মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখতে পাব, তা আমার ধারণায় ছিল না। আমি ভাবতাম, মৃত্যু হুট করেই আসে, আমরা এটা অনুভব করতে পারি না। তবে এ যুদ্ধ চলাকালে তারা ধীরে ধীরে আমাদের সব পরিস্থিতিরই মুখোমুখি করেছে।

ঘটনা ঘটার আগেই আমরা ভুগছি। যেমন বাড়িতে বোমা হামলার আশঙ্কা আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে রেখেছে।

শুরু হওয়া সে যুদ্ধ এখনো আছে, কিন্তু ভয়ের সেই অনুভূতি ভেতরে চাপা থেকে গেছে। এই ভয় আমার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। এমনকি আমার মনে হচ্ছে, এটা আর কোনো ধকল নিতে পারবে না।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আমাদের অনেক কাছাকাছি চলে আসা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে সামলাতে আমি হিমশিম খাচ্ছি। আমার মনে আছে, যখন নেতজারিম এলাকা থেকে ট্যাংকগুলো ঢুকছিল, তখন আমি স্তম্ভিত হয়ে আমার সব বন্ধুর কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলাম: ‘তারা গাজায় কীভাবে ঢুকল? আমি কি স্বপ্ন দেখছি?!’

তারা কবে গাজা থেকে সরবে, এটি আবার কবে মুক্ত হবে, সে অপেক্ষায় আছি আমি।

এখন আমি যেখানে থাকি, সেই আল–ফুখারি এলাকার খুব কাছে চলে এসেছে ইসরায়েলি সেনারা। খান ইউনিসের পূর্বে এবং রাফার উত্তরে এর অবস্থান। এটি এমন একটি জায়গা, যেখানে খান ইউনিস এলাকার শেষ এবং রাফার শুরু।

তারা এতটাই কাছে চলে এসেছে যে আমরা প্রতিনিয়ত ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের অবিরাম সেসব শব্দ শুনতে হচ্ছে।

এ যুদ্ধ ভিন্ন ধরনের। আমার আগের অভিজ্ঞতার চেয়ে এটা অনেকটাই আলাদা।

আমি নিতান্তই একটা সংখ্যা হতে চাই না।

মৃতদের ‘অজ্ঞাত ব্যক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করা বা গণকবরে শুইয়ে দিতে দেখার পর থেকে আমার মাথায় বিষয়টা গেঁথে আছে। এর মধ্যে কিছু কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গও আছে, যা শনাক্তই করা যায়নি।

এটা কি সম্ভব যে আমার কাফনের ওপর শুধু ‘কালো/নীল ব্লাউজ পরা তরুণী’ লেখা থাকবে?

আমি কি ‘অজ্ঞাত ব্যক্তি’ হিসেবে মারা যাব, শুধুই একটি সংখ্যা হিসেবে?

আমি চাই, আমার আশপাশে থাকা প্রত্যেকে আমার গল্প মনে রাখুক। আমি কোনো সংখ্যা নই।

আমি সেই মেয়ে যে কিনা গাজায় কঠোর অবরোধ চলাকালে অন্য রকম পরিস্থিতিতে হাইস্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে বাবাকে সহযোগিতা করার জন্য সব জায়গায় কাজ খুঁজছিলাম। কারণ, অবরোধের কবলে পড়ে আমার বাবা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং বেশ কয়েকবার চাকরি হারিয়েছেন।

আমি আমার পরিবারের বড় মেয়ে এবং আমি আমার বাবাকে সহযোগিতা করতে চাই। আমি চাই আমাদের থাকার জন্য একটি ভালো বাড়ি থাকুক।

অপেক্ষা করুন.

..আমি কিছুই ভুলতে চাই না।

আমি একজন শরণার্থী। আমার দাদা-দাদি শরণার্থী ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি দখলদারির কারণে তাঁদের নিজের জমি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল।

আমার দাদা-দাদি গাজা উপত্যকায় যান এবং শহরের পশ্চিমে খান ইউনিসে শরণার্থীশিবিরে থাকতেন।

ওই শিবিরে আমার জন্ম, তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাকে সেখানে জীবন কাটাতে দেয়নি।

২০০০ সালে ইসরায়েলি বাহিনী আমাদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। দুই বছর আমাদের আশ্রয়হীন থাকতে হয়েছে। আমরা বসবাসের অযোগ্য একটি বাড়ি থেকে আরেকটিতে স্থানান্তরিত হতে থাকলাম। ২০০৩ সালে আইএনআরডব্লিউএ আল–ফুখারিতে আমাদের আরেকটি বাড়ি না দেওয়া পর্যন্ত এমন অবস্থাই চলতে থাকল।

