সেই মাহুত বললেন, ‘হাতির কাছে গেলে আমার কইলজা ফাইটা যায়’
Published: 31st, March 2025 GMT
গত বছর ঈদুল ফিতরে রাজধানীর মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানার মাহুত আজাদ আলী ও তাঁর ছেলে জাহিদ হাসান একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেন। পরে একসঙ্গে ভাত খান। খাওয়া শেষে নিজেই ছেলেকে নিয়ে হাতির খাঁচায় যান আজাদ। সেখানে রাজা বাহাদুর নামের হাতির আক্রমণে ছেলের মৃত্যু হয়।
আজ জাহিদ হাসানের মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হয়েছে। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় গ্রামের বাড়িতে মৃত্যুবার্ষিকীতে ছোট পরিসরে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
মাহুত আজাদ আলীর সঙ্গে আজ মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে জানান, ছেলের মৃত্যুর পর থেকে চিড়িয়াখানার হাতি শাখায় কাজ করতে ইচ্ছে করে না তাঁর। তাই অন্য শাখায় স্থানান্তরের জন্য আবেদন করেছেন। তবে কাজ হচ্ছে না।
আজাদ আলী বলেন, ‘প্রতিদিন সকালবেলা আমি হাতির কাছে গেলে আমার কইলজা (কলিজা) ফাইটা টুকরা টুকরা হই যায় ভাই। যে হাতিডা আমার ছেলেরে আছাড়িয়া মারছে, এই জিনিসটা ব্যবহার করিয়া, এই জিনিস পালিয়া আমি ভাত খাইমু ভাই। আল্লায় কি মানুষরে দুনিয়ায় একটাই কর্ম দিছে, আর কোনো কর্ম দেয় নাই?’
অস্থায়ী কর্মচারী হিসেবে আজাদ আলী চিড়িয়াখানায় কর্মরত আছেন। তাঁর দুই-আড়াই লাখ টাকা ঋণ আছে বলে জানান। হাতি শাখায় কাজ করতে ইচ্ছে না করলেও ঋণের কারণে চাকরিও ছাড়তে পারছেন না বলে জানান তিনি।
চিড়িয়াখানায় আগে তিনটি হাতি ছিল। চিড়িয়াখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে রাজধানীর হাতিরঝিলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দুটি হাতি জব্দ করে র্যাব। সেই হাতি দুটি দিয়ে চাঁদাবাজি করা হতো। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জব্দের পর সেই হাতি দুটি চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসেন আজাদ।
সেই হাতি দুটির নাম রাজা বাহাদুর ও পান্না বাহাদুর। এর মধ্যে গত বছর ঈদুল ফিতরের দিন রাজা বাহাদুরের আক্রমণে জাহিদ হাসানের মৃত্যু হয়।
আজাদ আলীর অভিযোগ, অতিরিক্ত দুটি হাতি চিড়িয়াখানায় আনা হলেও তার জন্য পর্যাপ্ত জনবল ছিল না। ফলে ছেলের মৃত্যুর পর থেকে হাতি দুটি সরিয়ে দেওয়ার দাবিও জানান তিনি।
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে বলেছে, মাহুতের ছেলের মৃত্যুর পর হাতি দুটি মূল মালিকের কাছে ফেরত দেওয়া যায় কি না, সেই বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে মতামত চেয়েছিল তারা। মন্ত্রণালয় বলেছিল, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন থাকায় রায়ের আগে হস্তান্তর করার সুযোগ নেই।
আজাদ আলীকে অন্য শাখায় স্থানান্তর প্রসঙ্গে জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, আজাদ অন্য শাখায় যাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। তবে তিনি প্রশিক্ষিত মাহুত। তাঁর কাজ অন্য কেউ করতে পারে না। তাই তাঁকে অন্য শাখায় দিলে যে শূন্যতা তৈরি হবে, সেই জায়গা পূরণ করা যাচ্ছে না।
তবে আজাদ আলীর দায়িত্বের জায়গায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে জানান রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আজাদের ছেলেকে যে হাতি মেরেছে, সেটির কাছে না গিয়ে অন্য হাতির পরিচর্যা করতে বলা হয়েছে তাঁকে।
যে দুটি হাতি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে চিড়িয়াখানার কাছে এসেছে, সেগুলো হস্তান্তর করা গেলেও চাপ কমে যাবে। তখন আজাদ আলীকে অন্য জায়গায় দেওয়া সম্ভব হবে বলেও জানান জাতীয় চিড়িয়াখানার এই পরিচালক।
দুর্ঘটনা হলে ক্ষতিপূরণ দেয় না চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষজাতীয় চিড়িয়াখানায় এর আগেও এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালের ৮ জুন হায়েনার কামড়ে মো.
