অতিরিক্ত ঋণ দেওয়ার ঘটনা তদন্ত করছে ইউজিসি
Published: 16th, April 2025 GMT
নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কর্মকর্তাদের বাড়ি নির্মাণে অতিরিক্ত ঋণ দেওয়ার ঘটনা তদন্ত করছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গঠন করা হয়েছে ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত ৯ এপ্রিল গঠিত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে ইউজিসির অর্থ, হিসাব ও বাজেট বিভাগের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খানকে। সদস্য হিসেবে রয়েছেন একই বিভাগের পরিচালক মো.
গত ১১ মার্চ ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে ঋণের মহোৎসব’ শিরোনামে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে সমকাল। এর পর তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় ইউজিসি। কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজের সভাপতিত্বে গত ২৪ মার্চ অনুষ্ঠিত বিশেষ সভার আলোচ্যসূচির ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কমিশনের করপোরেট সাধারণ গৃহনির্মাণ ঋণ নীতিমালায় গ্রেডভেদে সর্বোচ্চ ঋণসীমা নির্ধারিত রয়েছে। পঞ্চম গ্রেড ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তারা সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ, ষষ্ঠ থেকে নবম গ্রেড পর্যন্ত ৬৫ লাখ, ১০ম থেকে ১৩তম গ্রেড ৫৫ লাখ, ১৪তম থেকে ১৭তম গ্রেড ৪০ লাখ এবং ১৮তম থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তারা সর্বোচ্চ ৩৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পেতে পারেন। তবে এই ঋণ চাকরিজীবনের শেষ প্রান্তে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার পেনশন ও আনুতোষিকের পরিমাণ বিবেচনায় দেওয়া হয়।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ইউজিসির সাবেক সহকারী সচিব (নবম গ্রেড) মো. মামুনুর রশিদ খান সর্বোচ্চ ১৩ লাখ ২১ হাজার ৩৮৭ টাকা ঋণ পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। কিন্তু তিনি অতিরিক্ত টাকাসহ মোট ৬১ লাখ ৬৫ হাজার ৪১৩ টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে তিনি ইউজিসি চেয়ারম্যানের এপিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং নতুন কমিশনের অধীনে আরও ৪ লাখ টাকা ঋণ পেয়েছেন। যদিও তাঁর ঋণ আবেদন একাধিকবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।
এদিকে সবচেয়ে বেশি অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ করেছেন ইউজিসির জেনারেল সার্ভিসেস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পরিচালক ও সাবেক যুগ্ম সচিব জাফর আহম্মদ জাহাঙ্গীর। তাঁর প্রাপ্য ঋণের পরিমাণ ছিল ২৭ লাখ ৮১ হাজার ৭২২ টাকা, কিন্তু তিনি গ্রহণ করেছেন ৬৭ লাখ টাকা। কমিশনের স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং অ্যান্ড কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আকরাম আলী খানও প্রাপ্যতার অতিরিক্ত ১০ লাখ ৯৮ হাজার ৩৪৫ টাকা ঋণ নিয়েছেন। ১৮তম গ্রেডের অফিস সহায়ক ও অন্য কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও একই রকম চিত্র দেখা গেছে।
ইউজিসির গৃহনির্মাণ ঋণ নীতিমালায় বলা আছে, ঋণের সিকিউরিটি হিসেবে সংশ্লিষ্ট জমি বা ফ্ল্যাট ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখতে হয়। কিন্তু ইউজিসির নিজস্ব করপোরেট গৃহনির্মাণ ঋণ ব্যবস্থায় সিকিউরিটি হিসেবে শুধু পেনশন ও আনুতোষিক বন্ধক রাখা হয়। ফলে নির্ধারিত সীমা ও কর্মচারীর আর্থিক প্রাপ্যতা উপেক্ষা করে অতিরিক্ত ঋণ প্রদান নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইউজ স কর মকর ত ইউজ স র
এছাড়াও পড়ুন:
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি
নিয়োগপত্র নেই। এ কারণে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। দেওয়া হয় না পরিচয়পত্র। নেই কর্ম ঘণ্টার হিসাব। তবে রয়েছে মজুরিবৈষম্য ও জীবনের ঝুঁকি। এ চিত্র খুলনার বরফকলে কর্মরত বরফ শ্রমিকদের।
অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত বরফকলের শ্রমিকেরা জানেন না মে দিবসের অর্থ। তারা শুধু এটুকু জানেন, কাজ থাকলে মজুরি পাবেন, অন্যথায় জুটবে না কিছু। খুলনার নতুন বাজার, রূপসা, শিপইয়ার্ড ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বরফ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ঝুঁকি ও বৈষম্যের এই চিত্র।
সরেজমিনে জানা গেছে, লবণ পানি এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংমিশ্রণে বরফের প্রতিটি ক্যান তৈরি হয়। এ কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যুসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এছাড়াও অধিকাংশ সময় হাত-পা ভিজে ঠান্ডা থাকায় ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। এর বাইরে বুকে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় ভোগেন এখানকার শ্রমিকেরা। পাতলা বরফে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। কিন্তু মালিক বা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের অ্যাপ্রোন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন না। তবে দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
আরো পড়ুন:
ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত
মহান মে দিবস: শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কারে জোর সরকারের
