবার নয়, বারবার ঘটেছে।

নারীর প্রতি বৈষম্য না করার প্রশিক্ষণ কর্মশালায় আমরা যতই অংশগ্রহণ করি না কেন, আমাদের মনমগজে গেঁথে থাকা বৈষম্যের লেজ সোজা হওয়ার নয়। এই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া বা সোশ্যালাইজেশন প্রসেস আমাদের মগজে-মেজাজে গজানো বৈষম্যের চারায় সার–পানি দিতে থাকে। তাতে গাছটি তরতর করে বড় হতে থাকে।

এই বিষবৃক্ষ এতই ‘পয়মন্ত’ যে সেটি চিন্তায়, ভাবনায়, মননে সংস্কৃতির পরতে পরতে বৈষম্যকে বসিয়ে দেয়। ফলে মনের অজান্তেই আমরা বৈষম্যমূলক আচরণ করি। একেই মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অবচেতন পক্ষপাত বা আনকনসাস বায়াস। সেখান থেকেই চাকরির সাক্ষাৎকারে নারী প্রার্থীকে বিব্রতকর প্রশ্ন করা হয়।

যাঁরা ফার্মগেট থেকে বাসে উঠে এদিক-ওদিক যাতায়াত করেন, তাঁরা লক্ষ করবেন, স্কুল-কলেজে যাওয়ার সময় শুধু ড্রেস দেখার পর বাসের চালকের সহকারী বা কন্ডাক্টরের গলার স্বর ও কথা বলার ভঙ্গি বদলে যায়। বাজারে কদর বেশি, এমন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আচরণ আর কম কদরের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আচরণের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য চোখে পড়ে।

আমাদের স্কুলেও দেখেছি, ঈদের ছুটির পর অনেকেই স্কুলড্রেসের বদলে ঈদের জামা পরে আসত। সেদিন শিক্ষকদের চোখেমুখে একধরনের অচেতন পক্ষপাতের ছাপ পড়তই। আমাদের অবচেতন মন কীভাবে যেন শিখিয়ে দিয়েছিল, পুরুষেরা পরিবারের কর্তা হবে, মেয়েদের দায়িত্ব সীমিত। 

ভিন্ন ধর্ম, জাতি বা পেশার মানুষকে মনে মনে অনুৎকৃষ্ট বা দ্বিতীয় শ্রেণির ভাবার কাজটাও শুরু হয় অবচেতন পক্ষপাত থেকে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাছে বাড়ি ভাড়া না দেওয়া, ফ্ল্যাট বিক্রি না করা, শুভেচ্ছা বিনিময় থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ড দেখা যায়।

বৈষম্য মগজে বাসা বাঁধে কীভাবে

আমাদের লোকগাথা, রূপকথা, প্রচলিত বাগ্​ধারা, শ্লোক—সর্বত্রই হয় বৈষম্যকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে অথবা বৈষম্যের প্রচার–প্রসার করার চেষ্টা করা হয়েছে। ‘গরিবের আবার মান-ইজ্জত কী’—এসব কথা আমাদের মনের গভীরে আটকে থাকা এক অবচেতন বৈষম্যমূলক মনোভাবের আলামত।

আমাদের প্রবাদ-প্রবচন ও লোককথাও এই বৈষম্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।

১.

লিঙ্গবৈষম্য

মেয়েদের স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল ও অক্ষম হিসেবে তুলে ধরার জন্য বলা হয়, ‘মেয়ে মানুষের মাথায় বুদ্ধি কম।’ নিজের গর্ভে বা ঔরসে জন্ম নেওয়া মেয়েটিকে লক্ষ্মী বললেও তাকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকে বলি, ‘মেয়ে মানেই পরের ধন।’ মেয়েকে পরিবারের সম্পদ নয়, বোঝা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। মেয়েদের একটা ‘লক্ষণরেখার’ মধ্যে আটকে রাখার ইচ্ছা থেকে বলি, ‘নারীর স্থান রান্নাঘরে’। এটা মেয়েদের ঘরোয়া কাজেই সীমাবদ্ধ রাখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

শিক্ষার্থীরাও শ্রেণিকক্ষে ও রাস্তাঘাটে নানা বৈষম্যের শিকার হয়

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

অতিরিক্ত মোটা হওয়ায় যাত্রীকে তুলতে অস্বীকৃতি উবার চালকের

চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার জন্য সম্প্রতি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান উবারের একটি গাড়ি ডেকেছিলেন মাইকেল। গাড়িটি আসার পর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে যেতেই বাধল বিপত্তি। ‘অতিরিক্ত মোটা’ হওয়ায় চালক তাঁকে গাড়িতে তুলতে অস্বীকৃতি জানান। যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

গেমিং প্ল্যাটফর্ম টুইচের জনপ্রিয় স্ট্রিমার মাইকেল। ওই প্ল্যাটফর্মে তাঁর ৬০ হাজারের বেশি সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। তিনি তাঁর কল অব ডিউটি গেমপ্লের জন্য পরিচিত।

মাইকেল সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। ভিডিওর শিরোনামে তিনি লিখেছেন, ‘আমি মজা করছি না। আমার উবার চালক বলেছেন, আমি নাকি অনেক বেশি মোটা। তাই তাঁর গাড়িতে আমাকে নেওয়া সম্ভব নয়। এমনকি তিনি আমার দিকে বন্দুক তাক করার হুমকিও দিয়েছেন।’ মাইকেলের ওই ভিডিও পাঁচ কোটিবারের বেশি দেখা হয়েছে।

ভিডিওতে দেখা যায়, মাইকেল উবারের গাড়িচালককে বলছেন, ‘আপনি এইমাত্র বললেন, আমি নাকি অনেক বেশি মোটা। আমি কিন্তু আপনার ভিডিও করছি।’ উত্তরে উবার চালক নারী বলেন, ‘এটা যুক্তি আর বাস্তবতার ব্যাপার। আর আমি এটা বলার অধিকার রাখি।’ কিন্তু বাক্যটি শেষ করার আগেই মাইকেল তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘না, আপনি এটা বলতে পারেন না।’ তখন ওই নারী হাত উঁচিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি পারি। এটা আমার গাড়ি। আপনি এখান থেকে চলে যান।’

বাগ্‌বিতণ্ডার একপর্যায়ে ওই উবার চালক বলেন, ‘আপনি কি চান, আমি আমার বন্দুকটা বের করি?’ এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মাইকেল গাড়ির দরজা বন্ধ করে সেখান থেকে চলে যান। এক্সে দেওয়া অন্য একটি পোস্টে মাইকেল বলেন, এ ঘটনার কারণে তিনি সেদিন চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেননি।

উবারের নীতি অনুযায়ী, চালকেরা বৈধ কারণ ছাড়া কোনো যাত্রীকে গাড়িতে তুলতে অস্বীকৃতি জানাতে পারবেন না। ওজন, লিঙ্গ, বর্ণ কিংবা ধর্মের ভিত্তিতে কোনো যাত্রীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

এই ঘটনা ভাইরাল হওয়ার পর উবার চালকের আচরণের তীব্র সমালোচনা করেছেন অনেকে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নিফাক শব্দের অর্থ কী এবং মুনাফিকের লক্ষণগুলো কী
  • হবিগঞ্জে কনসার্টে বিশৃঙ্খলার পর নারীদের হেনস্তা ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ
  • পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা ভিনগ্রহের বস্তু নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ইলন মাস্ক
  • অতিরিক্ত মোটা হওয়ায় যাত্রীকে তুলতে অস্বীকৃতি উবার চালকের