ফারাহ আবু কায়নাসের স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হওয়ার। গত বছর ইসরায়েলের হামলায় এ তরুণী এতটাই আহত হন যে, শেষ পর্যন্ত বাঁ পা কেটে ফেলতে হয়, যা তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে অনিশ্চয়তায় ফেলে। এর মধ্য দিয়ে ২১ বছরের ফারাহ গাজার হাজার হাজার অঙ্গহারা মানুষের তালিকায় যুক্ত হলেন। তিনি এখন একটি অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরে থাকেন। নিজ এলাকায় একটি ফিজিওথেরাপি কেন্দ্রেও যাওয়া আসা করছেন, যেখানে তাঁকে একটি কৃত্রিম পা দেওয়া হতে পারে বলে আশা করছেন।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার এক সময়ের প্রাণোচ্ছল তরুণী ফারাহ বলেন, ‘ওই দিন আমি পায়ের চেয়েও বেশি কিছু হারিয়েছিলাম। আমার স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে গেছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে পড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু এভাবে আহত হওয়ায় আমার ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে গেছে।’
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলে ১ হাজার ২০০ জন নিহত হওয়ার পর শুরু হয় গাজায় হামলা। এতে এ পর্যন্ত ৫০ হাজার বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ১০ হাজারের বেশি। গাজার উপকূলীয় ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হন ২০ লাখের বেশি মানুষ। ইসরায়েলের হামলায় গাজার পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। অঙ্গ হারান হাজার হাজার মানুষ।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ওসিএইচএ বলছে, পুরো গাজায় আনুমানিক সাড়ে চার হাজার মানুষের কৃত্রিম পা লাগানো প্রয়োজন। আর যে দুই হাজার বাসিন্দা কৃত্রিম হাত-পা পেয়েছেন, তাদের রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। গাজায় আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির (আইসিআরসি) শারীরিক পুনর্বাসন কর্মসূচি পরিচালক আহমেদ মুসা বলেন, তাদের কর্মসূচিতে কমপক্ষে ৩ হাজার জনকে নিবন্ধিত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১ হাজার ৮০০ জনের অঙ্গচ্ছেদ হয়েছে। ওসিএইচএ এবং আইসিআরসি অনুসারে আরও হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মেরুদণ্ডের আঘাতে ভুগছেন, অথবা দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন।
যুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মানুষ আহত হওয়ায় চিকিৎসা দেওয়ার প্রচেষ্টা ধীর ও জটিল হয়ে উঠেছে। আইসিআরসির কর্মকর্তারা জানান, গাজা উপত্যকায় কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পৌঁছানো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসা বলেন, সঠিক কৃত্রিম অঙ্গ বা চলাচলের উপকরণ পাওয়া এখন ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ। যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে পুনরায় হামলা শুরুর পর এক মাসের বেশি সময় ধরে গাজায় কোনো ত্রাণ সহায়তা ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। পা হারানো ফারাহ বলেন, তিনি জানেন না কখন কৃত্রিম পা পাবেন বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাবেন।
ইসরায়েলের হামলার সবচেয়ে বড় শিকার গাজার বেসামরিক মানুষ। তাদের মধ্যে সাত বছরের শাজা হামদান রয়েছে। সে সাইকেল চালানো শিখতে চেয়েছিল। শাজা বলছে, ‘আমার বাবা আমাকে হাঁটতে যেতে বলেছিলেন। তারপর বৃষ্টির মতো আমাদের ওপর গোলা পড়তে শুরু করল। একটি আমার পায়ে আঘাত করে, যার ফলে পা কেটে ফেলতে হয়েছে। আরেকটি গোলা আমার বাবার বাহুতে আঘাত করে।’
শাজার দুবার অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। প্রদাহের কারণে আহত পা কেটে ফেলতে হয়েছে। সাজা বলছে, ‘আমি মায়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। তিনি আমার জন্য সবকিছু করেন। আমার জীবন আগের চেয়েও খারাপ। আহত হওয়ার আগে আমি খেলতে পারতাম।’
তার বাবা করিম হামদান জানান, শাজার মানসিক স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়ে গেছে। কারণ সে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। গাজায় কোনো কৃত্রিম অঙ্গ নেই। একমাত্র সমাধান হলো গাজার বাইরে চিকিৎসার জন্য যাওয়া। মেয়েটি অধৈর্য হয়ে উঠেছে। অনেক প্রশ্ন করছে; প্রতিদিন কাঁদছে।’
যুদ্ধের সময় গাজায় বেশ কয়েকটি চিকিৎসা মিশনের নেতৃত্ব দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ইসমাইল মেহের বলেন, পর্যাপ্ত পরিচর্যার অভাবে আরও অনেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারাতে পারে। ৯৯ শতাংশেরও বেশি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে নিম্নমানের পরিস্থিতিতে। সঠিক জীবাণুমুক্তকরণ ও সরঞ্জামের অভাবের কারণে চিকিৎসকদের দোষ দেওয়া যাচ্ছে না। কখনও এমন চিকিৎসক দ্বারা এ কাজ করানো হচ্ছে, যিনি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞই নন।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ত র ম হ ত স য জন ইসর য় ল
এছাড়াও পড়ুন:
লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা
লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।
সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।
আরো পড়ুন:
আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র
মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা
চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।
তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।
শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।
তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।
তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।
ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।
রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।
“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”
“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”
“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”
টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”
“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।”
সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।
ঢাকা/আমিনুল