ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী কি দেশের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানকে বরখাস্ত করতে পারেন? এ প্রশ্নে ৮ এপ্রিল ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালত শুনানি করে।

প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘শিন বেত’-এর প্রধান রোনেন বারকে বরখাস্ত করেন। তবে সুপ্রিম কোর্ট সেই সিদ্ধান্ত ২০ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত রেখেছেন।

আদালত বলেছেন, এ সময়ের মধ্যে সরকারকে দেশের স্বাধীন অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। অ্যাটর্নি জেনারেল বারকে বরখাস্তের বিরোধিতা করেছেন। কারণ, তিনি মনে করেন, এই বরখাস্তের ঘটনার সঙ্গে নেতানিয়াহুর স্বার্থের সংঘাত আছে।

এটা সাধারণত একধরনের সাংবিধানিক সংকট তৈরি করতে পারে। কারণ, নেতানিয়াহু ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, আদালতের বিরূপ রায় হলেও তিনি তা মানবেন না। তবে পরিস্থিতি একটু জটিল। কারণ, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা সম্পর্কে শিন বেত আগে থেকে কোনো সতর্কতা দিতে না পারায় বারকে বরখাস্ত করার যৌক্তিকতা আছে। বার নিজেও তাঁর ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন এবং পুরো ঘটনায় তদন্তের জন্য একটি রাষ্ট্রীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি তুলেছেন। কিন্তু নেতানিয়াহু নিজে যাতে দায়ী না হন, সে জন্য তিনি এই তদন্ত কমিশনের বিরোধিতা করছেন।

তার ওপর, বার অভিযোগ করেছেন, নেতানিয়াহু (যাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলা চলছে) তাঁকে চাপ দিয়েছিলেন যেন আদালত তাঁর (নেতানিয়াহুর) সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ পিছিয়ে দেন।

তাই একদিকে যেমন বারকে বরখাস্ত করার কিছু যৌক্তিক কারণ আছে, অন্যদিকে আছে স্বার্থের সংঘাতের প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় ও বিতর্কিত বিষয় হলো ‘কাতারগেট’ নামের একটি দুর্নীতির ঘটনা, যেটির তদন্ত করছিলেন রোনেন বার। এ মামলায় নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ কিছু সহযোগীর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়া ও গোপন তথ্য ফাঁস করার অভিযোগ আছে। আর এই তদন্ত শুরুর পরপরই নেতানিয়াহু বারকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেন।

ধারণা করা হচ্ছে, কাতার ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু লোককে ঘুষ দিয়েছে, যেন তারা গাজায় ইসরায়েলি জিম্মিদের ভাগ্য নিয়ে চলমান পরোক্ষ আলোচনা প্রসঙ্গে কাতারকে একটি বিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে উপস্থাপন করে। কাতার অন্য জায়গাতেও তার স্বার্থ রক্ষায় ঘুষ দেওয়ার কৌশল ব্যবহার করেছে। যেমন ২০২২ সালে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সেই গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাঁরা কাতারের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।

সংক্ষেপে কাতারগেট মামলার মূল বিষয় হলো, নেতানিয়াহুর দুই ব্যক্তিগত সহযোগী—ইয়োনাতান উরিখ ও এলি ফেল্ডস্টেইন—কাতারের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তাঁরা নাকি ইসরায়েলি মিডিয়ায় এমন কিছু বিবৃতি ফাঁস করতেন, যা কাতারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে। আরেক সহযোগী, যিনি এখন সার্বিয়ায় চলে গেছেন, তাঁকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খোঁজা হচ্ছে। জেরুজালেম পোস্টের প্রধান সম্পাদক এই মামলায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সন্দেহভাজন। এ ছাড়া এক ব্যবসায়ী স্বীকার করেছেন, তিনি আমেরিকার একজন কাতারি লবিস্টের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ফেল্ডস্টেইনের হাতে দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে যেসব তথ্য ফাঁস হয়, অনেক সময়ই তা নেতানিয়াহুর পক্ষ থেকেই ফাঁস হয় বলে ধারণা করা হয়। কারণ, অতীতেও তিনি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে গোপন তথ্য ফাঁস করেছেন। যদিও এই কাতারগেট বিষয়ে নেতানিয়াহু সরাসরি জড়িত ছিলেন, এমন প্রমাণ নেই। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, তার নির্দেশেই উরিখের মাধ্যমে কিছু তথ্য ফাঁস হয়েছিল।

ধারণা করা হচ্ছে, কাতার ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু লোককে ঘুষ দিয়েছে, যেন তারা গাজায় ইসরায়েলি জিম্মিদের ভাগ্য নিয়ে চলমান পরোক্ষ আলোচনা প্রসঙ্গে কাতারকে একটি বিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে উপস্থাপন করে। কাতার অন্য জায়গাতেও তার স্বার্থ রক্ষায় ঘুষ দেওয়ার কৌশল ব্যবহার করেছে। যেমন ২০২২ সালে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সেই গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাঁরা কাতারের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।

আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১০ ঘণ্টা আগে

তবে ইসরায়েলে কাতারের টাকার অর্থ ভিন্ন। ২০১৮ সাল থেকে নেতানিয়াহু সরকারের স্পষ্ট অনুমোদনে কাতার সরকার গাজার হামাস শাসনকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতি মাসে ৩০ মিলিয়ন ডলার পাঠাত। এই অর্থ স্যুটকেসে করে আনা হতো, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যাওয়া যায়। এসব টাকা সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও সামাজিক কল্যাণভাতা দিতে ব্যবহৃত হতো। ফলে হামাস তাদের অন্যান্য তহবিল সন্ত্রাসবাদে ব্যবহার করতে পারত।

