সীতাকুণ্ডে প্রধান শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ
Published: 16th, April 2025 GMT
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীর হাজী তোবারক আলী চৌধুরী (টিএসি) উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্যকে জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
আজ বুধবার দুপুরে প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন এই শিক্ষক। পরে একটি গাড়িতে করে তাঁকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী এবং প্রক্তন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিদ্যালয়ে মিছিল নিয়ে এসে প্রধান শিক্ষককে ঘেরাও করে রাখেন। পরে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নেন বলে অভিযোগ।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যালয়ের পরিচালনায় গঠিত অ্যাডহক কমিটির সভাপতির পদ নিয়ে প্রধান শিক্ষকের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন স্থানীয় বিএনপির নেতা–কর্মীরা। কমিটির বর্তমান সভাপতি জামায়াত সমর্থিত মহিউদ্দিন আহমেদ। এ কারণে এ ঘটনায় জামায়াত সমর্থক ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়। বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির বর্তমান সভাপতি মহিউদ্দিনের এক আত্মীয়ের মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।
ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, ভাটিয়ারী টিএসি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ার খবরে তিনি ঘটনাস্থলে যান। বিদ্যালয় এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা ছিল। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা।
জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেওয়া পদত্যাগপত্রটি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। পদত্যাগপত্রে লেখা হয়েছে, ‘আমি আমার ব্যক্তিগত কারণে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলাম।’ এই একটি বাক্য ছাড়া পদত্যাগপত্রে আর কোনো কিছু লেখা ছিল না।
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আশ্চর্য প্রথম আলোকে বলেন, আজ বেলা ১১টার দিকে বিদ্যালয়ের ভেতরে তাঁর নিজ কার্যালয়ে তিনি ও অ্যাডহক কমিটির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছিলেন। এ সময় মিছিল নিয়ে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। এরপর আন্দোলনকারী ব্যক্তিরা তাঁকে জিম্মি করে রাখেন। পরে নুরুল আবছার নামের একজন নিজের হাতে পদত্যাগপত্র লেখেন। ওই পদত্যাগপত্রে আন্দোলনকারী ব্যক্তিরা জোর করে তাঁর স্বাক্ষর নেন।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার বিদ্যালয়ের নবগঠিত অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন জামায়াত সমর্থিত মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীর পুনর্মিলনী পরিষদের সদস্যসচিব ছিলেন। অ্যাডহক কমিটির সভাপতি অনুমোদন দেয় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড।
প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্য বলেন, সভাপতি নির্বাচনের জন্য চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে যোগ্যতাসম্পন্ন তিনজনের নাম পাঠাতে হয়। তিনি তিনজন ব্যক্তির নাম প্রথমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে পাঠান। এরপর ইউএনও সেটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাঠান। সেখান থেকে এই তালিকা চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে পাঠানো হয়। এরপর শিক্ষা বোর্ড মহিউদ্দিনকে অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে অনুমোদন দেয়।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী পুনর্মিলনী কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন। প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি বিদ্যালয়ের উন্নয়ন করার জন্য এসেছিলেন। মূলত প্রধান শিক্ষক তিনটি নাম প্রস্তাব করার পর চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছে। বিষয়টি স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা মেনে নিতে পারেননি। এর ফলে তাঁরা প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। তিনি বিষয়টি ইউএনও এবং পুলিশকে অবহিত করেন। পরে তিনি সীতাকুণ্ড থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
মহিউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি জামায়াতের রাজনীতি করেন। এখানে রাজনৈতিক কোনো বিষয় ছিল না। আন্দোলনকারী ব্যক্তিরা এসে তাঁকে খুব গালমন্দ করেন। বিদ্যালয়ের ভেতরে ঝামেলা হচ্ছে শুনে তাঁর আত্মীয়স্বজনও আসেন। এ সময়ে আন্দোলনকারীদের হামলায় তাঁর ভগ্নিপতি মো.