সুমন মিয়া আজ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, তিনি ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। ছেলে যখন আক্রান্ত হয়, তখন তিনি পরিবার নিয়ে গাজীপুর থাকতেন। সেখানকার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। সংসার ভালোভাবে না চলায় মাসখানেক আগে রংপুরের পীরগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। সেখানে এসে কাঠমিস্ত্রির কাজ করছেন।
আরও পড়ুনজাতীয় চিড়িয়াখানায় হাতির আক্রমণে মাহুতের ছেলের মৃত্যু১১ এপ্রিল ২০২৪সুমন মিয়া বলেন, একদিকে তাঁর সংসার ঠিকমতো চলে না, অন্যদিকে ছেলে প্রতিবন্ধী হয়ে আছে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের কাছে আর্থিক সহযোগিতা চেয়েও পাননি।
মাহুত আজাদ আলী জানান, তিনিও চিড়িয়াখানার কাছে আর্থিক সহযোগিতা চেয়ে পাননি। জাহিদ তাঁর একমাত্র ছেলেসন্তান ছিল। এখন তাঁর দুই কন্যাসন্তান রয়েছে। এ অবস্থায় পরিবারের সুরক্ষার স্বার্থে তাঁর চাকরি রাজস্ব খাতে নেওয়ার দাবিও জানিয়েছিলেন তিনি। তা-ও পূরণ হয়নি।
এ বিষয়ে জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে বলেছে, চিড়িয়াখানায় কাউকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো বিধান বা তহবিল নেই। এমনকি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঝুঁকি ভাতা দেওয়ার বিধানও নেই। সে কারণেই কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সহযোগিতা করার সুযোগ থাকে না।
আরও পড়ুনচিড়িয়াখানায় হাতির আক্রমণে মাহুতের ছেলের মৃত্যু, কী ঘটেছিল তখন১২ এপ্রিল ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক অন য শ খ য়
এছাড়াও পড়ুন:
আইএমএফের পর্ষদ বৈঠক ২৩ জুন, এরপর মিলতে পারে দুই কিস্তি অর্থ
২৩ জুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচির দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি উত্থাপনের কথা রয়েছে। বৈঠকে অনুমোদন হলে চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় একসঙ্গে দুই কিস্তির অর্থ পাবে বাংলাদেশ। আইএমএফ গতকাল শুক্রবার তার কার্যসূচিতে নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকের এ তারিখ নির্ধারণসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আইএমএফের এ বৈঠকে চলমান ঋণ কর্মসূচির তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যালোচনার (রিভিউ) প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এ প্রতিবেদন পর্ষদ অনুমোদন করলে বাংলাদেশ একসঙ্গে পেয়ে যাবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ। দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে হতে পারে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
এর আগে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ঋণ অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকিতে থাকা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে এ ঋণ কর্মসূচি। চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, টাকার দরপতন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া—মূলত এ তিন কারণে ওই সময় আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির মধ্যে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিলসহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ১৪০ কোটি ডলার। আরএসএফ আইএমএফের একটি নতুন তহবিল, যেখান থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকেই প্রথম ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে এখন পর্যন্ত ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার।
আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ গত বছরের ডিসেম্বরে পাওয়ার কথা থাকলেও তা আর পাওয়া যায়নি। আইএমএফের সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত। প্রায় প্রতিবছর ওয়াশিংটনসহ প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে বড় ধরনের তুষারপাত হয়। গত বছরও তাই হয়েছে। অতিমাত্রার বরফের কারণে অচল হয়ে যায় জনজীবন। মার্কিন প্রশাসন সতর্কবার্তা জারি করে। তুষারপাতের কারণে আইএমএফসহ অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল অনেক দিন।
পরে আইএমএফের পক্ষ থেকে প্রথমে এ বছরের ফেব্রুয়ারি ও পরে মার্চে পর্ষদ বৈঠকের কথা বলা হয়। গত এপ্রিলে আইএমএফের একটি দল পর্যালোচনা করতে ঢাকায় আসে দুই সপ্তাহের জন্য। এর মধ্যে শর্ত পরিপালন নিয়ে দর–কষাকষিতে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় আটকে যায়। এরপর ওয়াশিংটনে গত ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তখন দর-কষাকষি হচ্ছিল মূলত মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা নিয়ে। আইএমএফ তা চাইলেও করতে চাইছিল না সরকার।
সবশেষে গত মাসে এ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কয়েকটি ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১২ মে দুই পক্ষ চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছায় ও বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে বাংলাদেশ। ১৪ মে আইএমএফ ওয়াশিংটন থেকে এক বিবৃতিতে জানায়, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে এবং ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে জুনে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত পর্ষদ বৈঠকে অনুমোদন হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মাথায় আইএমএফ অর্থ ছাড় করে দেয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।