অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি বিকাশের নতুন পথ
Published: 13th, April 2025 GMT
সংস্কৃতি বলতে সাধারণত আমাদের একটি ভাসা-ভাসা ধারণা রয়েছে। সংগীত, নৃত্য, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদি শিল্পকলার কতগুলো কর্মকাণ্ডকে আমরা সংস্কৃতি বলে মনে করি।
এই ভ্রান্ত ধারণার মধ্যেই আমাদের সংকটের সূত্রপাত। সংস্কৃতি আমাদের জীবনের সব আচার, যাপিত জীবনের উপকরণ, ভাষা, উৎপাদনব্যবস্থা, মানুষের খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে ব্যক্তি, পারিবারিক, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের গতিশীল অংশই সংস্কৃতি।
গাঙ্গেয় অববাহিকায় আমাদের এই ভূখণ্ডের পূর্বপুরুষদের জীবনের ভিত্তিকাঠামো ছিল কৃষি, কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত উৎপাদনব্যবস্থা আর সহজ-সরল জীবনযাপন। নদীমাতৃক সমাজে নদীর প্রভাব ছিল বিস্তর।
চুলের বেণির মতো আঁকাবাঁকা নদীর জলের আঘাতে একদিকে পাড় ভাঙে তো অন্যদিকে জেগে ওঠে নতুন জমি।
নদীকে কেন্দ্র করে যাঁদের জীবিকা, তাঁরাই ছিলেন আমাদের পূর্বজ। বাঙালির জীবনের সঙ্গে নদীর সম্পৃক্ততার কারণেই সাহিত্য থেকে চিত্রপট কিংবা গান থেকে সিনেমা আবার উপন্যাস থেকে গল্প–কবিতায় আমরা নদীবেষ্টিত মানুষের জীবনধারণের বর্ণনা পাই।
আরও পড়ুনসংস্কৃতির কাজ কি ক্ষমতার কেরানিগিরি২৮ জুন ২০২২সংস্কৃতির উপাদানের অংশ ছিল বনজঙ্গল। বনের প্রাণী শিকার অথবা খেয়ায় মৎস্য আহরণ জীবন ও সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলেছে। প্রভাব ফেলেছে ভাষায়।
জীবনাচারের সঙ্গে ধর্মীয় প্রভাব তখন তেমন লক্ষ করা যায়নি, কিন্তু পরবর্তী সময়ে মানুষের জীবনে তার ধর্মীয় প্রভাব ও জীবনের অংশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
মধ্যযুগের বিভিন্ন সাধুসন্ন্যাসীর প্রচারে মানুষের জীবনে ধর্মীয় উৎসব বেশ বড় রকম প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।
আর্যদের আগমনের পর এই দেশের যারা ভূমিপুত্র ছিল, তারা ক্রমে আর্যদের কাছে পরাজিত হতে হতে একপর্যায়ে তাদের সংস্কৃতি এবং ধর্মকেও হারিয়ে ফেলে এবং আর্যদের ভাষা, তথা জীবনাচারণের ধরন এবং ক্ষমতার প্রভাবে ভূমিপুত্রদের সংস্কৃতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে শুরু করে।
ভূখণ্ডের আদিবাসীদের ওপর আর্যদের প্রভাব মোকাবিলার শক্তি আদিবাসী সংস্কৃতি, অস্ত্র, বল কিছুই ছিল না।
উৎপাদন, বাজার, অর্থব্যবস্থা সাংস্কৃতিক উপাদান, তথা রাষ্ট্র-উৎপাদিত বৈষম্যের মধ্য দিয়ে কোণঠাসা করে ভূমিপুত্রদের ক্রমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়।
আরও পড়ুনসংস্কৃতি ও বিনোদন : এ নিয়ে বিভেদ কেন?০৩ এপ্রিল ২০২৩অনেক পরে ষষ্ঠ শতকের পর পাল রাজাদের শাসনের সময় সনাতন ধর্মের যে বর্ণপ্রথা চরমে ওঠে, যা মূলত নিম্নবর্গের মানুষদের শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে হিন্দুধর্মের উচ্চবর্গীয়রা তাদের দলিত করে রাখত।
সে জন্য নিম্নবর্গীয় মানুষেরা দলে দলে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করে এবং বৌদ্ধধর্মের এই সময়ে বাংলাদেশে (তৎকালীন ভারতবর্ষে), বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের সংস্কৃতিতে একটা বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়।
তাদের হাত ধরে মহাস্থানগড় ও কুমিল্লার ময়নামতিতে পাহাড়পুরে বৌদ্ধবিহার গড়ে ওঠে, যা ছিল মূলত শিক্ষা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান। আমরা আরও জানি যে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলার সীমান্তে বিহারের নালন্দায়।
বাংলা সুলতানি আমলে সাহিত্য–সংস্কৃতিতে এক অভূতপূর্ব জাগরণ ঘটে। এর পেছনে সুলতানি আমলের শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল বর্ণনাতীত।
সুলতানি আমল থেকে মোগল আমল পর্যন্ত বাঙালির জীবনাচার, তার সাহিত্য–সংস্কৃতিতে ইরান–পারস্য, তথা মধ্য এশিয়া এবং আরবের থেকে আসা জনগোষ্ঠীর প্রভাব দৃঢ়ভাবে লক্ষণীয়।
খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে পোশাক, ভাষা, স্থাপত্য শিল্প, তথা জীবনাচরণ সব ক্ষেত্রে এভাবে সংস্কৃতির গতিময়তা, সামাজিক পরিবর্তন, সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে আমাদের বৃহত্তর বাংলায় সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনের হরেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে।
