ভারতের মুসলিমরা রাজনৈতিকভাবে কেন ‘এতিম’ হয়ে গেল
Published: 18th, April 2025 GMT
সরকার যে মুসলমানদের কল্যাণের কথা বলে ওয়াক্ফ ব্যবস্থার সংস্কার করছে—দাবিটা সন্দেহজনক মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। গত ১০ বছরে সরকার যেভাবে মুসলমানদের নিয়ে নির্লিপ্ত থেকেছে, তাতে এ দাবি বিশ্বাসযোগ্য হয় না; বরং এটাকে রাজনৈতিক ধোঁকাবাজির আরও একটি দৃষ্টান্ত বলা চলে।
সম্প্রতি সংসদের উভয় কক্ষে তুমুল বিতর্কের পর ওয়াক্ফ (সংশোধনী) বিল পাস হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এটিকে সামাজিক ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে এক ‘ঐতিহাসিক মাইলফলক’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে কংগ্রেস এই বিলকে সংবিধানের মূলনীতি, ধারা ও চর্চার ওপর আঘাত বলে নিন্দা করেছে। সেই সঙ্গে তারা সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ জানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, এই বিল পাস হতো না, যদি না তথাকথিত মুসলিম-সমর্থক রাজনীতিবিদ চন্দ্রবাবু নাইডু, নীতীশ কুমার ও জয়ন্ত চৌধুরীর মতো নেতারা সমর্থন দিতেন। ফলে এটা স্পষ্ট, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রে মুসলমানরা আজ পুরোপুরি রাজনৈতিকভাবে অনাথ। বিচার চাওয়ার মতো আর কোনো নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি তাদের পাশে নেই।
যেসব দল নিজেদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে দাবি করে, তারাও অনেক সময় হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে পরোক্ষভাবে এগিয়ে দিয়েছে। এর ফলে ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যকে আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার পথ সুগম হয়েছে। এটি ভারতের সংবিধানিক অভিযাত্রার পথে এক অন্ধকার অধ্যায়।
ওয়াক্ফ হলো ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী একটি ধর্মীয় দানব্যবস্থা। কোনো ব্যক্তি তাঁর সম্পত্তি দরিদ্রদের কল্যাণে দান করেন। এরপর সেটি আর ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকে না। সেই সম্পত্তি আল্লাহর নামে দান করা হয়। এই সম্পত্তির মাধ্যমে মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদি পরিচালিত হয়। ১৯৯৫ সালের ওয়াক্ফ আইন অনুযায়ী এগুলো চলে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরের ওয়াক্ফ বোর্ডের মাধ্যমে এগুলোর তদারকি হয়। রাজ্য সরকারগুলো এই সংস্থাগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো সমস্যা হলে তা ওয়াক্ফ ট্রাইব্যুনালে ওঠে।
যাঁরা ভারতীয় গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন, তাঁদের এক হয়ে ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই এখন জরুরি। মুসলমানরাও তাঁদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। গণতান্ত্রিক চেতনায় দৃঢ় কোনো নেতৃত্ব মুসলিম সমাজে এখন চোখে পড়ে না। এই দুর্বল নেতৃত্বই পুরো সম্প্রদায়ের এক বড় সমস্যা।স্বীকার করতে হবে, অনেক ওয়াক্ফ বোর্ডই দুর্নীতিগ্রস্ত বা অকার্যকর। অনেক জায়গায় বেসরকারি দখলদারি বা জমি জবরদখলের অভিযোগও রয়েছে। তবে এ রকম সমস্যা ভারতের সাধারণ জমি, জলাশয় বা বনভূমিতেও দেখা যায়। এই দখলদারির কারণে দরিদ্রদের পক্ষে ওয়াক্ফের সুবিধা পাওয়া কঠিন করে তোলে। ফলে ওয়াক্ফের মূল উদ্দেশ্যটাই বাধাগ্রস্ত হয়। তাই একটা সার্বিক সংস্কার দরকার। এই সংস্কার ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে দাবি করেছেন অনেক সচেতন নাগরিক ও সংগঠন।
কিন্তু বর্তমান সরকার হঠাৎ মুসলমানদের কল্যাণের কথা বলে এত বড় উদ্যোগ নিচ্ছে—এটা সন্দেহজনক। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার মুসলিম সমাজকে না জানিয়ে, আলোচনায় না বসেই করা হলে, সেটাকে নিছক হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু এর আড়ালে আরও গভীর শঙ্কা লুকিয়ে আছে। বাস্তবতা হলো, গত দশ বছরে সরকারের কোনো কার্যকলাপে মুসলমানদের প্রতি আন্তরিকতা দেখা যায়নি; বরং প্রতিনিয়ত বাড়ছে ঘৃণা, বিদ্বেষ আর বিভাজনের রাজনীতি।