এ ব্যাপারে ভাটিয়ারী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নুরুল আনোয়ার বলেন, কান্তি লাল আচার্য দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এ জন্য বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাঁর পদত্যাগ দাবি করে মিছিল–সমাবেশ করেন। উত্তেজিত জনতার চাপে প্রধান শিক্ষক পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইউএনও মো. ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগ করানোর বিষয়টি তিনি জেনেছেন। কোনো শিক্ষককে পদত্যাগ না করাতে সরকারের বেশ কয়েকটি পরিপত্র রয়েছে। এ বিষয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পদত য গপত র ব এনপ র ন ত প রথম আল ক পদত য গ শ ক ষকক জ র কর
এছাড়াও পড়ুন:
ফেস্টুন অপসারণ করায় ইউএনওকে শাসালেন বিএনপি নেতা
ফেস্টুন অপসারণ করায় রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফয়সাল আহমেদকে শাসিয়েছেন এক বিএনপি নেতা। তিনি ইউএনওকে আগের স্থানেই ফেস্টুন লাগিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, “তা না হলে যেটা করা দরকার, সেটাই করব।”
এই বিএনপি নেতার নাম কে এম জুয়েল। তিনি রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক। গোদাগাড়ী উপজেলার রিশিকুলে তার বাড়ি।
গত মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) গোদাগাড়ী উপজেলা সদরের সড়ক বিভাজকে থাকা বিভিন্ন দলের ফেস্টুন অপসারণ করেন ইউএনও ফয়সাল আহমেদ। বিষয়টি জানতে পেরে ইউএনওকে ফোন করে ধমকান জুয়েল।
কে এম জুয়েলের ফোনকল রেকর্ড পাওয়া গেছে। এতে শোনা গেছে, কে এম জুয়েল বলেছেন- “আজকে একটা ঘটনা ঘটেছে, আমি শুনেছি। আমি ইঞ্জিনিয়ার কে এম জুয়েল বলছি, সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেট। আপনার গোদাগাড়ী থানার প্রোপারে যে পোস্টার সরিয়েছেন, এই বিষয়ে কিছুক্ষণ আগে আমাকে ইনফর্ম করা হয়েছে। সেখানে আমার পোস্টার ছিল। জামায়াত-বিএনপির পোস্টার ছিল। আপনি যে হটাইছেন, এর কারণ কী? কোনো পরিপত্র আছে, না ইচ্ছে করেই?”
ইউএনও তখন বলেন, “জনগণ অভিযোগ দিয়েছে।” জুয়েল বলেন, “জনগণ তো অনেক অভিযোগ দিয়েছে। সমগ্র গোদাগাড়ী থানাতে ভর্তি হয়ে আছে পোস্টার। তোলেন, সব তোলেন।”
এ সময় ইউএনও কিছু বলতে চাইলে তাকে থামিয়ে দিয়ে জুয়েল বলেন, “শোনেন, আমি যেটা বলছি লিগ্যাল রাইট নিয়ে বলছি, সেটার সঠিক অ্যানসার করবেন। আপনি কেন ওই জায়গার পোস্টার তুলেছেন, আর অন্য জায়গার তুলছেন না কেন? আমি ঢাকাতে আছি, আমি আসতেছি।”
ইউএনও বলেন, “আচ্ছা ঠিক আছে।” জুয়েল বলেন, “না, আপনি যেখান থেকে পোস্টার তুলেছেন, সেখানে আপনি সাবমিট করবেন পোস্টার।” কথা না বাড়িয়ে ইউএনও বলেন, “ঠিক আছে।”
এ সময় আরো ক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপি নেতা জুয়েল বলেন, “কালকে যেন আমরা ওখানে দেখতে পাই, পোস্টার যেখানে ছিল। ঠিক আছে মানে কী? অবশ্যই করবেন। না হলে যেটা করা দরকার সেটাই করব। আপনার এগেইনেস্টে যেরকম স্টেপ নেওয়া দরকার, সেটাই আমি করব। বিশেষ করে আমরা করব। আমার নেতার ছবি তুলেছেন আপনি ওখান থেকে। জাস্ট রিমেম্বার ইট।”
