এবারের রোজার ঈদে দেশীয় পণ্যের প্রতি ছিল ক্রেতা-ভোক্তার বিশেষ ঝোঁক। বিদেশি পণ্য খুব একটা সহজলভ্যও ছিল না। বিশেষ করে ভারতীয় পণ্যের দাপট এবার দেখা যায়নি। গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর ভারত যেতে ভিসা জটিলতার প্রভাবও ছিল ঈদবাজারে। যারা ঈদের কেনাকাটায় ভারতে যান, তাদের একটা বড় অংশই ভারতে যেতে পারেননি এবার। চিকিৎসা কিংবা বেড়ানোর জন্য যারা ভারতে যান, তারাও ঈদে উপলক্ষ করে কেনাকাটা করে থাকেন। এবার সে ব্যবস্থা একরকম বন্ধ ছিল। সব মিলিয়ে দেশীয় পণ্যের একচেটিয়া দাপট ছিল এবারের ঈদবাজারে। আবার তুলনামূলক রাজধানীর চেয়ে মফস্বল শহরে এবার বিকিকিনি ভালো হয়েছে। এর একটা বড় অংশই ছিল বাচ্চাদের পোশাক।

আকাশযাত্রার টিকিট কিংবা ফার্নিচারের মতো আইটেমেরও বেচাকেনা বাড়ে ঈদে। সাধারণত পোশাক, প্রসাধনী ও বৈদ্যুতিক পণ্যকে ঈদ আইটেম হিসেবে গণ্য করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, এবার ঈদের বাজার ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার। এটি গত বছরের রোজার ঈদের চেয়ে কিছুটা কম। ওই ঈদে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। সারাদেশের ৭০ লাখ দোকান থেকে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ হিসাব করা হয়। সমিতির হিসাবমতে, শুধু রাজধানীতে ছোট-বড় বিপণিকেন্দ্র প্রায় আড়াই লাখ। দোকান আছে ৬০ লাখের মতো।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান টিপু গতকাল বুধবার সমকালকে বলেন, এবার ঈদে ব্যবসা পরিচালনা অনেকটাই মসৃণ ছিল। অন্যান্য বছররের মতো এবারে ঈদে বাজারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দিক থেকেও হয়রানি ছিল না। দেশি-বিদেশি পণ্যের শ্রেণিকরণ খুব সুস্পষ্ট ছিল। এ নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। এবার প্রত্যাশা অনুসারে বেচাবিক্রি হয়নি। গত বছরের চেয়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো কম হয়েছে বিক্রি। যদি ভারতে আগের মতোই যাতায়াত সহজ হতো, তাহলে ঈদে দেশে বেচাবিক্রির পরিমাণ আরও কমে যেত। কারণ, কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ‍অনেকেই কেনাকাটা করে থাকেন।

এবার কেনাবেচার পরিমাণ কম হওয়ার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, আগে যে রকম মানুষের হাতে বাড়তি অর্থ থাকত, এবার সে সুযোগ নেই। যাদের বাড়তি টাকা থাকে, তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়তি কেনাকাটা করে থাকেন। আবার বেসরকারি প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই বেতন বা বোনাস হয়েছে। একসঙ্গে বেতন-বোনাস পেয়েছেন– এরকম খুব কমই হয়েছে।

দেশীয় পণ্য ভিনদেশি নামে
জানা গেছে, এবারের ঈদে দেশীয় অনেক বস্ত্র ও পোশাক ভারতীয় ও পাকিস্তানি নামে বাজারে বিক্রি হয়েছে। আবার বিদেশি কিছু পণ্য ঈদকে টার্গেট করে এবার অনেকটা আগেভাগেই দেশের বাজারে ঢুকেছে। এ কারণে দেশীয় বস্ত্র ও পোশাক বিক্রির পরিমাণ অন্তত ২০ শতাংশ কম হয়েছে। জানতে চাইলে বেসরকারি বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক এবং লিটিল গ্রুপের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম সমকালকে বলেন, ভিন্ন রাজনৈতিক পরিবেশে এবার ঈদের মানুষের মনোভাবকে পুঁজি করেছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। অনেকের মধ্যে ভারতবিদ্বেষি একটা মনোভাব রয়েছে– এরকম অনুমান থেকে ভারত থেকে আনা বস্ত্র ও পোশাককে পাকিস্তানি বলেও চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার দেশীয় বস্ত্র ও পোশাককেও পাকিস্তানি পণ্য দাবি করে দ্বিগুণ দাম রাখা হয়েছে। দেশীয় বস্ত্র ও পোশাকের মধ্যে কোনো কোনো আইটেমের মান ভারত, পাকিস্তান কেন– যে কোনো দেশের একই আইটেমের চেয়ে ভালো। এ কারণেই দেশীয় পণ্যকে বিদেশি বলে চালিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। তাঁর মতে, দেড় লাখ কোটি টাকার এবারের ঈদবাজারের মধ্যে শুধু বস্ত্র ও পোশাকের পরিমাণ হবে অন্তত ৮৫ হাজার কোটি টাকার। সারাবছর দেশীয় বস্ত্র এবং পোশাকের বাজারের আকার ১২ বিলিয়ন ডলার। এর একটি অংশই ঈদকেন্দ্রিক। পাজামা, পাঞ্জাবি, শাড়ি, লুঙ্গি, শার্ট, গেঞ্জিসহ পরিধেয় সব বস্ত্র ও পোশাকই রয়েছে এর মধ্যে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র পর ম ণ ব যবস আইট ম