আরও পড়ুনমোদির নতুন চাল ১৬ এপ্রিল ২০২৫গরু রক্ষার নামে গণপিটুনি, লাভ জিহাদ বা করোনা জিহাদের মতো কাল্পনিক ধোঁয়া তুলে মুসলমানদের হয়রানি করা হয়েছে। এসব ঘটনায় সরকার বরাবর নীরব থেকেছে। উত্তর প্রদেশে বুলডোজার এখন সরকারিভাবে শাস্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে। মসজিদের নিচে মন্দির খোঁজার নামে হিন্দুত্ববাদী বাহিনীরা প্রশাসনের প্রশ্রয়ে যা খুশি তা–ই করছে। নির্বাচনের সময় মুসলিমবিদ্বেষী ভাষা ব্যবহার এখন যেন স্বাভাবিক ব্যাপার।
মোগল, মাছ-মাংস এসব শব্দই এখন মুসলমানদের বিপক্ষে ইঙ্গিত হয়ে উঠেছে। সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য চালু থাকা বৃত্তি প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফুটপাতের মুসলমান ছোট ব্যবসায়ীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। পার্কে শান্তিপূর্ণভাবে নামাজ পড়লেও পুলিশ গ্রেপ্তার করছে। এমনকি ঈদের নামাজ রাস্তায় পড়াও অনেক জায়গায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এই বাস্তবতায় সরকার দাবি করছে, ওয়াক্ফ আইন সংশোধন করছে মুসলমানদের মঙ্গলের জন্য। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য হলো, হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে আরও উসকে দেওয়া। বিলটি পাস করানোর আগে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচার চলেছে, মুসলমানরা নাকি হিন্দুদের জমি দখল করে নেবে ওয়াক্ফের নামে। এনডিএ জোট এই মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে বিহার নির্বাচনে সুবিধা নিতে চায়। এই বিল জমি ও সম্পত্তির ওপর বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ারও হতে পারে। কারণ, এই খাতে ইতিমধ্যেই বড় ধরনের দুর্নীতি বিদ্যমান।
আরও পড়ুনভারতের নতুন ওয়াক্ফ বিল মুসলমানদের জন্য যে সমস্যা ডেকে আনবে০৫ এপ্রিল ২০২৫এই ওয়াক্ফ সংশোধন বিল সরাসরি সংবিধানের মূল চেতনার ওপর আঘাত করেছে। এটি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করে। সংখ্যালঘুদের নিজেদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার যে সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে, সেটিও এতে খর্ব হয়েছে। এই আইনে বলা হয়েছে, ওয়াক্ফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য রাখতে হবে। এই সিদ্ধান্ত একটা নির্দিষ্ট ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে বৈষম্যমূলক হস্তক্ষেপ। সরকার যদি সত্যিই বৈচিত্র্য ও সমান অধিকার চায়, তাহলে তিরুপতি দেবস্থানম বোর্ডে কি মুসলমান, খ্রিষ্টান বা পার্সিদের নিয়োগ করবে? যদি সত্যিই সব ধর্মের জন্য এক আইন দরকার হয়, তাহলে তা হোক ইউনিফর্ম সিভিল কোডের আওতায়। সব ধর্মস্থলের জন্য এক নিয়ম হোক।
নতুন আইন অনুযায়ী, কেউ ওয়াক্ফ করতে চাইলে তাঁকে আগে কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে মুসলমান থাকতে হবে। এই বিধান করে ওয়াক্ফকে একধরনের বেসরকারি প্রকল্পের মতো সাজানো হয়েছে।
এই বিল আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তবে আসল লড়াইটা সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরে হওয়া দরকার। যাঁরা ভারতীয় গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন, তাঁদের এক হয়ে ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই এখন জরুরি। মুসলমানরাও তাঁদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। গণতান্ত্রিক চেতনায় দৃঢ় কোনো নেতৃত্ব মুসলিম সমাজে এখন চোখে পড়ে না। এই দুর্বল নেতৃত্বই পুরো সম্প্রদায়ের এক বড় সমস্যা।
অবশ্য দমন-পীড়নের মুখে থাকা একটি জাতিগোষ্ঠীর কাছে সব সময়ে নেতৃত্বের দাবি তোলা অন্যায্যও বটে; কিন্তু পবিত্র কোরআনের বাণী মনে রাখতে হবে—আল্লাহ তাদেরই সাহায্য করেন, যারা নিজেরা নিজেদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। ভারতীয় সংবিধান এখনো আমাদের আশার জায়গা, যেখানে একতা ও উন্নতির সুযোগ রয়েছে।