জুয়েল বলতে থাকেন, “নরসিংদী বাড়ি দেখান আপনি, না? কোন দল থেকে আসছেন আপনি? কোন দল থেকে এসেছেন? কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেছেন আপনি? কালকে পোস্টার ভদ্রলোকের মতো লাগাবেন। ফাইজলামি! এহ, বিশাল ব্যাপার। উনি টিএনও হয়ে গোদাগাড়ীতে আসছেন।”
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ইউএনও ফয়সাল আহমেদ বলেন, “ডাইংপাড়া মোড়ে ব্যানার-ফেস্টুন এরকম পর্যায়ে ছিল যে, যান চলাচলে সমস্যা হচ্ছিল। পাশাপাশি পৌরসভার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছিল বলে অভিযোগ ছিল। স্থানীয় জনগণ এ ব্যাপারে অভিযোগ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পৌরসভা থেকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে সরানোর জন্য। দুই-তিনবার মৌখিকভাবে ও লিখিত আকারে জানানো হয়েছিল। না সরানোর কারণে ব্যানার-ফেস্টুন সরিয়ে পৌরসভায় রাখা হয়েছে।”
তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একাধিক সভাতেও আলোচনা হয়েছিল। সেখান থেকে সকল রাজনৈতিক দলের পোস্টারই পৌরসভার পক্ষ থেকে সরানো হয়েছে। তবে, বিএনপি নেতা কে এম জুয়েলের ফোনে শাসানোর বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা কে এম জুয়েল বলেন, “ইউএনওর কাছে জনগণ অভিযোগ করেছে, আর আমরা কি মানুষ না? আমরা জানোয়ার? আমার ছবি তুলে ফেলুক আপত্তি নাই। আমার নেতার ছবিতে হাত দিয়েছে কেন? তার কাছে কি নির্বাচন কমিশন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পোস্টার তুলে ফেলতে? তিন মাসের মধ্যে কি নির্বাচন? উনি জাস্টিস করতেন, আমার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু গরু-ছাগলের মতো আচরণ করবেন, তা তো হয় না।”
বিষয়টি নিয়ে কোথাও আলোচনা হয়নি, ইউএনও কোনো চিঠিও দেননি, দাবি করে এই বিএনপি নেতা বলেন, “গতকাল আমার এক লোককে ডেকে ইউএনও বলেছেন, যেখানে পোস্টার ছিল, দয়া করে আপনারা লাগিয়ে নেন। কিন্তু, আমরা তো লাগাব না। ইউএনওকেই লাগাতে হবে।”
উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একজন সদস্য জানান, প্রায় দুই মাস আগে উপজেলা সদরের এসব ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উত্থাপন করেন এক ব্যক্তি। এক মাসেও সেগুলো অপসারণ না হওয়ায় পরবর্তী মাসের সভাতেও বিষয়টি আলোচনায় ওঠে। ওই সভায় ট্রাফিক পুলিশ আপত্তি করেছিল যে, ফেস্টুনের কারণে রাস্তার একপাশ থেকে অন্যপাশ দেখা যায় না। এতে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ দুটি সভার মধ্যে প্রথম সভায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়াল ছিলেন না। দুই সভার মাঝে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি পুনর্গঠন করা হলে তিনি পরবর্তী সভায় উপস্থিত ছিলেন।
তবে, কোনো আলোচনা হয়নি দাবি করে উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়াল বলেন, “আমি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য। পোস্টার নিয়ে কোনো আলোচনা সভায় হয়নি। ইউএনও আমাদের না জানিয়ে এভাবে ফেস্টুন অপসারণ করে ঠিক করেননি। সেখানে আমাদের নেতার ছবি ছিল।”
ঢাকা/কেয়া/রফিক