‘গাজায় কোনো মানবিক সাহায্য প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না’
Published: 18th, April 2025 GMT
ইসরায়েলের অতিডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির বলেছেন, হামাসের সাথে কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি হবে না এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত ছিটমহলে কোনো মানবিক সাহায্য প্রবেশ করবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে তিনি এ কথা বলেছেন।
২০২৩ সালে গাজায় হামলা শুরুর পর ত্রাণের প্রবেশ একরকম বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। উপত্যকতার ২০ লাখেরও বেশি মানুষ এখন দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হচ্ছে।
হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি প্রসঙ্গে বেন গাভির বলেছেন, “হামাস কোনো শর্ত রাখতে পারবে না। এটি তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করা হবে। কোনো চুক্তি নেই, কোনো যুদ্ধবিরতি নেই, কোনো সাহায্য নেই - গাজায় (হামাস) পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত কেবল যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া।”
যুদ্ধবিধ্বস্ত ছিটমহলে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি এবং পানিসহ সকল মানবিক সরবরাহের উপর ইসরায়েলি বাহিনীর প্রায় ৫০ দিনের অবরোধের কারণে গাজায় ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সতর্ক করে দিয়েছে। সেই সতর্কবার্তাকে উড়িযে দিয়ে বেন গাভির ‘চাপ’ বাড়ানোরও আহ্বান জানিয়েছেন।
উগ্রপন্থী এই নেতা লিখেছেন, “সব শক্তি প্রয়োগ করুন - যতক্ষণ না হামাস হাঁটু গেড়ে বসে ভিক্ষা করে। সম্পূর্ণ বিজয় না হওয়া পর্যন্ত।”
ঢাকা/শাহেদ
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
নাগরিক সমাজ শাসকদের পক্ষে থাকে কেন?
পত্রপত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমের সাম্প্রতিক তর্ক দেখলেই বারবার আহমদ ছফার কথা মনে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বুদ্ধিজীবী শ্রেণির কপটতা নিয়ে তাঁর মতো এত তীক্ষ্ণ ও পরিচ্ছন্ন ভাষায় কেউ লিখেছেন বলে মনে হয় না। এ কারণে তাঁর ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রবন্ধটি ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে। এই প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরও বুদ্ধিজীবীদের ভাষা ও চিন্তাভাবনা একই পাটাতনে রয়ে গেছে, যা প্রতিদিন বিভিন্ন মাধ্যমে উদোম হয়ে পড়ছে। এ কারণে গণঅভ্যুত্থানের পরও প্রধান জিজ্ঞাসা– বুদ্ধিজীবীরা আদৌ কি পরিবর্তন চান?
স্বাধীনতার পর দেশে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তার প্রধান পথ ছিল অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম। এই পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে ওঠে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা এ দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির হর্তাকর্তা। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাষ্ট্রভাবনায় সাধারণ মানুষ একেবারেই গরহাজির, যেখানে তারা শুধু ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত বলয়গুলো শক্তিশালী করেছে। সুতরাং এই সাজানো-গোছানো বাগান সংস্কার হলে প্রথমেই আঘাতটা লাগে বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোতে, যার সঙ্গে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির সম্পর্ক ওতপ্রোত। এ কারণে তাদের কাছে সংস্কারের পথ মানেই শঙ্কার!
বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর রাজনীতিতে প্রধান শক্তি গোষ্ঠীগত বলয়। কেন্দ্রে কিংবা প্রান্তে গুটিকয়েক পরিবারই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম. হাসান সমকালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিও ঘুরেফিরে পারিবারিক প্রভাবাধীন রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ যেমন শেখ পরিবার ছাড়া চলতে চায় না, তেমনি বিএনপিও জিয়া পরিবার ছাড়া চলতে চায় না।’ প্রশ্নটি আরও সরলভাবে তোলা যায়; বিএনপি আসলে আওয়ামী লীগ থেকে কতটা আলাদা?