আমাদের দরকার এমন একটি বৃহত্তর গণ–আন্দোলন, যেখানে ধর্মের বিভাজন পেরিয়ে সবাই মিলে ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়বে। যেমনটা আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেখেছি। সিএএ-এনআরসি, লাভ জিহাদ আইন, আর এখন এই নতুন ওয়াক্ফ আইন—সবই দেখিয়ে দিচ্ছে যে এখন সময় হয়েছে মুসলমানদের মধ্যে এক শক্তিশালী, গণতান্ত্রিক চেতনার নেতৃত্ব গড়ে তোলার। নেতৃত্ব হোক মুসলিম, হোক বা অমুসলিম—যাঁরা আমাদের সংবিধান, সাম্য আর সহাবস্থানের পক্ষে কথা বলবেন, তাঁরাই হোক আমাদের ভরসা।
জাকিয়া সোমান সহপ্রতিষ্ঠাতা, ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন
দ্য ওয়্যার থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক র র জন ত ম সলম ন র জন য আম দ র এই ব ল সমস য র ওপর সরক র দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
নীতি সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ, কী প্রভাব পড়তে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতে
অবশেষে সুদের হার কমিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের পর এই প্রথম সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে দুর্বলতার লক্ষণ, আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্ব, কর্মঘণ্টা কমে যাওয়া ও নতুন চাকরি সৃষ্টির গতি কমে যাওয়ায় ফেড এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ২৫ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে ৪ থেকে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়ার পর ফেড চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেন, অক্টোবর ও ডিসেম্বর মাসে সুদহার আরও কমতে পারে। তিনি বলেন, শ্রমবাজারের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা এখন তাঁর ও সহকর্মী নীতিনির্ধারকদের প্রধান উদ্বেগ। খবর রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক দিন ধরেই ব্যাপক হারে সুদ কমানোর দাবি তুলছিলেন। তাঁর বক্তব্য, এতে অর্থনীতি চাঙা হবে। তবে ফেডের এ সিদ্ধান্ত তাঁর প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। ফেডের পর্ষদে নতুন গভর্নর স্টিফেন মিরান ছিলেন একমাত্র ভিন্নমতাবলম্বী। তিনি ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট হারে সুদহার কমানোর পক্ষে ছিলেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও বড় কাটছাঁটের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সুদের হার নির্ধারণে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রশ্ন সব সময়ই তোলা হয়। ট্রাম্প সম্প্রতি ফেডের এক গভর্নর লিসা কুককে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও কুক আদালতের লড়াইয়ে আপাতত নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন এবং বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান মিরানকে ফেডের পর্ষদে বসান।
শ্রমবাজারে দুর্বলতাপাওয়েল বলেন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে, তরুণেরা আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছেন। সামগ্রিকভাবে চাকরি সৃষ্টির গতি খুবই কম। শ্রমবাজারকে আর দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না।
পাওয়েল আরও সতর্ক করেন, নতুন চাকরির সংখ্যা এখন বেকারত্বের হার স্থিতিশীল রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে সামান্য ছাঁটাইও বেকারত্ব বাড়িয়ে দিতে পারে।
মূল্যস্ফীতি বনাম কর্মসংস্থানমূল্যস্ফীতি এখনো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে বছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতির হার ৩ শতাংশে উঠবে, যেখানে ফেডের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২ শতাংশ। কিন্তু ফেড মনে করছে, কর্মসংস্থানের ঝুঁকি এখন বেশি গুরুত্ব পাওয়ার মতো বিষয়।
ফেডের নতুন পূর্বাভাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়িয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ করা হতে পারে বলা হয়েছে। বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশেই স্থির থাকবে বলে তারা অনুমান করছে।