এছাড়াও পড়ুন:

কালিদাসের হাত ধরে যে জামুর্কীর সন্দেশের যাত্রা, তার জিআই স্বীকৃতিতে খুশি সবাই

দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে করেছিলেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার জামুর্কী গ্রামের প্রয়াত কালিদাস চন্দ্র সাহা। এ জন্য তাঁর বাবা মিষ্টি ব্যবসায়ী প্রয়াত মদনমোহন সাহা তাঁকে সংসার থেকে আলাদা করে দেন। এরপর মিষ্টির দোকানের আশপাশে বসে থাকতে থাকতে একসময় তিনি সন্দেশ বানাতে শুরু করেন। সেটা ১৯৪০ সালের কথা।

একসময় কালিদাসের বানানো এই সন্দেশ জামুর্কীর সন্দেশ হিসেবে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সন্দেশ এবার ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। গতকাল বুধবার টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরীফা হকের হাতে জামুর্কীর সন্দেশের জিআই নিবন্ধন সনদ তুলে দেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে জামুর্কীতে গিয়ে দেখা গেল, ‘কালিদাস মিষ্টান্ন ভান্ডার’ নামের চৌচালা টিনের ঘর। পুরোনো দোকান। বাড়তি কোনো চাকচিক্য নেই। সাদামাটা কাচঘেরা তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সন্দেশ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেচাকেনা বাড়ছে।

স্থানীয় কয়েকজন বলেন, কালিদাস ১৯৮২ সালে মারা যান। তারপর তাঁর বড় ছেলে সমর চন্দ্র সাহা ব্যবসার হাল ধরেন। আরেক ছেলে গৌতম সাহা লন্ডনপ্রবাসী।

টাঙ্গাইলের ঘাটাইল সদরের একটি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আসাদুজ্জামান আত্মীয় বাড়ি যাচ্ছিলেন। পথে বিরতি দিয়ে সন্দেশ কিনতে ওই দোকানে আসেন। তিনি বলেন, ‘আগেও এই দোকানের সন্দেশ খেয়েছি। আজও নিচ্ছি। এর গুণগত মান সব সময় ভালো।’

জিআই পণ্যের স্বীকৃতিতে স্থানীয় লোকজনও খুশি। জামুর্কী গ্রামের ফিরোজ আলম মোক্তার বলেন, এই সন্দেশের স্বীকৃতি আরও আগেই পাওয়া উচিত ছিল। এই সন্দেশের মান যাতে বজায় থাকে, এ জন্য মালিকদের ইচ্ছা থাকতে হবে।

বর্তমান মালিক সমর চন্দ্র সাহাকে পাওয়া গেল জামুর্কী কাঁচাবাজারে। এ সময় বাজারের ব্যবসায়ীরা তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন। বাজারের মাতৃভান্ডারের মালিক প্রকাশ বাকালী বলেন, ‘বাবার মুখে যেমন শুনেছি, সন্দেশ এখনো তেমনই আছে। এটা আমাদের গর্ব। আমার বুক ভরে গেছে।’

সমর চন্দ্র সাহা বলেন, বাবার মৃত্যুর পর ছাত্রাবস্থায় তিনি দোকানে বসতে শুরু করেন। সেই থেকে এখনো আছেন। সন্দেশ খেয়ে মানুষ প্রশংসা করেন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জামুর্কী বাসস্ট্যান্ডে এক অনুষ্ঠানে এসে দোকানটিতে এসেছিলেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এসেছেন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ এসেছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মাঝেমধ্যে আসেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এক মাস আগেও এসেছিলেন। ২০১৩ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতাল পরিদর্শনে এলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে এই সন্দেশ দিয়ে আপ্যায়ন করে। তাঁর কথা, ‘ট্যাকাপয়সা কিছু না। এই স্বীকৃতি বিশাল ব্যাপার। আমরা মান ভালো করি। কাস্টমাররা আমাদের পছন্দ করেন। সন্দেশ কিনতে এসে দোকানে বসে গল্প করেন। আমার খুবই ভালো লাগে। খুশির এই সময় আমার বাবা-দাদাকে খুব মনে পড়ছে। আমি তাঁদের স্মরণ করি।’

দোকান দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রেমা সাহা বলেন, ‘আমি ৪০ বছর ধরে দোকানে আছি। কাস্টমারকে আমরা আপন মনে কইরা সেবাটা দেই। আমরা জিনিস ভালা বানাই। এ জন্য সরকারও স্বীকৃতি দিছে।’

মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আরিফুল ইসলাম বলেন, সন্দেশের জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানাভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ স্বীকৃতি মির্জাপুরবাসীর।

দোকানটিতে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সন্দেশ বিক্রি হয়। চিনি ও গুড়ের তৈরি দুই ধরনের সন্দেশের বর্তমান বাজারমূল্য প্রতি কেজি ৮০০ টাকা। দুধ থেকে ছানা তৈরির পর এলাচি, চিনি অথবা গুড় দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে সন্দেশ বানানো হয়। প্রায় প্রতি ঘণ্টায় চুলা থেকে একটি করে বড় কড়াই নামানো হয়। একটি কড়াই থেকে প্রায় ৩০ কেজি সন্দেশ বানানো যায়। দোকানটিতে সন্দেশ ছাড়াও চমচম, রসগোল্লা, রসমালাই, দই ও ঘি বিক্রি করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