আরও পড়ুনকৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য০৯ এপ্রিল ২০২৫এই পরিবর্তন ভূখণ্ডের সব জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তিকে তার শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়।
সতেরো শতকে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়দের আগমনের মধ্য দিয়ে আমাদের সেই গতিময়তার এক রকম ছন্দপতন ঘটে এবং ঘটানো হয়।
কারণ, ইউরোপীয় বণিকসহ আরও যাঁরা নানা সময় বাংলায় এসেছিলেন, তাঁরা মূলত এসেছিলেন বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে।
সে ক্ষেত্রে মোগল বা সুলতানি শাসকেরা ছিলেন ব্যতিক্রম। যাঁরা মধ্য এশিয়া, তুরস্ক বা ইরান থেকে এসে রাজ্য জয় করে ভারতবর্ষের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে রাজ্যগুলো দখল করলেও তাঁরা এই দেশকে নিজেদের দেশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
এ দেশে সমাজ–সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে বসবাস করতেন, তাঁরা তাঁদের ফেলে আসা দেশে সম্পদ পাচার করেননি।
পক্ষান্তরে ইউরোপীয় আর ইংরেজ শাসকবেনিয়া ২০০ বছরে ট্রিলিয়ন সমমূল্যের সম্পদ আমাদের বাংলাদেশ, তথা ভারতবর্ষ থেকে নিজেদের দেশে নিয়ে গেছে পাচার করে এবং সেই জন্য ভারত, তথা বঙ্গদেশে দুই–দুটি মহামন্বন্তর সংঘটিত হয়েছিল।
এই মহামন্বন্তরের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ মানুষের অনাহারে, রোগে ভোগে প্রাণহানি ঘটেছিল।
আরও পড়ুননামকরণের সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি১৯ জুন ২০২১ফলে আমাদের জীবনাচার, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয় এবং ব্রিটিশবিরোধী একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে আঠারো শতকের সময় এসে।
এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে লড়াইয়ে বৃহত্তর বাংলায় আমাদের সমাজজীবনে যে ঐক্য ছিল, সেখানে বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী দূরে চলে যায়! ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এর কারণ, বাংলা প্রদেশে অনুশীলন এবং যুগান্তর সংঘ। সশস্ত্র বিপ্লবীদের লড়াই শুরু করে সেখানে সনাতন ধর্মীয় দেব-দেবীদের উপাসনা, ধর্মীয় উপাদান থাকার কারণে মুসলিম সমাজ এই আন্দোলনে লড়াইয়ে যুক্ত হয়নি।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উত্তর ভারতীয় নেতৃত্বে মুসলিম এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলার নেতৃত্বের যে বিরোধিতা, সেটিও মুসলিম মানসে প্রভাব ফেলেছিল।
ফলে এ জন্যও দেশের হিন্দু–মুসলমান দুটি বড় সম্প্রদায়ের ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকদল ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’, এই ষড়যন্ত্রনীতি অনুসরণ করে হিন্দু–মুসলমিদের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়।
ফলে সাতচল্লিশে ভুল দ্বিজাতিতত্ত্বের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রের আবির্ভাব হয়।
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বাক্স্বাধীনতা এবং সংস্কৃতিকে দমিয়ে রেখে শুধু উন্নয়নের দর্শন দিয়ে যে রাষ্ট্র–সমাজ পরিচালনা করা যায় না, তার প্রমাণ জুলাই গণ-অভ্যুত্থান। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, তা হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি আমাদের বৃহত্তম অংশকে সংস্কৃতি বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া এবং পাহাড়–সমতলের সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতিকে ধারণ করে আমাদের একটি সংস্কৃতি বিনির্মাণ।পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসকেরা ব্রিটিশদের মতোই বাংলাকে স্রেফ একটি উপনিবেশ হিসেবে শাসন করতে থাকেন। এর বিরুদ্ধে বাংলায় প্রথমে বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন।
এরপর ধাপে ধাপে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং এই জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মধ্যে সংস্কৃতিতে একটি জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম হয়, সেটি হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং তার ভিত্তিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্মগ্রহণ করে।