রাজনৈতিক টানাপোড়েনএ সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক নাটকও কম ছিল না। ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা থাকলেও ফেডের পর্ষদের অন্য দুই ট্রাম্প-মনোনীত গভর্নর মিশেল বোম্যান ও ক্রিস্টোফার ওয়ালার শেষ পর্যন্ত মূল সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়েছেন। ওয়ালার বরাবরই শ্রমবাজারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলে আসছেন।
পাওয়েল অবশ্য পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘আমাদের সংস্কৃতির মূল বিষয় হলো তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত। আজকের বৈঠকে সুদহার ব্যাপক হারে কমানোর বিষয়ে বিপুল সমর্থন ছিল না।’
বাজারের প্রতিক্রিয়াসুদহার কমানোর ঘোষণার পর ওয়াল স্ট্রিটে প্রথমে শেয়ারের দাম বাড়লেও পরে ওঠানামা করে। শেষমেশ মিশ্র পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন শেষ হয়। ডলার কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে ঠিক, কিন্তু ট্রেজারি বন্ডের সুদ প্রায় অপরিবর্তিত। বাজার এখন প্রায় নিশ্চিত, অক্টোবরের বৈঠকেও সুদ কমানো হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ফেডের সাম্প্রতিক নীতি পরিবর্তনের মানে হলো তারা এখন ধীরে ধীরে ‘নিরপক্ষে’ অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সাময়িকভাবে কিছুটা বাড়লেও ২০২৬ সালের মধ্যে স্থিতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নীতিসুদ কীকেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদহারে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ দেয়, সেটাই নীতি সুদহার। ইংরেজিতে একে বলে রেপো রেট। রেপোর বাংলা হচ্ছে পুনঃক্রয় চুক্তি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে এটি পরিচিত। অর্থনীতিতে নগদ তারল্যের জোগান দিতে বা অন্যভাবে বলতে গেলে ব্যাংকগুলোর জরুরি প্রয়োজনে অর্থ সরবরাহ করতে মুদ্রানীতির এ হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ হাতিয়ার ব্যবহার করে।
কোভিডের পর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তখন ফেডারেল রিজার্ভ বাজারে মুদ্রার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে দফায় দফায় নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। ফলে নীতি সুদহার গত দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২৫ থেকে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশে উঠে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহারের প্রভাববিশ্ব অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিসুদের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। ফেডের নীতিসুদের হার বাড়লে ট্রেজারি বন্ডের দাম কমে এবং সুদহার কমলে ট্রেজারি বন্ডের দাম বাড়ে। এর কারণ হলো বাজারে নতুন ও অধিক সুদের বন্ড আসার পর পুরোনো বন্ডের কুপন (সুদ) কম মনে হয়, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম কমে যায়। আবার যখন সুদের হার কমে, তখন নতুন বন্ডের কুপন কম হওয়ায় পুরোনো বন্ডের উচ্চ কুপনযুক্ত সুদ বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম বেড়ে যায়।
নীতিসুদ কমলেও একই প্রক্রিয়া ঘটে, তবে বিপরীতভাবে। সুদের হার কমলে নতুন বন্ডের কুপনও কমে যায়। এতে আগের উচ্চ সুদের কুপনযুক্ত বন্ডগুলো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বিনিয়োগকারীরা এই পুরোনো বন্ডগুলো কিনতে আগ্রহী হন, ফলে সেগুলোর দাম বেড়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা তখন তুলনামূলক ঝুঁকিপূর্ণ বাজারেও বিনিয়োগ আগ্রহী হন। এতে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়ে এবং ডলারের চাপ কিছুটা কমে।
সে কারণে বাজার নীতি সুদহারের দিকে তাকিয়ে থাকে, সুদ কমলে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়।