ইসলামপন্থীদের প্রতি কাতারের সমর্থন তাকে আরব বিশ্বের চোখে প্রায়ই একঘরে করে তুলেছে। নেতানিয়াহুর যুক্তি ছিল, গাজায় হামাসের শাসন ইসরায়েলের স্বার্থে কাজ করছে। গাজায় সন্ত্রাসীরা ও রামাল্লায় দুর্নীতিপরায়ণ ও অদক্ষ ফাতাহ আমলারা থাকায় ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ইস্যুতে আলোচনায় না যাওয়ার একটি সুবিধাজনক অজুহাত পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রোনেন বার যে রাষ্ট্রীয় তদন্ত কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেটি হলে এই চিত্র প্রকাশ পেয়ে যেত।

যদিও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনজীবীরা এসব অভিযোগের বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি, তবে তাঁরা জোর দিয়ে বলেছেন, কাতার কোনো ‘শত্রুরাষ্ট্র’ নয়, অর্থাৎ এতে বিশ্বাসঘাতকতার কোনো প্রশ্ন আসে না। তাঁরা এটাও উল্লেখ করেন, ইসরায়েলের আইনে শুধু সরকারি কর্মচারীরাই ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারেন। আর প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত সহযোগীরা আইনত সরকারি কর্মচারী নন। তাঁরা এটাও যুক্তি হিসেবে আনতে পারেন, ইসরায়েলি গণমাধ্যমও এই গোপন তথ্যগুলো নির্দ্বিধায় ছাপিয়ে সমানভাবে দায়ী।

তবে ইসরায়েলের রাজনীতিতে পেছন থেকে আঘাত দেওয়া বা গোপন তথ্য ফাঁস করাই যেন নিয়ম। সাংবাদিকেরাও এই ফাঁস হওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করেন, রাজনীতিকেরাও তা–ই করেন। ফেল্ডস্টেইনকে আগেও আরেকটি গোপন তথ্য ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি তখনো চাকরি হারাননি।

এখন দুই পক্ষ স্পষ্টভাবে মুখোমুখি। বিচারমন্ত্রী ইয়ারিভ লেভিন বলেছেন, নেতানিয়াহুর সরকার ‘মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের অধিকার রক্ষা করছে, যাদের গণতান্ত্রিকভাবে ব্যালট বাক্সে দেওয়া সিদ্ধান্ত কিছু অহংকারী ও বাস্তবতাবিচ্ছিন্ন বিচারকেরা কেড়ে নিতে চাইছেন’। অথচ জনমত জরিপ বলছে, ৬৩ শতাংশ ইসরায়েলি দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং তারা সুপ্রিম কোর্ট, অ্যাটর্নি জেনারেল ও শিন বেতকে নেতানিয়াহুর সরকারের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি বিশ্বাস করে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

কনস্তান্তি গেবার্ট একজন পোলিশ সাংবাদিক। তিনি একসময় কমিউনবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। পোল্যান্ড, ইহুদি জনগোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে তিনি ১৪টি বই লিখেছেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র ব যবহ র হয় ছ ল কর ছ ন র কর ছ সরক র তদন ত সহয গ

এছাড়াও পড়ুন:

সিলেটে দুই উপদেষ্টার গাড়িবহর আটকে বিক্ষোভের ঘটনায় মামলা, আসামি ১৫৯

সিলেটের গোয়াইনঘাটের পর্যটনকেন্দ্র জাফলং পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টার গাড়িবহর আটকে বিক্ষোভ করার ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলায় নয়জনের নাম উল্লেখের পাশাপাশি ১০০ থেকে ১৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।

আজ রোববার রাত ১১টার দিকে মামলাটি দায়ের হয়েছে বলে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরকার মো. তোফায়েল আহমদ। তিনি জানান, সরকারি কাজে বাধাদান, গাড়ি আটক ও অবরোধের অভিযোগে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ওবায়েদ উল্লাহ বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ চেষ্টা করছে।

এর আগে গতকাল শনিবার সকালে জাফলং এলাকা পরিদর্শনে যান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। ফেরার পথে গোয়াইনঘাটের বল্লাঘাট এলাকায় তাঁদের গাড়িবহর আটকে দেন বালু-পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা। তাঁরা বন্ধ থাকা জাফলংসহ সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো চালুর দাবিতে স্লোগান দেন।

ঘটনার একাধিক ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, বিক্ষোভে নেতৃত্বে ছিলেন পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি আজির উদ্দিন, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সুমন শিকদার, জেলা ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক সোহেল আহমদ, উপজেলা শ্রমিক দলের সভাপতি আবদুল জলিল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রমজান মোল্লা ও উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ খান।

বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়ায় আজ সকালে উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ খানকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া একই ঘটনায় আজ সন্ধ্যায় পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি আজির উদ্দিনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেওয়া হয়। এতে তাঁকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সশরীর উপস্থিত হয়ে জবাব দিতে বলা হয়েছে।

আরও পড়ুনজাফলংয়ে দুই উপদেষ্টার গাড়ি আটকে বিক্ষোভ, নেতৃত্বে ছাত্রদল, যুবদল১৪ জুন ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