ঐতিহাসিক কারণে দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ উল্লেখযোগ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে; কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে দলটি যে নেতিবাচক ধারার সূচনা করেছিল, পরবর্তী সময়ে গঠিত সব ক’টি দল একই পথে হেঁটেছে। নব্বইয়ের দশকে সামরিক শাসন উৎখাতের পর একটা ঐতিহাসিক সুযোগ এসেছিল। কিন্তু সেটাও ক্ষমতা কাঠামোর বলয়গুলো কাজে লাগাতে দেয়নি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান জাতির সামনে আরেকটি সুযোগ এনে দিয়েছে; কিন্তু ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত পুরো বন্দোবস্ত সেই সম্ভাবনা থামিয়ে দিতে চায়।
গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে ভ্রান্তভাবেই দেশ নিয়ে বড় ধরনের আশা জেগেছিল। তারা মনে করেছিল, বড় দল হিসেবে বিএনপি তরুণদের সঙ্গে নিয়ে এই সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে হাঁটবে। কিন্তু পরক্ষণেই বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর পুরোনো চেহারা উদোম হয়ে পড়ে। যখনই তরুণরা নতুনভাবে রাজনীতিতে শরিক হয়েছে, তখনই পুরো কাঠামো বিদ্যমান ব্যবস্থা জারি রাখতে নানা রকম যুক্তি নিয়ে সামনে আসে। যে প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কারণে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব ঘটেছিল, বিএনপিসহ তার সঙ্গে যুক্ত বলয়গুলো আজ সেই বন্দোবস্ত কায়েম রাখতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখানেই প্রশ্নটা আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ থেকে কতটা আলাদা?
বিএনপিও কিন্তু আওয়ামী লীগের মতোই পরিবার প্রভাবিত রাজনৈতিক দল। কেন্দ্রে কিংবা প্রান্তে কয়েকটি পারিবারিক বলয়ের ওপরেই হাজার হাজার কর্মীর নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত নির্ভর করে। এসব বলয় তাদের বাইরে থেকে নেতৃত্ব বিকশিত হতে দেয় না। তবে এসব বলয় অক্ষুণ্ন রাখার জন্য শুধু রাজনীতিবিদরাই দায়ী– ঠিক তা নয়। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও অর্থনীতির শরিক হিসেবে যুক্ত রয়েছে নাগরিক সমাজও। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশের ভূমিকা সবসময় শাসকদের পক্ষে থাকে।
গণঅভ্যুত্থানের পরও নাগরিক সমাজের কোনো কোনো সদস্য পুরোনো ব্যবস্থা অটুট রাখার পক্ষে বয়ান দিয়ে যাচ্ছেন। যে কোনো অভ্যুত্থানই বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে দিতে চায়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানও সেই বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে। এখানেই তরুণদের সঙ্গে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরোধ ও সংঘাত। নাগরিক সমাজের যে অংশ ইনিয়ে বিনিয়ে গণঅভ্যুত্থানকে অস্বীকার করতে চায়, তারাই বর্তমান প্রজন্মের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বাংলাদেশের আগামী রাজনীতিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থান একটি পাটাতন হিসেবে কাজ করবে। মুক্তিযুদ্ধকে এড়িয়ে যেমন বাংলাদেশের কল্পনা করা যায় না; তেমনি গণঅভ্যুত্থানকে উপেক্ষা করে আগামীর রাজনীতিও অসম্ভব।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপরই আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।’ বাস্তবতা হলো, গণঅভ্যুত্থানের পরও দেশের নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একটি অংশ একই ভাষা ও সুরে কথা বলছে।
এখানেই তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। তরুণরা বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোর বলয়গুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দেশের রাজনীতি পুনর্গঠন করলেই জনগণ নিজেদের পথ খুঁজে পাবে। আর তরুণরা বিদ্যমান লুণ্ঠনের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ভাষায় নিজেদের ঠেলে দিলে কেউই দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারব না।
ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
iftekarulbd@gmail.com