কৃষিজমিতে ভরা এই এলাকা দারুণ। আমরা সেখানে জীবন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যেখানটায় আমরা থাকতাম, তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ইউরোপিয়ান হাউজিং’। সেখানে অবস্থিত ইউরোপিয়ান হাসপাতালের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়।

বাড়িটি ছোট ছিল। মা-বাবাসহ পাঁচজনের পরিবারের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। বাড়িতে বাড়তি রুমের প্রয়োজন ছিল, একটি লিভিং রুমের প্রয়োজন ছিল। রান্নাঘরে সংস্কার করানোর দরকার ছিল।

যা–ই হোক, প্রায় ১২ বছর আমরা সেখানে ছিলাম। যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব, ২০১৫ সালের দিকে আমি বাবাকে সহযোগিতা করার জন্য কাজ শুরু করলাম। আরাম করে থাকার মতো একটি বাড়ি বানাতে আমি তাঁকে সাহায্য করলাম। হ্যাঁ, আমরা সেটা করতে পেরেছিলাম। তবে তা খুব কষ্টসাধ্য ছিল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর মাত্র তিন মাস আগে আমাদের বাড়ি তৈরির কাজ শেষ হয়।

হ্যাঁ, আমাদের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী প্রায় ১০ বছর ধরে তিলে তিলে আমরা বাড়িটি পুনর্নির্মাণ করেছি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে আমরা বাড়ির কাজ শেষ করি।

যুদ্ধ শুরুর আগেই গাজায় অবরুদ্ধ অবস্থা ও দুর্বিষহ জীবন নিয়ে আমি হিমশিম খাচ্ছিলাম। এরপর যুদ্ধ আমাকে পুরোপুরি নিঃশেষ করে দিল, আমার হৃদয়কে দুমড়ে–মুচড়ে দিল এবং আমি আমার মনোযোগের কেন্দ্র হারিয়ে ফেললাম।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আমরা কিছুর জন্য লড়াই চালাচ্ছি। টিকে থাকার জন্য লড়ছি, ক্ষুধা বা তৃষ্ণায় যেন মারা না যাই, তার জন্য লড়ছি। যেসব ভয়াবহতা আমরা দেখছি, তার জন্য যেন মনোবল না হারিয়ে ফেলি, সেটা নিশ্চিত করার জন্য সংগ্রাম করছি।

আমরা যেকোনো উপায়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। আমরা বারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছি। আমার জীবনে আমি চারটি বাড়িতে থেকেছি এবং কাছাকাছি জায়গায় ইসরায়েলি বোমা হামলার ঘটনায় প্রতিটি বাড়িই ধ্বংস হয়েছে।

আমাদের থাকার কোনো নিরাপদ জায়গা নেই। যুদ্ধবিরতির আগে আমরা ৫০০ দিন আতঙ্কে কাটিয়েছি।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে যুদ্ধের সময় আমি যা করিনি, তা হলো কান্না। আমি শক্ত থাকার চেষ্টা করেছি এবং আমার দুঃখ ও রাগ ভেতরে চেপে রেখেছি। এতে আমার হৃৎপিণ্ডের ওপর চাপ পড়েছে, এটি আরও দুর্বল হয়ে গেছে।

আমি আমার চারপাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সবার প্রতি ইতিবাচক ছিলাম এবং সমর্থন দিয়েছিলাম। হ্যাঁ, উত্তরের মানুষেরা ফিরে আসবে। হ্যাঁ, সেনাবাহিনী নেতজারিম থেকে সরে যাবে। আমি সবাইকে সাহস জোগাতে চেয়েছিলাম, যদিও আমার ভেতরে একটা বিরাট দুর্বলতা ছিল, যা আমি দেখাতে চাইনি।

আমার মনে হয়েছিল, যদি এটি দেখিয়ে ফেলি, তাহলে আমি এই ভয়াবহ যুদ্ধে শেষ হয়ে যাব।

যুদ্ধবিরতি ছিল আমার বেঁচে থাকার বড় আশা। আমার মনে হয়েছিল, আমি টিকে গেছি। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।

২০২২ সালে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রুওয়াইদা আমির

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র র জন য ইসর য় ল আম র ম আম দ র অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা

রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।

এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”

আরো পড়ুন:

ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত

ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত

উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”

সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”

এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।

বিবৃতিতে  বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে। 

ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।

ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।

ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।

এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