সড়ক দুর্ঘটনা: দায় নিতে হবে আমাদেরও
Published: 20th, April 2025 GMT
ঢাকা তো ঢাকা, সব নগর-বন্দর-গঞ্জ ছাড়িয়ে দেশের নিভৃত পল্লির রাস্তাঘাটও দাপিয়ে বেড়ায় যে যান, সেটি মোটরসাইকেল। দু-চারটি ব্যতিক্রম বাদে যন্ত্রচালিত দুই চাকার এ যান চলে মোটাদাগে বেপরোয়াভাবেই। গতির লাগাম তো নেইই, অকারণে হর্ন বাজাতেও জুড়ি নেই এর। উল্টো পথে চলাসহ যেকোনো ফাঁকফোকরে ঢুকে যাওয়ায় মোটরসাইকেলকে টেক্কা দেওয়ার মতো এত দিন সেভাবে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না সড়কে। সাম্প্রতিক সময়ে সে ‘অভাব’ পূরণে এগিয়ে এসেছে ব্যাটারিচালিত রিকশা বা থ্রি-হুইলার।
ঢাকাবাসীর সম্ভবত একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি ফুটপাতে এক বেলাও নিরুপদ্রবে হাঁটতে পেরেছেন। একে তো মহানগরের প্রধান প্রধান জায়গাসহ বিপণিবিতানের আশপাশ থেকে পাড়া-মহল্লার ফুটপাত মূলত হকারদের দখলে। বাকি যেটুকু আছে, সেটুকু ‘মোটরসাইকেল লেন’ বানিয়ে ফেলেছেন চালকেরা। ফলে সেই লেন দিয়ে চলার সময় ‘অধিকারবলে’ হর্ন বাজিয়ে পথচারীকে সরে যেতে বলেন।
নিতান্ত জইফ বৃদ্ধ বা দুধের শিশু ছাড়া সবাইকে কমবেশি বাড়ির বাইরে বের হতে হয় এবং রোজই তাঁরা মোটরসাইকেলের ‘অত্যাচার’ সয়ে ঘরে ফেরেন। এর মানে আবার এ-ও নয় যে সড়কের অন্যান্য যানের মধ্যে শৃঙ্খলা আছে। না, নেই। বাস, ট্রাক, টেম্পো, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা থেকে শুরু করে প্রাইভেট কার—কারও মধ্যে নিয়ম মানার প্রবণতা নেই। পথচারীরাও এর বাইরে নন। অর্থাৎ অনিয়মে কেউই কম যান না।
তাহলে কে কাকে দোষ দেবে, কার বিরুদ্ধে কে করবে অভিযোগ? তবে এই নিয়ম না মানার, পরোয়াহীন চলাচলের একটা ক্রম নিশ্চয়ই তৈরি করা যায় বিভিন্ন ধরনের যানের মধ্যে, আর সেটা বোঝার একটা ‘সূচক’ হতে পারে সড়ক দুর্ঘটনা।
চলতি বছরের মার্চে সারা দেশে ৫৮৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ গেছে ৬০৪ জনের। রোড সেফটির হিসাব বলছে, ৪১ দশমিক ২২ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলে এবং এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা ২৩৩। অর্থাৎ ‘শীর্ষ স্থানে’ মোটরসাইকেল। এরপরই রয়েছে থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান)। তিন চাকার এসব যানের দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১১৯ জন।
শুধু মার্চের হিসাবে নয়, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি-বেসরকারি সব পরিসংখ্যানেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ঊর্ধ্বমুখী চিত্র পাওয়া যায়।
বেপরোয়া চলাচল নাহয় ‘মেনেই’ নেওয়া গেল, কিন্তু তার জন্য এত চড়া মূল্য! আমরা যাঁরা এখনো দুর্ঘটনায় পড়ে পঙ্গুত্বের জীবন পাইনি কিংবা স্বজনকে হারাতে হয়নি, তাঁরা হয়তো ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের মনোবেদনা সেভাবে অনুভব করতে পারব না! সন্তান হারানো মা-বাবার ভাতের থালায় কত অশ্রু গড়িয়ে পড়ে; মাথার ওপর পিতার ছায়া হারিয়েছে যার, সেই সন্তানের বুকের ভেতর কী ঝড় বয়ে যায়; স্বামীহারা হয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে যে নারীর দিন কাটছে অন্ধকারে, সেই অন্ধকার কতটা প্রগাঢ়—কে রাখে খবর তার?
হ্যাঁ, আইন প্রয়োগ করবে রাষ্ট্র, তার অধীন সংশ্লিষ্ট সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, বাহিনী বা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আইন মানারও বিষয়। আর তখনই চলে আসে নাগরিক দায়িত্ব বা কর্তব্যবোধের কথা। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ছাড়াও প্রচলিত আইন ও সংবিধান মেনে চলতে হয় প্রত্যেক নাগরিককে। তাই দুর্ঘটনার প্রশ্নে অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগী—দুই পক্ষেরই আইন মেনে চলার বিষয়টি কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।
যে অভূতপূর্ব ঐক্য, স্বতঃস্ফূর্ত ভ্রাতৃত্বের প্রকাশ ও মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর সম্মিলিত জাগরণের নজির স্থাপন করেছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান, এরপরের বাংলাদেশে প্রত্যেকেই একেকজন ‘নতুন’ মানুষ। এই নতুনত্বে আছে অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা, ন্যায়ের পক্ষে অনড় সমর্থন। ‘শাসন’ নামের পুরোনো সেই জাঁতাকলে আমরা আর পৃষ্ট হতে চাই না, সেখানেই আমাদের ‘পরীক্ষা’। আইনের প্রতি সম্মান দেখানোর দায় এবং সহনাগরিকের প্রতি দরদ ছাড়া সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যাবে না।
তাই আমরা প্রত্যেকে যদি আমাদের অবস্থান থেকে ন্যায়নিষ্ঠ হই, দায়িত্বশীল আচরণ করি, তাহলে অন্য অনেক বদল ঘটবে তো বটেই, সড়কে দুর্ঘটনাও কমবে। বাংলা একাডেমির অভিধান বলছে, দুর্ঘটনার অর্থ অশুভ বা ক্ষতিকর ব্যাপার; বিপদ-আপদ; আকস্মিক বিপদ। তাই ন্যায়ের প্রতি দায়বদ্ধ সরকার ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিকের দেশে দুর্ঘটনা যেমন ‘রেয়ার’, বাংলাদেশেও তাকে নিত্যদিনের গা-সওয়া অবস্থা থেকে চিরতরে হটিয়ে দেওয়া সম্ভব।
আইন অমান্যকারীর প্রতি কঠোর আইন প্রণয়নের দাবি থাকুক। বেপরোয়া চালক, মালিকদের দাপট, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ—এসবের বিরুদ্ধে কণ্ঠ জোরালো হোক। পাশাপাশি আমরা সচেতন থাকি আমাদের দায়িত্ববোধের জায়গায়।
হাসান ইমাম সাংবাদিক
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা
রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।
এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”
আরো পড়ুন:
ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত
ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত
উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”
সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”
এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে।
ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।
ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।
ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।
ঢাকা/ফিরোজ