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার, নিউমার্কেট, শিপইয়ার্ড, রায়েরমহল এবং রূপসা উপজেলার পূর্ব রূপসা এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি বরফকল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাজার ও পূর্ব রূপসায় সর্বাধিক বরফকল রয়েছে। এসব কলে গড়ে দশ জন হিসেবে দেড় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।
রূপসার নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত ‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করেন মোহাম্মদ রাসেল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি হলেও পরিবার নিয়ে রূপসার জাবুসা এলাকায় বসবাস করেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই বরফকলে কাজ করছেন তিনি। রাসেল জানান, তাদের মাসিক বেতন নেই। নেই নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র। মূলত উৎপাদনের উপর প্রতি পিস বরফের ক্যান অনুযায়ী ১২ টাকা হারে মজুরি পান। নামমাত্র এ মজুরিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে সংসার ঠিকমতো চলে না।
‘‘তিন বছর আগে নির্ধারণ করা মজুরি এখনো চলছে। লোকসানের অজুহাতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে চান না। তাদের মতো শ্রমিকদের কোন বেতন-বোনাস নেই। নো ওয়ার্ক, নো পে অর্থাৎ কাজ থাকলে মজুরি আছে কাজ না থাকলে নেই। মালিকদের এ সিদ্ধান্ত না মানলে চাকরিও থাকে না।’’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন রাসেল হোসেন।
একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘গড়ে প্রতিমাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা মজুরি পাই। কিন্তু মাসিক খাবার খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া বাবদ ৩ হাজার টাকা চলে যায়।’’
তবে জাকির হোসেন ব্যাচেলর হওয়ায় কারখানার মধ্যেই থাকেন। বিয়ের পর এ কাজ করার ইচ্ছা নেই বলে জানান তিনি।
বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১-এ অপারেটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ সেলিম শেখ। তার জন্ম নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা হলেও কর্মসংস্থানের কারণে রুপসার বাগমারা গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি জানান, বর্তমান বয়স ৮৪। ২০ বছর বয়স থেকেই বরফ কারখানার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হেলপার হিসেবে ২৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অপারেটর হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে সবসময় উৎপাদন না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা কারখানায় থাকতে হয়। ছুটি পান না।
‘অ্যামোনিয়া গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। তবে তিনি কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি বলে জানান তিনি।
‘মায়ের দোয়া আইস এন্ড কোল্ড স্টোরেজে’র শ্রমিক জাকারিয়া হাওলাদার বলেন, ‘‘চার বছর বরফকলে কাজ করছি। চাকরির ভবিষ্যৎ নেই। শ্রম দিতে পারলে মজুরি হয়, না হলে হয় না। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেন না মালিকপক্ষ। বেতন বাড়ানোর কথা বললে তারা আমলে নেন না।’’
একই এলাকার ‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করছেন মোঃ মুন্না গাজী ও মোঃ হাসান শেখ। তারা নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তারা দুজনেই মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই।
‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’র ম্যানেজার আশিকুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদাসীন। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার মাঝেমধ্যেই লিক হয়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৩২টি আইস উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। ছয়জন শ্রমিক কাজ করে বলে জানান তিনি।
‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ- ২'র ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘বরফের মূল ক্রেতা চিংড়ি ও সাদা মাছের ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ ও দোকানে শরবত বিক্রেতারাও কারখানা থেকে বরফ কিনে নেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের ৬ মাস চাহিদা থাকে এবং কিছুটা লাভের মুখ দেখা যায়। তবে শীত মৌসুমের ছয় মাস বরফের চাহিদা কম থাকে। তখন কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি দিয়ে লোকসান গুণতে হয়।’’
জামাল উদ্দিন স্বীকার করেন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও তা এড়াতে কোন সরঞ্জাম নেই। তবে অপারেটরদের অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে মাক্স সরবরাহ করা হয়।
‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১'র মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রিয়াদ-উল-জান্নাত সৈকত বলেন, ‘‘ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। কখনো লাভ, কখনো লোকসান এভাবেই চলছে। গত বছর কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’’
তবে লাভ হলে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ বিষয়ে শ্রমিকদের সংগঠন রূপসা বেড়িবাঁধ হ্যান্ডলিং শ্রমজীবী ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রিপন শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি বরফকলের ৪০ জন শ্রমিক তাদের ইউনিয়নের সদস্য। বিগত দেড় বছর আগে মজুরির সমস্যা নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুই একজন শ্রমিক অভিযোগ করলে ইউনিয়নের মাধ্যমে সেটির সমাধান করে দেন তারা। কিন্তু বর্তমানে অভিযোগ নিয়ে কেউ আসে না।’’
বরফকলের শ্রমিকদের নিয়ে তারা মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তারা//