স্বাধীনতার পর জাতীয়তাবাদীর যে আবেগ, সেই আবেগকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার যে কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল জাতির আবেগকে পুঁজি করে, সেই কৌশল আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যের পথে আরেকটি বাধার প্রাচীর গড়ে তোলে।
এর মূল কারণ, জাতীয়তাবাদ শ্রেণিবৈষম্যের কথা বলে না, কৃষক–শ্রমিক–মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম–লড়াই জাতীয়তাবাদ ধারণ করে না।
ফলে দেশে বুর্জোয়া এবং মেহনতি মানুষের একটি বিরাট বিভাজন তৈরি হয়।
দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশের পুঁজিপতিরা লুটেরা বুর্জোয়ায় পরিণত হয়, তারা বিদেশের সম্পদ পাচার করে ব্রিটিশদের মতোই, যা আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের জন্য ক্ষতিকর।
আরেকটি বিষয়, আমাদের জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতিবিদেরা এবং সাংস্কৃতিক নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের একটি বিরাট অংশ ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের দেশের জনগোষ্ঠী মুসলিম সম্প্রদায়ের আবেগ, মানসিকতা এবং ক্ষুদ্র সাঁওতাল, চাকমা তাদের সংস্কৃতিকে মূলধারায় যুক্ত করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক বিভাজন, ঐক্যের ঘাটতির সুযোগে বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সহজে শিকড় গেড়ে বসে এবং সাংস্কৃতিক বিভাজনের রাজনৈতিক অভিঘাতে অর্থনৈতিক পরাধীনতা আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরকে স্বাধীনভাবে বিকাশে বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম হয়।
যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, জাইকার মতো প্রতিষ্ঠান আমাদের রাষ্ট্রীয় দর্শনকে বিপথে নিয়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো চাপিয়ে দিয়ে এবং সেই মতো দেশের শাসকশ্রেণি নিজেদের মতো বলে উন্নয়নের দর্শন প্রচার করে এবং সেখানে মানুষের বাক্স্বাধীনতা সংস্কৃতিকে অবমূল্যায়ন করে উন্নয়ন নিয়ে নতুন বয়ান জনগণের সামনে উপস্থাপন করে।
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বাক্স্বাধীনতা এবং সংস্কৃতিকে দমিয়ে রেখে শুধু উন্নয়নের দর্শন দিয়ে যে রাষ্ট্র–সমাজ পরিচালনা করা যায় না, তার প্রমাণ জুলাই গণ-অভ্যুত্থান।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, তা হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি আমাদের বৃহত্তম অংশকে সংস্কৃতি বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া এবং পাহাড়–সমতলের সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতিকে ধারণ করে আমাদের একটি সংস্কৃতি বিনির্মাণ।
এটা করতে পারলে আগামী দিনে সাধারণ মানুষের বিজয়কে ত্বরান্বিত করবে। এ জন্য বর্ণজাতি–নির্বিশেষে সবাই যাতে সেই সংস্কৃতিকে আপন বলে ভাবতে পারে, সেই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা, যা হবে সংস্কৃতি বিকাশের নয়া পথ।
নাজমুল ইসলাম সভাপতি, উদীচী গোপালগঞ্জ জেলা সংসদ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জনগ ষ ঠ র জ বন চ র আম দ র জ ন আম দ র আম দ র ব স ব ধ নত দ র একট চ র কর র জ বন দ র মত সব ক ষ জ বন র উৎপ দ
এছাড়াও পড়ুন:
নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন
দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।
নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।
মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।
ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।
শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।
চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।
কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।
পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।
ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।
এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।